ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ পাচাররোধে

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

অর্থ পাচাররোধে

অর্থ পাচাররোধের কাজটি যদি ধীরগতিতে এগোয় তবে পাচারের মাত্রা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসতে বাধ্য। বিলম্বে হলেও সরকার কতিপয় পদক্ষেপ নিয়েছে। অর্থ পাচারে জড়িত ব্যক্তি ও দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের পৃথক ডেটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। ডেটাবেজে থাকছে অর্থ পাচারকারী ও অর্থ পাচারে জড়িত প্রতিষ্ঠানের নাড়ি নক্ষত্রের তথ্য। অবশ্য ইতোমধ্যেই সংগৃহীত তথ্যের একটি খসড়া ডেটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। সেই ডেটাবেজে অর্থ পাচারে জড়িত দেশী-বিদেশী ৪৫ প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। এরই ভিত্তিতে পাচারকারী ও পাচারের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আগাম সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও পাচার বন্ধ হয়নি। অর্থ পাচারের ঘটনায় দায়ের করা দুই শতাধিক মামলার তদন্ত চলছে। কিন্তু সেই কাজেও রয়েছে শ্লথ গতি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, মামলার আসামিদের গ্রেফতারে দেশে-বিদেশে জোরালো অভিযান, কূটনৈতিক তৎপরতা ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড ওয়ারেন্ট জারির কাজ চলছে। এক্ষেত্রেও অগ্রগতি তেমন নেই। সিআইডি যেভাবে কাজ করছে তাতে দ্রুত কোন ফলাফল আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। দক্ষ জনবলের অভাবে অনেক অর্থ পাচার মামলার তদন্ত থেমে আছে। সিআইডির যে ভাষ্য মেলে তাতে দেখা যায় অর্থ পাচারের মামলা তদন্তের পরিমাণ এত বেশি যে, তা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য। অতীতে এত পরিমাণ মামলার কাজ হয়নি। বর্তমানে মুদ্রা পাচারের ঘটনা আগের তুলনায় অনেক বেশি উদ্ঘাটিত হচ্ছে বলে মামলা ও তদন্তের পরিমাণ বাড়ছে। তদন্তাধীন মামলার অভিযোগ অনুযায়ী কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। তদন্তে দেখা গেছে, প্রযুক্তির মাধ্যমে ভুয়া মাস্টার কার্ড তৈরির ফলে অর্থ পাচারের ঘটনা তুলনামূলক বেশি উদ্ঘাটিত হচ্ছে। একটি চক্রকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে ১৪১টি প্রিপেইড মাস্টার কার্ড উদ্ধার হয়েছে। এরা অনলাইনে পাচারকারীদের জন্য ভুয়া এ্যাকাউন্ট খুলে এর মাধ্যমে অর্থ পাচারকারীদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা ডলারে রূপান্তর করে আসছিল। সুবিধাটা ছিল এই যে, অনলাইনে করা এ্যাকাউন্টের ওপর বাংলাদেশের কোন ব্যাংকেরই মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। ওই এ্যাকাউন্ট অনুযায়ী তৈরি করে দেয়া হতো প্রিপেইড মাস্টার কার্ড। এসব কার্ড তৈরির সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্কিল, পাইওনিয়র, নেটেলার ও ফার্টিচয়েসসহ কয়েকটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান। মাস্টার কার্ড ব্যবসার আড়ালে অর্থ পাচারের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আরও কয়েকটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাজ করার তথ্য মিলেছে। বিদেশ থেকে কুরিয়ার সার্ভিস ও ডাকযোগে এসব কার্ড আসে। এখানেও এক ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়ে থাকে। যার সঙ্গে কুরিয়ার ও ডাক বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা জড়িত। কার্ডে পাচারকারীদের চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা রিচার্জ করার কাজটি করে চক্রটি। সেই মাস্টার কার্ড নিয়ে অনায়াসে অর্থ পাচারকারীরা ভিন্ন দেশে চলে যায়। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগে মাস্টার কার্ড, এটিএম কার্ড বা এ ধরনের ব্যবহার সামগ্রীর যেমন ‘চেকিং’ হয় না, তেমনি ‘স্ক্যানিং’ও নয়। আবার মাস্টার কার্ড কম্পিউটারে চেক করে তাতে কত অর্থ আছে বা দেশে ফেরার পর খরচ শেষে কত অর্থ কার্ডে রয়েছে তার কোন চেকিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এমন সুযোগ নিয়েই পাচারকারীরা এক বা একাধিক প্রিপেইড মাস্টার কার্ড নিয়ে বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশে গিয়ে অর্থ পাচার করে আবার দিব্যি দেশে ফিরে আসে। সংশ্লিষ্ট কারও নজরেই পড়ে না এসব। অর্থ যে পাচার করে সে সব সময় আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। আর এরই ফাঁকে পাচার হচ্ছে অর্থ এবং তা বেনামে। কারণ পাচার কাজে ব্যবহৃত কার্ড পাচারকারীর নামে নয়, এসব পাচার ঠেকানো যে যাচ্ছে না, তা বলাই বাহুল্য। প্রযুক্তির যত প্রসার ঘটছে অপরাধ তত বাড়ছে এবং তা নানা ধরনের। এই পাচার কাজে অর্থাৎ মাস্টার কার্ডের ব্যবসায় জড়িত দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী জড়িত থাকার অভিযোগ পুরনো। এদের নজরদারির আওতায়ও আনা হয়নি। পাচারকারীদেরও সহজে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই অপরাধ বাড়ছে। সম্প্রতি দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে প্রচারিত সৌদি আরবসহ বিশ্বের ১২টি দেশে বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া ও পুত্র তারেকের অর্থ পাচারের ঘটনা সামনে আসায় নড়াচড়া দিয়ে উঠেছে বিষয়টি। এ ছাড়া প্যারাডাইস পেপার্সেও এসেছে কয়েকজনের নাম। এদেরসহ অর্থ পাচারে জড়িত সবকিছু নজরদারির আওতায় এনে পাচাররোধে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ অত্যাবশ্যকী।
×