ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের র‌্যালি

মাথায় রক্তস্নাত পতাকা, বুকে দেশপ্রেম, চোখে মুখে বিজয়ের তৃপ্তি

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭

মাথায় রক্তস্নাত পতাকা, বুকে দেশপ্রেম, চোখে মুখে বিজয়ের তৃপ্তি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিজয়ের শোভাযাত্রার শুরু থাকলেও যেন শেষ নেই। একাত্তরের মতোই বিজয়ের আনন্দে মেতেছিল আওয়ামী লীগের লাখো নেতাকর্মী, সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। বিজয়ের ছেচল্লিশ বছর পূর্তির দিন শনিবার রাজধানীতে মানুষের স্রোত নামিয়ে বড় ধরনের শোডাউন করেছে ক্ষমতাসীন দল। দেখিয়েছে সাংগঠনিক শক্তির মহড়াও। বিজয় শোভাযাত্রাপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশ থেকেই আগামী নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে আবারও পরাজিত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির বিজয়ে ইষ্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তোলারও আহ্বান জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারক নেতারা। মহান বিজয় দিবসে ‘ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ৩২ নম্বর ধানম-ি’-দীর্ঘ প্রায় তিন কিলোমিটার পথে আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য ও মনোলোভা বিজয় র‌্যালিতে নেমেছিল লাখো মানুষের ঢল। পুরো রাজধানীই যেন পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। বলা চলে বিজয়ের আল্পনায় বর্ণিল সাজে গোটা রাজধানীই ছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখরিত। বিজয় মিছিলপূর্ব বিশাল সমাবেশ থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে থেকেই জঙ্গী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। হাজার হাজার মানুষের সমাগম। মাথায় রক্তস্নাত লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। বুকে দেশ প্রেম। গালে আঁকা মানচিত্র খচিত পতাকা। সবার চোখে মুখে ছিল বিজয়ের তৃপ্তি। এ যেন একাত্তরের পরে আরও একটি বিজয়। চারদিকের মাইকের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই বর্জনির্ঘোষ স্বাধীনতার ধ্বনি। দূর-দূরান্ত থেকে জয় বাংলা সেøাগান তুলে বাস-ট্রাকে চড়ে মিছিলে এসেছে বিজয়-আনন্দে উচ্ছল মানুষ। কোন ট্রাকে আবার বানানো হয়েছে বিজয় মঞ্চ। আবার মিছিলের সঙ্গে অনেকে নিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক বিশাল বিশাল আসল নৌকা, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অসংখ্য কাগজের কামান, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধাস্ত্র হাতে নিয়েও শামিল হয়েছিল বিজয় মিছিলে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানী হানাদার ও রাজাকারতের আত্মসমর্পণের ড্যামি দৃশ্যও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিজয় শোভাযাত্রায়। রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধীমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ের এ বিজয় মিছিল শেষ হওয়ার কথা ধানম-ির বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে। যখন সেখানে পৌঁছে মিছিলের অগ্রভাগ, তখনও শাহবাগ থেকে বের হতে পারেনি মিছিলের অন্য প্রান্ত, হাজারো মুখ। মাঝখানে মিছিলের ব্যাপ্তি ছিল রাজধানী ঢাকা জুড়েই। বেলা দেড়টা থেকেই ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণের ১৫টি নির্বাচনী এলাকা, ৪৯টি থানা এবং শতাধিক ওয়ার্ড থেকে অজস্র মিছিলের স্রোত এসে মিশেছিল ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে। ছেচল্লিশ বছর আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যেস্থানে পাক হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছিল, ঠিক সেই স্থানে বিজয়ী লাখো বাঙালীকে সঙ্গে নিয়ে শিখা চিরন্তরে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের মাধ্যমে এ বিজয় র‌্যালির উদ্বোধন করা হয়। সুশৃঙ্খল-দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল এই বিজয় র‌্যালিতে জাতীয় নেতাদের কণ্ঠেও ছিল একই শপথ- ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, এখন রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলব।’ নেতাদের এমন দৃপ্ত ঘোষণায় বিজয় র‌্যালিতে আসা হাজার হাজার মানুষের উৎফুল্লতা ও হর্ষধ্বনী সবার দৃষ্টি কাড়ে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিজয় র‌্যালি শুরু হয়ে শাহবাগ, কাঁটাবন, বাটার মোড়, এলিফ্যান্ট রোড, সাইন্স ল্যাবরেটরি, মিরপুর রোড হয়ে ধানম-ির ৩২ নম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে এসে শেষ হয়। প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই বিজয় র‌্যালিতে অংশ নেয়া সকল মানুষের কণ্ঠেই ছিল একই দাবি- ‘মুজিবের বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই, জামায়াত-শিবির-রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’।’ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনের রাস্তায় জনস্রোতের সামনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিজয় র‌্যালির উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন, বিজয় মিছিলটি স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম শোভাযাত্রায় পরিণত হয়েছে। জয় বাংলা হচ্ছে মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনী। আর এই জয় বাংলাকে যারা ধারণ করে না, অস্বীকার করে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না, করতে পারে না। তাই বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হবে। জয় বাংলা ও নৌকার স্লোগানে এখন থেকেই সারাদেশের নির্বাচনী মাঠ প্রকম্পিত করার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। আগামী বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনে আমাদের প্রতিপক্ষ কারা? আমাদের প্রতিপক্ষ হচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জয়বাংলা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিএনপির নেতৃত্বাধীন সেই অপশক্তির সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি অবশ্যই বিজয়ী হবে। সারাদেশে আবারও আমাদের বিজয়ের পতাকা উড্ডীন হবে। তিনি জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। এ সময় ওবায়দুল কাদের দলীয় নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’ মার্কা নিয়ে স্লোগান ধরলে পুরো এলাকা ‘নৌকা’ ধ্বনীতে প্রকম্পিত হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ঢাকার মতো সারাবাংলাদেশেই অভূতপূর্ব গণজাগরণ ও গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার অগ্নিসন্ত্রাসের নৈরাজ্য-জঙ্গীবাদকে মোকাবেলা করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে গত ৮ বছরে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে; যা কেবলমাত্র শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ছাড়া সম্ভব নয়। একথা বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠিত। আজকে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, হাতিরঝিল যাই-ই বলেন; এই মহানগরে আমরা যদি নিজেদের প্রশ্ন করি, এটা কি বিএনপি পারত? অসম্ভব। একমাত্র শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগই এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। তাই এই বিজয়ের দিনে আমাদের শপথ নিতে হবে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সকল অগ্নিসন্ত্রাস, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসকে ভেদ করেই আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলব। মহান বিজয় দিবসের এই বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ যৌথভাবে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানের সামনে খোলা ট্রাকের মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সভাপতি হাজী আবুল হাসনাত। দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের পরিচালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতারা। এ সময় মঞ্চে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে ওবায়দুল কাদের বেলুন উড়িয়ে বিজয় শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। এরপর একাত্তরের রণাঙ্গনের সেই অমিততেজী গগণবিদারী ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে বিজয় র‌্যালি শুরু হয়। আয়োজক ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ হলেও এ বিজয় র‌্যালিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়। সুবিশাল এ বিজয় র‌্যালিতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী, সমর্থক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার অসংখ্য সাধারণ মানুষকে সুদীর্ঘ এ বিজয় র‌্যালিতে অংশ নিতে দেখা যায়। বিজয় র‌্যালিতে নারীদের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখ করার মতো। একাত্তরের পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং ৭ মার্চে স্বাধীনতার ডাক দেয়া বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রকঠিন ঐতিহাসিক ভাষণের স্মৃতিবিজড়িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে দুপুর থেকেই মানুষের ঢল নামে। রাজধানীর ১০০টি ওয়ার্ড ও ৪৯টি থানা থেকে অসংখ্য মিছিল আসতে শুরু করে সেখানে। বিকেল ২টা বাজার আগেই শাহবাগ থেকে মৎস্যভবন পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তায় মানুষের তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাদ্য-বাজনার তালে তালে নেচে গেয়ে আসা তীব্র জনস্রোতে পুরো এলাকায় রীতিমত মহাসমাবেশে রূপ নেয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর ১৫টি নির্বাচনী এলাকা থেকে দলের সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে বিশাল বিশাল দৃষ্টিনন্দন র‌্যালি সবার দৃষ্টি কাড়ে। এসব বর্ণাঢ্য র‌্যালিতে রং-বেরঙের বেলুন, ব্যানার, প্লাকার্ড, ফেস্টুন, ট্রাক, হাতি, ঘোড়ার গাড়ি, নৌকা, দলীয় ও জাতীয় পতাকা, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বিশাল বিশাল প্রতিকৃতিসহ বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে ব্যান্ডের তালে তালে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থক ছাড়াও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নগরীর আপামর জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। তবে সুবিশাল এ বিজয় র‌্যালির কারণে রাজধানীতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের। যানজটের কারণে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনায় যাওয়ার পথে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, হাইকমিশনার এবং সরকারের মন্ত্রী-এমপিদেরও যানজটের কবলে পড়তে হয়।
×