ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং ছেচল্লিশ বছরে মধ্যবিত্ত -মিলু শামস

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২০ ডিসেম্বর ২০১৭

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং ছেচল্লিশ বছরে মধ্যবিত্ত  -মিলু শামস

ছেচল্লিশ বছরের বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের বিবর্তন চোখে পড়ার মতো। মধ্যবিত্ত শ্রেণী দোদুল্যমান, সুবিধাভোগী হলেও এ অঞ্চলে ব্রিটিশ আমল থেকে রাজনৈতিক এবং সামাজিক অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদে নেতৃত্বে ছিল মধ্যবিত্তই। কিন্তু স্বাধীনতার দু’দশক পর থেকে ধীরে ধীরে তাদের তেজ যেন কমেছে। বর্তমান সময়ে এসে মধ্যবিত্ত প্রায় পুরোপুরি প্রতিবাদহীন। আন্দোলন বিমুখ। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধর্মীয় জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দেয়ায় ব্রেনওয়াশ হয়েছে একটি অংশের। ব্রেনওয়াশের কাজ নানা রূপে নানা নামে পৃথিবীজুড়ে চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও তার একটি ধারা বহমান রয়েছে গত শতকের মধ্য সত্তর থেকে। মৌলবাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাধারণত সামরিক শাসন। আমাদের দেশে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের জন্মের সঙ্গেও এ সত্য জড়িয়ে আছে। ধর্মীয় রাজনীতি বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে সক্রিয় রাজনীতির আইনী অধিকার দেয় সামরিক সরকার। যারা সর্বতোভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার করেও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ঠেকাতে পারেনি। অন্য সব রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি তারাও রাজনীতি করার সমানাধিকার পেল এবং ধীরে ধীরে তাদের আসল রূপ উন্মোচিত হতে লাগল। সংবিধান থেকে উধাও হলো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি। পরের সামরিক সরকার সংবিধানকে আরেকটু ধর্মীয়করণ করে তাদের বিচরণকে আরও স্বচ্ছন্দ করে দিল। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও অন্যান্য সহযোগী দেশ থেকে তাদের জন্য অর্থ সাহায্য আসার সোনালী দিগন্ত খুলে গিয়েছিল মূলত সামরিক শাসকদের সময় থেকেই। সে টাকায় তারা নিজেরা শক্তিশালী হয়েছে, মসজিদ-মাদ্রাসা বানিয়েছে আর প্রতিপক্ষের হাত-পায়ের রগ কেটেছে। শুধু সাংগঠনিকভাবে নয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও এরা শক্তিশালী হয়েছে। ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে একদিকে সমাজের মূল¯্রােতের সঙ্গে মিশে গেছে; অন্যদিকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম দিয়ে মাঝে মাঝে ঝলসে উঠে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এক ধরনের সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী জামায়াতে ইসলামীর সোশ্যালাইজেশনকে পরোক্ষে সহযোগিতা করেছেন। একদিকে প্রকাশ্য রাজনীতি করার আইনী অধিকার, অন্যদিকে সামাজিকভাবে মিশে যাওয়ার অনিবার্য সাংস্কৃতিক অভিঘাতের মধ্যে বেড়ে উঠেছে গোটা একটি প্রজন্ম; পরিণত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির প্রত্যক্ষ সমর্থক না হলেও এদের অনেকে ইসলামী ভাবধারা বা জেহাদের প্রতি সহানুভূতিশীল শুধু ধর্মীয় দুর্বলতার কারণে। একই কারণে টুপি-দাড়ি ও হিজাবের আধিপত্য বেড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামী জঙ্গীবাদের উত্থানও এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। কোন কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। আশির দশকে এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে সামরিকতন্ত্রের যে উত্থান তা তো দুর্বল দেশেগুলোকে গিনিপিগ বানিয়ে সা¤্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য পূরণেরই অন্য এক কৌশল ছিল। একই উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিকভাবে ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীকে পরিপোষণ করা হয়েছে। বিশেষ করে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র পতনের পর এ প্রক্রিয়া দ্রুত বেগবান হয়েছে। ইসলামের শান্তি, সাম্য ও প্রগতিশীল ধারাটি জঙ্গীবাদী ধারার চাপে কোণঠাসা হয়ে আছে। মৌলবাদী সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ধারকরা মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করে। একভাগে ইসলামে বিশ্বাসীরা, অন্যভাগে ইসলামে অবিশ্বাসীরা। তারা মনে করে, অবিশ্বাসী কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য। এরা ওহাবী আন্দোলনের উত্তরসূরি। যারা মনে করে ইসলাম কোন অবস্থাতেই আদি ইসলামী ভাবধারা অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের রীতিনীতি থেকে বিচ্যুত হবে না। আঠারো শতকের শেষ দিকে গোটা আরব ভূখ- যখন তুর্কী খিলাফতের অধীনে ছিলÑ ক্ষয়িষ্ণু সেই খিলাফত আমলে মৌলবাদী ধর্মীয় নেতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব এই আন্দোলনের প্রবক্তা। এ উপমহাদেশে একে গতিশীল করেছেন উত্তর ভারতের রায়বেরেলির সৈয়দ আহমদ নামে আরেক মৌলবাদী নেতা। উনিশ শতকের শুরুর দিকে তার আবির্ভাব। তিনি ইসলামী রাজত্ব পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যে পথে এগোচ্ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের সে সময়ের বাস্তবতায় তা যে অসম্ভব তা অল্পদিনেই বুঝেছিলেন। তার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার মধ্যেই পথ খুঁজেছে। ধর্মীয় আন্দোলন সম্পর্কে আধুনিক উপলব্ধি নিয়ে উত্তর ভারত থেকেই এসেছিলেন আরেকজনÑ সৈয়দ আহমদ খান। আর পশ্চিম বাংলা থেকে সৈয়দ আমির আলী। ইংরেজী শিক্ষিত এ দুই নেতা সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে উদার যুক্তিবাদী চিন্তা দিয়ে ইসলামের ব্যাখ্যা করেছেন। আমির আলী মুক্ত মন নিয়ে কোরান পাঠ করার কথা বলেছেন, আগেকার দিনের আলেম উলামারা যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেভাবে নয়। তার মূল বক্তব্য ছিল জ্ঞানের চর্চা ছাড়া কোন সংস্কার সম্ভব নয়। মানুষের মনকে শৃঙ্খল মুক্ত করতে হলে সেখানে জ্ঞানের আলো প্রবেশ করাতে হবে। সৈয়দ আমির আলী মাদ্রাসা শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। মনে করতেন এ ব্যবস্থা একেবারেই পশ্চাৎমুখী এবং মনকে আলোকিত করতে অক্ষম। তিনি মাদ্রাসা তুলে দিয়ে ইংরেজী ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন। সৈয়দ আহমদ খান, সৈয়দ আমির আলীর পথ ধরে এসেছিলেন আরও কয়েকজন উদার ও মুক্তবুদ্ধির ইসলামী চিন্তাবিদ। কিন্তু ইসলামের উদার ধারার বদলে এখন প্রকট হয়েছে উগ্র ধর্মীয় জঙ্গীবাদ যা ইসলামের সমন্বয়ধর্মী ও মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছে। সাতচল্লিশে ভারত ভাগের পর সে সময়ে বিশ্বের দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ অঞ্চলের রাজনীতিতেও মেরুকরণ হয়েছে। রাশিয়া যাতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে যুক্তরাষ্ট্র সে জন্য পূর্বপরিকল্পিতভাবেই পাকিস্তানের ইসলামী সামরিক সরকারকে সমর্থন দেয়। তারা হয়ত ভেবেছিল, রক্ষণশীলতা ও মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষতা কমিউনিস্টদের রুখতে পারবেÑ যার লাভের ফসল তাদের ঘরে উঠবে। সে জন্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থন দিয়েছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ তাদের বিরোধী শিবিরে যোগ দিতে পারে। কিন্তু সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ নিয়ে এদেশ স্বাধীন হয়। চমৎকার একটি সংবিধান রচিত হয়। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সবকিছু এলোমেলো হয় যায়। এদেশ প্রতিষ্ঠায় যারা বিরোধিতা করেছিল নানা কূটকৌশলে তারাই দেশের ‘বন্ধু’ হয়। সামরিক শাসন আসে। ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ শিকড় গাড়তে থাকে। রগকাটা, কুপিয়ে মারার সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করে। এমন কি ব্লাসফেমি প্রবর্তনের চেষ্টাও হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ এই বাংলাদেশে। বাড়তে বাড়তে এরা কোথায় পৌঁছেছিল চারদলীয় জোট আমলই তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী। আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে এরা। নানা ধরনের জঙ্গী তৎপরতার মাধ্যমে মাঝে মাঝেই জানান দিচ্ছে তারা আছে। তাদের নেতাদের কারামুক্ত করার জন্য তারা মাঠে আছে। এখন লুকিয়ে ঘাপটি মেরে থাকলেও এক সময় হয়ত আড়াল ঘুচিয়ে আরও স্পষ্ট হবে। অতএব, মধ্যবিত্ত দোদুল্যমানতা ভেঙ্গে প্রতিরোধের আন্দোলনে নামার সময়ও হয়ত ঘনিয়ে এসেছে।
×