ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ শতক ॥ জগৎজ্যোতি দাস ॥ ইতিহাসের বীরশ্রেষ্ঠ -মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭

একুশ শতক ॥ জগৎজ্যোতি দাস ॥ ইতিহাসের বীরশ্রেষ্ঠ  -মোস্তাফা জব্বার

॥ দুই ॥ মাত্র ১২ জন যোদ্ধা নিয়ে নিতান্তই এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত জগৎজ্যোতির কণ্ঠ চিরে হঠাৎ বেরোয় এক অদ্ভুত উৎসাহের কথা, ‘চল, আজ শালাদের জ্যান্ত ধরব, একেবারে হাতেনাতে।’ মৃত্যুভয়কে তুড়ি মেরে অকুতোভয় দুঃসাহসে যুদ্ধ করে যাওয়া ছোট্ট দলটায় তবুও ছোবল দিতে আপ্রাণ চেষ্টায় মাতে মৃত্যু। আইয়ুব আলির মাথায় গুলি লাগে, তাকে দু’জনের জিম্মায় দিয়ে পিছিয়ে বদলপুরের দিকে পাঠিয়ে দেন জ্যোতি। ভয়ঙ্কর একপেশে সে যুদ্ধে একটু পর আহত হন আরেক মুক্তিযোদ্ধা। মাথার ওপর চক্কর দিতে থাকে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ফগার, শিকারী হাউন্ডের মতো। ওদিকে বদলপুরে থাকা মূল দলের বাকি ৩০ জনকে আটকে রাখে পাকিস্তানীদের আরেকটি দল। কোন সাহায্য পৌঁছায় না জ্যোতির দলের কাছে, দলের মাথাটা বাগে পেয়েছে আজ পাকিস্তানীরা, কেটে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় তারা। ক্রমশ কঠিন হয়ে যাওয়া যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইলিয়াস জিজ্ঞেস করেন, ‘দাদা, কি করব?’ নির্মোহ গলায় জ্যোতির শান্ত জবাব,‘তোর যা খুশি কর।’ কমান্ডার যেন বুঝতে পেরেছিলেন এটাই তার শেষ যুদ্ধ। শেষ যুদ্ধ পরিচালনার ভার তাই প্রিয় সহযোদ্ধার কাঁধে দিয়ে জ্যোতি মন দেন নিখুঁত নিশানার দিকে। ফুরিয়ে আসতে থাকে গুলি। ইলিয়াস বিনোদবিহারীসহ আরও দু-তিনজনকে পাঠান বদলপুর থেকে যেভাবেই হোক গুলিসহ রসদ আনবার জন্য। বিকেল সাড়ে তিনটায় হুট করে গুলি লাগে ইলিয়াসের বুকের বাম পাশে। হাত দিয়ে দেখেন, কি আশ্চর্য, হদপিন্ড- ভেদ না করেই গুলি বেরিয়ে গেছে যেন কিভাবে। মাথার গামছা খুলে বুকের ক্ষতস্থান বেঁধে দিতে দিতে জ্যোতি জিজ্ঞেস করেন, ‘বাঁচবি?’ বুকে বুলেটের ক্ষত নিয়ে আহত ইলিয়াস জবাব দেন, ‘মনে হয় বাঁচতে পারি।’ কমান্ডার নির্দেশ দেন, ‘তবে যুদ্ধ কর।’ ১২ জন থেকে যোদ্ধার সংখ্যা এসে দাঁড়ায় পাঁচজনে। একটু পরে ¯্রফে ইলিয়াস এবং জ্যোতি ছাড়া আর কারোর অস্ত্র থেকে গুলির শব্দ শোনা যায় না। এমনকি জ্যোতির এলএমজির গুলি সরবরাহকারীও নেই আর। মধ্য নবেম্বরের দীর্ঘ বিকেলের সেই ক্লান্ত সময়ে এক অসম্ভব যুদ্ধে লিপ্ত হন দুই যোদ্ধা। ইলিয়াস গুলি লোড করতে থাকেন, আর জ্যোতি ১০০ গজ দূরে সারিবদ্ধ পাকিস্তানীদের গুলি করতে থাকেন অকুতোভয়, তীব্রতায়। নিখুঁত নিশানায়, একটার পর একটা। মাথার ওপর দিয়ে তীব্র গর্জন করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানীদের একটার পর একটা গুলি। তাতে বাঁধ দিতে মাঝে মাঝেই মর্টার থেকে শেলিং করছেন তারা। মনে ক্ষীণ আশা, সন্ধ্যা হয়ে গেলে হয়ত পাকিস্তানীদের ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যাবে। হায়! সময় ওটুকু সময়ও দেয়নি। সেদিন সন্ধ্যা হওয়ার ঠিক আগে জ্যোতির মাথা ভেদ করে যায় এক আচমকা পাকিস্তানী বুলেট। গলাকাটা মহিষের মতো ছটফট করে জ্যোতির শরীর। ইলিয়াস জড়ায়ে ধরেন তারে। ডাকেন, ‘দাদা, ও দাদা’। জ্যোতি একবার মাথা তোলেন, মাথা পড়ে যায়। যাবার আগে মাতৃভাষায় ¯্রফে দুটো ক্লান্ত শব্দ উচ্চারিত হয় পাকিস্তানীদের সীমাহীন আতঙ্ক আর ভয়ের কারিগরের কণ্ঠ থেকে, ‘আমি যাইগ্যা’। সেদিন কাঁদতে পারেননি। যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাদের কাঁদার নিয়ম নেই। সে ইলিয়াস কাঁদেন ৪৩ বছর পর, ২০১৫ সালের ২০ জুন, স্বাধীন মাটিতে সেদিনের সেই যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, দাদার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, চিৎকার করে কাঁদেন দাদার জন্য, তার কমান্ডারের জন্য। এ কান্না বড় শোকার্ত, তীব্র আর্তনাদের। এ কান্না হদয়ের গহীন ভেতরের, বড় যন্ত্রণার। যুদ্ধের পরের কথাগুলো আরও পরে পাঠ করতে পারা যায়। জগৎজ্যোতির শহীদ হওয়ার ছোট ইতিহাসটুকু আরও বলার আছে। জগৎজ্যোতির লড়াইয়ের প্রেক্ষিতটা একটু বর্ণনা করা দরকার। জগৎজ্যোতি হাওড়ের সন্তান। হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানার জলসুখা গ্রামে তার পিতৃভূমি। আমি জগৎজ্যোতির গ্রামের বাড়ির পাশে বিরাট গ্রামের এ এ বি সি হাইস্কুলে পড়েছি, যেখানে তিনি পড়েছেন। বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে হাওড় অঞ্চলে যুদ্ধটা সেভাবে হয়নি। বিশেষ করে শাল্লা থানায় যুদ্ধটা ভিন্ন চিত্রের ছিল। একাত্তর সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরও হাওড়ে পানি আসার আগে সেখানে পাকিস্তানের পক্ষের কোন মানুষ কোথাও নজরে আসেনি। একটি মুক্ত স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে খালিয়াজুরি-শাল্লাসহ হাওড়ের থানাগুলো মুক্তাঞ্চল হিসেবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উঁচিয়ে রেখেছিল। আমার থানা খালিয়াজুরি পুরো নয় মাসই মুক্তাঞ্চল ছিল। পাকবাহিনী দূরে থাক, তাদের দেশীয় দোসররাও কোথাও দৃশ্যমান ছিল না। ৭০ সালের নির্বাচনের সময় আমরা আমাদের থানাটিকে যেমনভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে নিতে পেরেছিলাম সেটি পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও ছিল। থানা সদরে পুলিশ থাকলেও বস্তুত বেসরকারীভাবে প্রশাসন চালাতাম আমরা। কিন্তু পাশের থানা শাল্লার চিত্রটা ভিন্ন ছিল। হাওড়ে পানি আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাওড়ের গ্রামগুলো জ্বলতে থাকে। বাহারা ইউনিয়নের এককালীন চেয়ারম্যান সরাফত আলী এবং শ্যামারচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল খালেকের নেতৃত্বে সেই এলাকার মানুষের মধ্য থেকে বাছাই করে ১৬০ জনের একটি রাজাকার বাহিনী সুনামগঞ্জ থেকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে শাল্লা থানার হিন্দু গ্রামগুলো পোড়ানো শুরু করে। পুরো হাওড় এলাকায় এত বিশাল আকারের রাজাকার বাহিনী আর কোথাও ছিল না। ২৬ মার্চের পরই জগৎজ্যোতিদের মতো অনেক তরুণ টেকেরহাটে পৌঁছে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় একই সময়ে শাল্লা এলাকায় আসে। টেকেরহাটে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন। শাল্লা থানাটির দেখাশোনা করতেন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী। আমার গ্রামের আবুল কাসেম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে টেকেরহাট চলে যান। জগৎজ্যোতির বিশাল বাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে কাসেমও যোগ দেন। আমি আরও পরে যুদ্ধে যোগ দিই। বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চল সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণা যাদের নেই তারা সেই এলাকার রাজনীতিটাও বুঝতে পারবেন না। এই এলাকাটি সারা বাংলার চাইতে ভৌগোলিক দিক থেকে যেমন আলাদা তেমনি এর বাসিন্দাদের অনুপাতটাও ভিন্ন। সত্তর সালের দিকে পুরো হাওড় এলাকায় জনসংখ্যার অর্ধেক ছিল মুসলমান ও বাকিটা হিন্দু। শত শত বছর ধরে এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছে। এলাকাটি বাম রাজনীতিরও কেন্দ্র ছিল। মুসলিম লীগ বা পাকিস্তান ঘরানার কোন দলের বাস্তব অস্তিত্ব এই এলাকাটিতে ছিলই না। আমার বাড়ি খালিয়াজুরিতে এখনও একটি ইউনিয়ন আছে, যার সকল মানুষই হিন্দু। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব ছিল সেই এলাকাতে। আমার থানায়ও আওয়ামী লীগ তেমন প্রবল শক্তিশালী ছিল না। থানা সদরে একজন মানুষ নৌকার পক্ষে কাজ করতেন। শিক্ষায় পিছিয়ে বলে ছাত্র সংগঠনও তেমন ছিল না। আমি ও জগৎজ্যোতি যে স্কুলের ছাত্র তাতে শতকরা ৭০ জন ছাত্র হিন্দু ছিল। মুসলমানরা তাদের সন্তানদের পড়াত না। ৭০ সালে আমার এলাকায় কুঁড়েঘরের প্রার্থী ছিল। পাশের থানা শাল্লা-দিরাইতে সুরঞ্জিত বাবু জিতে এসেছিলেন। এটি একাত্তর সালে যেমনি সুবিধার বিষয় ছিল তেমনি অসুবিধারও ছিল। সুবিধাটি হলো আমরা শতভাগ মানুষের সমর্থন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। অসুবিধা ছিল ঐ এলাকার হিন্দু জনগোষ্ঠীই পাকিস্তানীদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একদিকে সমগ্র জনগোষ্ঠীর আদরে থাকতাম, অন্যদিকে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা, তাদের সম্পদ রক্ষা করা। আমরা প্রায় পুরো হাওড় এলাকাটিকে রক্ষা করতে পারলেও শাল্লা থানাটিকে রক্ষা করতে পারিনি। এর প্রধানতম কারণ ছিল সরাফত-খালেকের রাজাকার বাহিনী। হাওড় এলাকার আর কোন থানায় এত বড় ক্ষতি হয়নি। এত মানুষের ঘর-সম্পদ আর কোথাও পোড়ানো হয়নি। তবে প্রাণহানির বড় ঘটনা ঘটেনি এজন্য যে, হিন্দু গ্রামবাসীরা তাদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ঢাকা ॥ ২২ ডিসেম্বর, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক [email protected],
×