ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান

বঙ্গবন্ধু, ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্রলীগ

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২ জানুয়ারি ২০১৮

বঙ্গবন্ধু, ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্রলীগ

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঐতিহ্যের, সফলতার, সংগ্রামের, আন্দোলনের, গৌরবের, বিজয়গাথার ৭০ বছর পূর্তি হচ্ছে ৪ জানুয়ারি ২০১৭। ১৯৪৭ এর আগস্ট কলকাতার প্রগতিশীল তরুণ নেতা শেখ মুজিব তাঁর সমমনাদের নিয়ে চলে এলেন ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৪ সাল থেকেই ঢাকায় ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ নেতার সক্রিয় অংশগ্রহণে খাজা নাজিমুদ্দীন এবং আহসান মঞ্জিল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী ধারা গড়ে উঠছিল। ১৯৪৭ এর আগস্টের পর শেখ মুজিব এবং তাঁর অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসঙ্গী ঢাকায় এসে এতে যোগদান করাতে সে প্রতিবাদী ধারা আরও জোরদার হয়ে উঠল। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তান কালের রাজনৈতিক কর্মকা-ের শুরু ১৫০ নম্বর মোগলটুলির ‘পার্টি হাউস’ থেকে। তাঁর সমকালীন রাজনৈতিক সহযোগী তরুণ রাজনীতিক কমরুদ্দীন আহমেদ তাঁর গ্রন্থে এ সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘আবুল হাশিম সাহেবের প্রেরণা পেয়ে পার্টি হাউস গঠন করা হলো ১ এপ্রিল, ১৯৪৪ সালে ঢাকার ১৫০ নম্বর চক মোগলটুলিতে। তিনতলা বাড়ির নিচের তলায় কাগজের দোকান হায়দার সাহেব নামে এক ভদ্রলোকের। দোতলায় অফিস আর তেতলায় সর্বক্ষণ কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা এবং কনফারেন্স রুম।’ ১৯৪৭ সালের আগস্টের পর ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে পার্টি অফিসকে কেন্দ্র করে আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী অনুসারী তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা একত্রিত হতে থাকেন। এই অফিসটি ঢাকাতে অবস্থিত থাকলেও সারা পূর্ব বাংলায় নাজিমউদ্দীন সরকার বিরোধী যুবকরা রাজনীতির ক্ষেত্রে তাকেই অবলম্বন করে নিজেদের প্রাথমিক কাজকর্ম পরিচালনা করেন। ১৯৪৩-এর আগস্টের পর শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, শওকত আলী, মুহম্মদ আলমাস, মোহাম্মদ আউয়াল প্রমুখ নাজিমউদ্দীন বিরোধী তরুণ কর্মীরা এই অফিসকে কেন্দ্র করে ‘পূর্ব বাংলার নতুন রাজনীতি গঠন’ চিন্তায় নিযুক্ত ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সমমনা সাথীরা কলকাতা থেকে এসে সেই রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করেন। কমরুদ্দীন আহমদ তাঁর গ্রন্থে বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা থেকে অনেক ছাত্র এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে থাকে এবং শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মোগলটুলি অফিসে ওয়ার্কার্স ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। শামসুল হক সাহেব ঐ ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কনভেনর হন। ছাত্রকর্মীরা শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এর কারণ বিশ্লেষণে কমরুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘শেখ সাহেব শামসুল হকের তুলনায় সে যুগে অনেক বেশি বাস্তবধর্মী ছিলেন। তিনি প্ল্যাটোর মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রতিমূর্তি ছিলেন না। তিনি সেই যুবক বয়সেও এরিস্টলের মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা প্রতিমূর্তির মতো ছিলেন। আদর্শের চাইতে দৈনন্দিন জীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল বেশি। শেখ সাহেব তত্ত্বের বা মতবাদ প্রচারের চেয়ে বাস্তবজীবনের সংগ্রামে বেশি বিশ্বাসী ছিলেন। তাত্ত্বিক আলোচনার সময় ব্যয় না করে কর্মরত থাকায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর চোখে-মুখে একটা দীপ্তি ছিল। কর্মীদের মধ্যে, ভবিষ্যত যে তাঁর হাতের মুঠোয় আসতে বাধ্য সে বিশ্বাস জন্মাবার ক্ষমতা তাঁর ছিল, যেসব কর্মী তাঁর সান্নিধ্যে যেত তাঁদের সঙ্গে একটা কল্পনার সুখী সমাজের স্বপ্ন সৃষ্টি করার শক্তি ছিল। যে সংগঠনটি ‘তৎকালীন পূর্ববাংলায় আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তনের’ শুভ সূচনা করে, ছাত্র-যুব কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে এবং যা গঠনে শেখ মুজিব তাঁর সমমনা তরুণদের সঙ্গে মিলে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা হলো গণতান্ত্রিক যুবলীগ। প্রকৃতপক্ষে, এই সংগঠনটির জন্ম হয় ১৯৪২ সালে কলকাতার সিরাজদ্দৌলা হলে। শেখ মুজিব, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস, শহীদুল্লা কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রমুখ তৎকালীন ছাত্র ও যুবকর্মীরা পাকিস্তানে এবং বিশেষ করে পূর্ববাংলায় তাদের রাজনীতির ধারা ঠিক করার জন্য বৈঠকে মিলিত হয়ে যে আলোচনা করেন, সিদ্ধান্ত নেন তারই ধারাবাহিকতায়। ‘পূর্ববঙ্গ ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই বৈঠকটি ছিল ঐতিহাসিক। কারণ পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও তার উপযুক্ত সংগঠন গড়ার জন্য এই বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো।’ শেখ মুজিবসহ এই ছাত্রনেতারা ঢাকায় এসে ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে ছাত্র-যুব নেতা কমরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ, নূরুদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ‘আলোচনায় সম্পূর্ণ মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পূর্ববাংলায় নতুন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মকা- শুরু করা ও নীতি নির্ধারণের জন্য একটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য তাঁরা একমত হন। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন পূর্ববাংলার ছাত্র-যুব কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। এই লক্ষ্যে সারা পূর্ববাংলাকে কতকগুলো এলাকায় ভাগ করা হয়। উপরোক্ত নেতৃস্থানীয় ছাত্র যুবকর্মীগণ বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক সফর শুরু করেন। সব অঞ্চল থেকেই আশাতীত সাড়া পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় ১৯৪৭ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মীদের এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের তারিখ ঠিক করা হয়। কিন্তু তখন এই ধরনের সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি ছিল না। সে পরিস্থিতি সম্বন্ধে গণতান্ত্রিক যুবলীগের অন্যতম উদ্যোক্তা কমরুদ্দীন আহমদ বলেছেন ‘তখন সাহেবে আলম (খাজা নাজিমউদ্দীনের ভাই) ঢাকার গু-াদের নিয়ে আমাদের (প্রগতিশীল ছাত্র গ্রুপ) আক্রমণের চেষ্টা করছে। এমন কি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেব নিরাপত্তার জন্য কাদের সর্দার সাহেবের একটি ঘরে বাস করেছেন এবং সেখানে বসেই ওকালতি করেছেন। কলকাতা থেকে দেশ বিভাগের (১৯৪৭) পর পরই যাঁরা ঢাকায় চলে আসেন তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুর রহমান চৌধুরী, জহিরুদ্দিন, নুরুদ্দীন আহমেদ, কাজী গোলাম মাহবুব, কাজী আহমেদ কামাল প্রমুখ। এঁরা সকলেই ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী। শেখ মুজিব ঢাকায় এসেই গণতান্ত্রিক যুবলীগের সঙ্গে যুক্ত হন। শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, কমরুদ্দীন আহমদ, নইমুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ এবং অলি আহাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের এখানেই ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়। মুজিব ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঐ সময়ে পূর্ব বালায় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিরোধের সূত্রপাত হয়। শেখ মুজিব রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে দৃঢ় ভূমিকা নিয়েছিলেন। এ সময়ে শেখ মুজিবের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মকা-ের মধ্যে ৪৮-এর ভাষা আন্দোলনে খাজা নাজিমুদ্দীনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ এবং কারাবরণ উল্লেখযোগ্য। যেহেতু রাজনীতিতে তখন তরুণরা সক্রিয়, বলিষ্ঠ এবং অগ্রগামী ভূমিকা রাখতে শুরু করেন তাই এসব ঘটনা তাদেরকে মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। এদের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষত রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তরুণদেরকে বিদ্রোহী করে তোলে। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি সেখানে বলেছেন, ‘তখন একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল মুসলিম লীগ। আমরা ভাষার ওপর আঘাত সহ্য করতে পারলাম না, তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ঐ সময় পূর্ব বাংলার প্রতি পাকিস্তান সরকারের আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গি পূর্ববাংলার ছাত্রনেতাদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি করে।’ বাংলাদেশ কেন্দ্রিক ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যাঁরা উদ্যোগ নেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ঐ সময়ের আর একজন ছাত্রনেতা ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বক্তৃতায় ছাত্রলীগের জন্ম প্রক্রিয়ার বিস্তৃত বিবরণ দেন। তিনি, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও কয়েকজন নিখিল পূর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারের সমর্থক শাহ আজিজুর রহমানের কাছে যান। তাঁরা তাঁকে উক্ত সংগঠনের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বানের অনুরোধ জানালে তিনি তাতে রাজি হননি। মোগলটুলির কর্মী শিবিরের কর্মীদের শেখ মুজিবুর রহমান নতুন ছাত্র সংগঠনের প্রস্তাব দেন এবং প্রস্তাবে সমর্থন দিতে আহ্বান জানালে সকলেই সাড়া দেন। নেতৃস্থানীয় কর্মীদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, নঈমউদ্নি আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, আবদুল মতিন প্রমুখ সভায় যোগদান করেছিলেন। এই সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। অলি আহাদ এবং মোহাম্মদ তোয়াহা সংগঠনের ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দেয়ার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করলে শেখ মুজিবুর রহমান তার বিরোধিতা করে বলেন যে, এই সময় এটা বাদ দেয়া সঠিক পদক্ষেপ হবে না, সরকার এর ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। তবে পরে সময় অনুকূল হলে বাদ দেয়া হবে। আবদুল মতিন, শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য সমর্থন করেন। ‘মুসলিম’ শব্দটি রাখা হলো। ছাত্রলীগের বিদ্রোহী নেতাকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল মিলনায়তনে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিলিত হয়েছিলেন। সভাপতিত্ব করেন নাজমুল করিম। এ সভাতেই পুরাতন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের নাম থেকে ‘নিখিল’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। বিদ্রোহী গ্রুপটি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে পরিচিত হয়। নইমুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে এই সংগঠনের অস্থায়ী কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। পুনর্গঠিত ছাত্রলীগের শুধু নতুন কমিটি হলো না, নতুনভাবে আদর্শায়িতও হল এই ছাত্রলীগ। দলের নাম ‘মুসলিম’ শব্দটি থাকলেও ছাত্রলীগের এই অংশের অধিকাংশ নেতাই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। ফলে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে আর এর উত্তরাধিকার ঐতিহ্য থাকল না, নতুনভাবেই ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি কার্যত ভিন্ন একটি ছাত্রলীগ জন্ম নিল। নতুন আদর্শে ছাত্রলীগের জন্ম পূর্ববাংলার শুধু ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসেই নয়, জাতীয় রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এটিকে ১৯৪৭ পূর্ব সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বলিষ্ঠ অবস্থান বলে অভিহিত বা চিহ্নিত করা যেতে পারে। নতুন কেন্দ্রীয় অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটির তালিকা নিম্নরূপ : নইমুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী), আহ্বায়ক, সদস্যবৃন্দ, আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী (চট্টগ্রাম), শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর), আজিজ আহমদ (নোয়াখালী), আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া), সৈয়দ নুরুল আলম (ময়মনসিংহ), আবদুল মতিন (পাবনা), দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), মফিজুর রহমান (রংপুর), অরি আহাদ (ত্রিপুরা), নওয়াব আলী (ঢাকা), আবদুল আজিজ (খুলনা) এবং নুরুল কবির (ঢাকা শহর)। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে এ সকল ছাত্রনেতা ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আবেদন’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্রে নতুন ছাত্র সংগঠন গড়ার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে প্রচারের জন্য বিলি করেন। এতে উল্লেখ করা হয়: ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পর হইতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও জনগণ যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছেন তার আশু সমাধানের জন্য সুষ্ঠু ছাত্র আন্দোলন একান্ত প্রয়োজনীয়। দুর্ভাগ্যবশত এ ব্যাপারে পূর্বতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান ‘মুসলিম ছাত্রলীগ’ আমাদের নিরাশ করিয়াছে। এই ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি নতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনে সহায়তা করার জন্য আমরা আপনাদের সহযোগিতা কামরা করি। পূর্ব পাকিস্তানে নবাগত ছাত্রদিগের পড়াশোনা বাসস্থানের বন্দোবস্ত করিয়া দিতে সরকার গাফেলতি প্রকাশ করিতেছে, বেপরোয়াভাবে রিকুইজিশন দিয়া সরকার সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করিয়া লইয়াছে। প্রাইমারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানচাল হইয়া যাইবার পথে। বাংলা ভাষাকে শিক্ষার বাহন, রাষ্ট্রভাষা এবং আদালতের ভাষা বলিয়া ঘোষণা করিতে বিশ্বাবদ্যালয়, সরকার অস্পষ্ট ও সন্দেহজনক অভিমত প্রকাশ করিয়াছে, সরকারের উদাসীনতা ও পরিচালনা অব্যবস্থার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পথে আসিয়া পৌঁছিয়েছে; রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা যেন স্থান না পায় তজ্জন্য ভীষণ ষড়যন্ত্র চলিতেছে এবং নতুন নোট, স্ট্যাম্প, খাম, পোস্টকার্ড, মানি অর্ডার ফর্ম, মুদ্রা ও অন্যান্য জিনিস হইতে সমস্ত পাকিস্তানের জনসাধারণের ২/৩ অংশের বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়া হইয়াছে। ইংরেজীর পরিবর্তে উর্দুর জুলুম আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে বসিয়াছে। বিমান, নৌ ও স্থল বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের পুরাপুরি বাদ দেয়া হইতেছে।’ সার্কুলারে বিবৃতি বক্তব্য থেকে পূর্ববাংলার প্রগতিশীল ছাত্র নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবস্থান স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ববাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি ও আচরণ অল্প সময়ের মধ্যেই ধরা পড়ে। ছাত্র নেতৃত্বই সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত রাজনৈতিক বিদ্রোহ এবং প্রতিবাদ শুরু করে। রাজনৈতিক অপর কোন শক্তির অবস্থান তখনও নিশ্চিত হয়নি। প্রগতিশীল ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিলো বলিষ্ঠ। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর বঙ্গবন্ধু প্রায় সকল জেলারই কমিটি করতে সক্ষম হলেন। যদিও নইমউদ্দীন কনভেনর ছিলেন কিন্তু সকল কিছুই প্রায় বঙ্গবন্ধুকেই করতে হতো। তিনি একদল নিঃস্বার্থ সহকর্মী পেয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রকাশ্যে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে সাহায্য করতো আর নবগঠিত ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা লাগিয়ে রাখতো। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা, প্রেরণাদাতা, চালিকাশক্তি ও প্রাণপুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ছাত্রলীগ গঠন হওয়ার পর প্রথম দায়িত্ব পড়ে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের। এ পর্যন্ত পড়া ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি করাচীতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠক ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ে আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দূকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বন্ধু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা হলো বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজী হচ্ছিলেন না। তখন বোঝা যাচ্ছিল বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দূ করার। চলবে... লেখক : ভাইস-চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×