ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘গামছা-ট্র্যাজেডি’!

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭

‘গামছা-ট্র্যাজেডি’!

২৬ মে, বৃহস্পতিবার, ২০১১। বহুদিন পর বেড়াতে গিয়েছি গ্রামের বাড়ি পুরান বাউশিয়ায় (মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানা)। মূল উদ্দেশ্যÑ আম দিয়ে পেটপূজো করা। সকালে বাড়ি এসেছি। গ্রাম ঘুরেছি ঘণ্টাতিনেক। এখন দ্বিপ্রহর। শখ হলো নদীতে গিয়ে স্নান করার। গেলাম। গিয়ে দেখি ঘাটে সাত-আটজন ১০/১২ বছরের বালক সাঁতার কাটছে ও মনের আনন্দে পানিতে দাপাদাপি করছে। তাদের দেখে শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে ভাল করে নষ্টালজিয়ার আক্রান্ত হবারও সময় পেলাম না; কানে এল ওই ‘বিচ্ছু’ প্রকৃতির বালকগুলোর দুষ্টুমিমাখা উচ্চারণ, ‘দেখছস্, ওই শহুরাইরা ব্যাডা মনে হয় হাতর (সাঁতার) পারে না। ডরের চোডে হাডু (হাঁটু) পানির মইধ্যে খাড়ইয়া রইছে!’ ফোঁকলা দাঁতের অধিকারী (নাক দিয়ে আবার ‘ঘি’ ঝরছে!) একজন বললো, ‘হ। এত বড় দামড়া ব্যাডা হাতর জানে না!’ হি-হি করে হাসিতে লুটোপুটি খেতে লাগলো দুষ্ট ছেলের দল। খুব মজা পেলাম ওদের কথা শুনে। ঠিক করলাম ওদের খানিকটা লজ্জা উপহার দেয়া যাক। সাঁতরে নদীর কিছুদূর গিয়ে আবার ফেরত আসলাম। কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখি, ওরা হাঁ করে অবাক বিস্ময়ে আমার ‘সন্তরণ প্রক্রিয়া’ অবলোকন করছে। ওদের উদ্দেশ্য হাঁক ছাড়লাম, ‘আমি কিন্তু হাতর জানি না!’ ওরা নিশ্চুপ। এবার আমার হাসার পালা। আমি অবশ্য সাঁতার গ্রামে শিখিনি। শিখেছি পলাশের ওয়াপদার পুকুরে (নরসিংদীর ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে, বাবার চাকরিস্থলের সুবাদে ওখানেই কাটিয়েছি উনিশ বছর)। আর আমাকে সাঁতার শিখেয়েছে আমার স্কুলজীবনের দুই বাল্যবন্ধু আনিবুর ও শরীফ। মাঝে মাঝে সেলফোনে এখনও ওদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। হঠাৎ মনে হল, ছোটবেলায় পানি দিয়ে ‘রংধনু’ বানানোর খেলা খেলতাম। সুযোগ যখন পেয়েছি, এখন আবার খেলি না কেন? দুষ্ট বালকদের ডাকলাম। ওরা এই খেলাটি জানে কিনা জিগ্যেস করলাম। ‘না।’ ‘শিখবা?’ ‘দেহান দেহি।’ মুখভর্তি পানি নিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ওপরের দিকে পানি সজোরে ‘ফু’ দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। ক্ষণিকের জন্য নজরে এল সূর্যের আলোয় চোখের সামনে ভেসে উঠেছে রংধনু! ছেলেগুলো গোছল ভুলে মহা উৎসাহে রংধনু তৈরিতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘাটে একজন মুরুব্বিও (অচেনা) গোছলে ব্যস্ত। একটু পর তিনি ডুব দিয়েই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে, আমার লুঙ্গি গেল কই!’ বলেই আবার ডুব দিলেন। কয়েক সেকেন্ড পরই মাথা তুলে আনন্দমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘পাইছি, পাইছি!’ এদিকে ব্যাপার দেখে হাসতে হাসতে এক অপরের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে বিচ্ছুরা। আর আমিও নিশ্চয়ই রামগুড়–ুরের ছানা নই! মনে পড়ল স্কুলজীবনের একটি মজার ঘটনা। নরসিংদীর ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয়ে (এ স্কুলেই টানা দশ বছর পড়েছি। আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর সময়টা এখানেই কেটেছে। আছে অনেক স্মৃতি। আমাদের বাংলা শিক্ষক শফিক স্যার একবার বনভোজনে গেছেন কক্সবাজারে (আমাদের সঙ্গে নয়, অন্য এক জুনিয়র ব্যাচের সঙ্গে)। সেখানে তিনি জন্ম দেন এক ‘গামছা ট্র্যাজেডি’র। তিনি সমুদ্র স্নান করতে নামেন কেবল একটা গামছা পরে! তারপরের ঘটনা অতিশয় হৃদয়বিদারক। প্রচ- এক ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। না, স্যারকে নয়; তার পরিধেয় গামছাকে! সেটা অনেক অনুসন্ধান করেও আর খুঁজে পেলেন না। ছাত্ররা সব স্নান শেষে তীরে উঠে গেলেও স্যার ওঠার নামই করলেন না। কোমর জলে দাঁড়িয়ে রইলেন পাংশুমুখে। একজন ছাত্রের সন্দেহ হলে তার জেরায় স্যার ঘটনা খুলে বলেন। তবে ব্যাপারটা কাউকে জানাতে মানা করেন। সেই সঙ্গে একটা লুঙ্গি বা হাফপ্যান্ট ম্যানেজ করতে বললেন। ছাত্রটি তাই করল। তবে মুশকিল হলো, লুঙ্গি নিয়ে তা স্যারকে দিতে জলে নামতেই স্যার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন, ‘খবরদার, আমার কাছে আসবি না। লুঙ্গি ছুুঁড়ে দে।’ ‘কিন্তু স্যার, বাতাস তো উল্টো দিকে বইছে। ছুঁড়ে ফেললে ওটা আপনার কাছে যাবে না। আপনার কাছে এসে দেই।’ ছাত্রটি লুঙ্গি নিয়ে যতই এগোয়, স্যার ততই পেছান। পেছাতে পেছাতে একেবারে গলাপানিতে!’ ভাগ্যিস, আজ স্যারের মতো কোন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি বলে সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। ফিরে দেখি দুপুরের ভাত প্রস্তুত। মা টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে বসে আছেন। খাওয়ার পর আবার আম চলে এলো। ওটাও যথারীতি চালান করে দিলাম উদরে। এরপরের ঘটনা আরেকদিন বলব। উল্লেখ্য, এই বিভাগে ২০১১ সালের ১ আগস্ট ‘আম্র ভক্ষণ অভিযান’ এবং ২০১১ সালের ৮ আগস্ট ‘আমার সেই অজপাড়াগাঁয়’ লেখা দুটি প্রকাশের পর এটি হচ্ছে ওই লেখাগুলোর ধারাবাহিকতায় তৃতীয় পর্ব। রুমেল খান
×