ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

সমস্যাকে সুযোগ হিসেবে দেখার মানসিকতা রাখ

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭

সমস্যাকে সুযোগ হিসেবে দেখার মানসিকতা রাখ

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতের মাঝে জনপ্রিয় এক নাম নাজিম উদ্দিন। যিনি চার্টার্ড সার্টিফাইড এ্যাকাউন্টেন্ট ও হায়ার এডুকেশন একাডেমির একজন সম্মানিত ফেলো। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি যুক্তরাজ্যের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং এসিসিএ‘র পরীক্ষকের পাশাপাশি দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘সিটিজেন এডভাইস বডি’তে একজন ট্রাস্টি ও ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একাডেমি ও এ্যাকাউন্টেন্ট পেশার বাইরে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম করে খুব অল্প বয়সেই বলা যায় শূন্য থেকে আজ যুক্তরাজ্যের মিলিয়নার ক্লাবে জায়গা করে নিয়েছেন নাজিম। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে জিতেছেন মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘Entreprenur of the year’ খেতাব। সম্প্রতি এই গুণী মানুষটি স্বল্পসময়ের জন্য এসেছিলেন বাংলাদেশে। মুখোমুখি হয়েছেন ডি-প্রজন্মের। সাক্ষাতকার নিয়েছেন সুমন্ত গুপ্ত ডি-প্রজন্ম : শুরুতেই আপনার কৈশোরের কথা জানতে চাই। নাজিম উদ্দিন : শৈশবে পারিবারিক সচ্ছলতা, সামাজিক প্রতিপত্তি ও অর্থনৈতিক প্রাচুর্যতার প্রতি আমার সহজাত প্রবণতা ছিল। সে লক্ষ্যেই বার বার নিজেকে তৈরি করেছি। বড় হওয়ার আকাক্সক্ষার কারণে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করতাম। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে সেই স্বপ্ন আমাকে আলোর দিশা দেখাত। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো আমাদের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের গড়পরতা শিক্ষা পদ্ধতি আমাকে হতাশ করে তুলত। তারপরও পরীক্ষার ফলাফলে মেধার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে যায়। মূলত উচ্চ মাধ্যমিকের পর প্রথম দেশের মায়া ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পা রাখা। সেই থেকে শুরু ... টিপু সুলতানের দেশ মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষ করি। দেশের মতো গৎবাঁধা শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষার প্রচলিত নিয়ম পদ্ধতি থেকে ভিন্ন ছিল সে পরিবেশ। যার ফলে বাংলাদেশী অনেক ছাত্র বছরের পর বছর কলেজের গন্ডি পেরোতে ব্যর্থ হয়। তবে আমি সৌভাগ্যবান। আমিই সম্ভবত প্রথম বাংলাদেশী যে প্রথমবারেই প্রথম বিভাগ নিয়ে পাস করে বের হয়েছি। ডি-প্রজন্ম : ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার গল্প শুনতে চায়। নাজিম উদ্দিন : ডিগ্রী পাসের পর চট্টগ্রাম ফিরে আসলাম। পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমার প্রয়াত বাবার ইচ্ছা আমি নতুন কোন ব্যবসায় যুক্ত হই। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তখন তার বেশ নামডাক। তিনি সব সময় নতুন ব্যবসার দিকে নজর দিয়েছেন। সব নতুন ক্ষেত্রে। আমাকেও তিনি নতুন ব্যবসার জন্য উৎসাহিত করেন। তবে সত্যি বলতে আমি তখনও প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল যৌথ বিনিয়োগে। আমার বাবা ও চাচা দু’জনে সেই যৌথ ব্যবসার মুনাফা পুনরায় ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে বরং ভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতেন আইডল ইনভেস্টমেন্টে মূলত জায়গা-জমিতে। ফলে নতুন ব্যবসা শুরুর পর্যাপ্ত মূলধন আমার হাতে ছিল না। সেই সঙ্গে ঝুঁকির বিষয়ও ছিল। আমি সময় অপচয় না করে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এমবিএ’র কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। পড়াশোনায় নিবিষ্ট হলাম। রেজাল্টও ভাল হলো। সে সুবাদে কোন রকম টিউশন ফি ছাড়াই এমবিএ শেষ করি। ভাল ফলাফলের প্রতিদান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে গোল্ড মেডেল প্রদান করে। এমবিএ শেষ বর্ষে থাকাকালীন একটি বিখ্যাত সফটওয়্যার ফার্মে চাকরি নিই। তবে ঢাকার ট্রাফিক, ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে বেশিদিন সে চাকরি ভাল লাগেনি। এক বন্ধুর পরামর্শে লন্ডন পাড়ি দিলাম। ভর্তি হলাম চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্সি কোর্সে। ডি-প্রজন্ম : আপনার অনুপ্রেরণার কথা বলুন। নাজিম উদ্দিন : আমার বাবাই ছিল আমার অনুপ্রেরণা। তিনি ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। সংসারের বড় ছেলে হওয়ার কারণে পরিবারের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, পড়াশোনা শেষ না করেই তার কর্মজীবনে ঢোকার গল্প আমাকে বেশি অনুপ্রাণিত করত। তিনি সর্বদা নিজের পরিবারকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া আমার মাতামহ ছিলেন তৎকালীন সমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। একটি ঐতিহাসিক ঘটনায় খুব অল্প বয়সে তিনি প্রাণ হারান । তিনি ছিলেন পেশায় একজন ডাক্তার । তবে আমার প্রতি মায়ের অগাধ আস্থা ও অবিচল বিশ্বাস আমাকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে। ডি-প্রজন্ম : বর্তমানের সাফল্য সম্পর্কে জানতে চাই। নাজিম উদ্দিন : আমি চার্টার্ড সার্টিফাইড এ্যাকাউন্টেন্ট ও হায়ার এডুকেশন একাডেমির একজন ফেলো। দীর্ঘ সময় ধরে আমি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও এক্সটারনাল এডমিনার হিসেবে কাজ করছি। একাডেমিক কাজের বাইরে আমি যুক্তরাজ্যের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান সিটিজেন এডভাইস বডিতে একজন ট্রাস্টি ও ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। একাডেমিক ও এ্যাকাউন্টেন্ট পেশার বাইরে আমি একজন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। আমি যুক্তরাজ্যের বেশকিছু কোম্পানির উল্লেখযোগ্য শেয়ারের অংশীদার। আমার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শত শত মানুষ করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী রয়েছে। ছাত্রাবস্থায় একাডেমিক সাফল্যের জন্য এমবিএ প্রোগ্রাম স্বর্ণপদক অর্জন করেছি। এ ছাড়া ব্যবসায়িক সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ঞযব টকইঈঈও আমাকে Entrepreneur of the Year” ঘোষণা করে। উক্ত অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ লর্ড, মিনিস্টার ও বহু এমপি উপস্থিত ছিলেন। ডি প্রজন্ম : একজন একাডেমিক ও এ্যাকাউন্টেন্ট হওয়ার পরও কেন ব্যবসায়ী হওয়ার বাসনা করলেন? নাজিম উদ্দিন : ব্যবসায়ী হওয়ার মনোবাসনা ছিল তাই পূর্ণ হলো। এ ছাড়া ব্যবসায়িক প্রশাসনে পড়াশোনার কারণে বিভিন্ন ব্যবসায়িক দিক, চিন্তা ও নতুন ধারণা সর্বদা মাথায় ঘুরপাক খেত। আমি মনে করি এ সবকিছুই একটি ধারাবাহিকতার ফসল। ডি-প্রজন্ম : বাংলাদেশের তরুণদের সম্পর্কে কিছু বলুন। সাধারণত আমরা ব্যবসাকে খুব ঝুঁকিপূর্ণ ভাবি বলেই সবার চাকরির প্রতি ঝোঁক। এ প্রবণতা ও আকৃষ্ট কেন? নাজিম উদ্দিন : আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো প্রাথমিক অবস্থায় ব্যবসার ঝুঁকির চেয়ে চাকরির চাকচিক্য তরুণদের বেশি প্রভাবিত করে। সম্ভবত এ কারণেই তরুণদের ব্যবসার প্রতি অনীহা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পারিবারিক ব্যবসার বাইরে কোন ব্যবসা কিংবা আইডিয়ার ব্যাপারে তরুণদের আগ্রহ কম। তবে পরিবর্তনশীল বিশ্বে এ পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। যুক্তরাজ্যে পড়তে আসা বহু তরুণের সঙ্গে আমার ব্যবসায়িক আইডিয়া নিয়ে আলোচনা হয়। তাদের নিত্যনতুন ধারনা আমাকে মুগ্ধ করে। ডি-প্রজন্ম : কোন্ পরিচয়ে নিজেকে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। নাজিম উদ্দিন : একজন উদ্যোক্তা কিংবা একাডেমিশিয়ানের পাশাপাশি আমার লেখালেখির প্রতি আগ্রহ রয়েছে। সম্প্রতি আমি আমার পরিবার, ফেলে আসা দিন ও চট্টগ্রামের সঙ্গে বিশ্বের আদি যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের যে ইতিহাস তাকে উপজীব্য করে একটি বই লিখছি। সে সুবাদে নিজেকে একজন লেখক, শিক্ষক ও ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করি। ডি-প্রজন্ম : ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন। নাজিম উদ্দিন : ভবিষ্যতে একটি স্পোর্টস ও ভোকেশনাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা আছে। যেখানে থাকবে পার্ক, খেলার মাঠ, জিম,ও চাষাবাদের জমি। যা শিশুদের সামাজিক, মানসিক ও আত্ত্বিক উন্নতি সাধন করবে। অর্জন করবে বৃত্তিমূলক ও সৃজনশীল দক্ষতা। এ ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। ডি প্রজন্ম : নতুন উদ্যোক্তাদের কি পরামর্শ দেবেন। নাজিম উদ্দিন : প্রতিটি সমস্যাকে কেবল সমস্যা নয় বরং সুযোগ হিসেবে দেখার মানসিকতা রাখতে হবে। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন আইডিয়া নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সব সময় প্রশ্ন করার মানসিকতা রাখতে হবে। যদি নিজের মনে কোন ধারণা পোষণ করেন তবে তার বাস্তবিক প্রয়োগ ছাড়া কখনই তা সঠিক বলে বিবেচনা করবেন না। একজন উদ্যোক্তার প্রধান কাজ সমস্যার সমাধান করা। তা ব্যক্তি, সমাজ কিংবা প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হতে পারে। সর্বদাই সমস্যার সমাধানে অভিষ্ট থাকা একজন উদ্যোক্তার মূল কাজ। উদ্যোক্তার জীবন কিছুটা অনিশ্চিত এখানে ঝুঁকি যেমন বেশি তেমনি প্রণোদনাও অনেক। তাই তরুণদের আহ্বান জানায় উদ্যোক্তা হোন ও সমাজের নানা সমস্যা নিয়ে কাজ করুন। ডি-প্রজন্ম : শত ব্যস্ততার মাঝে আমাদের সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। নাজিম উদ্দিন : আপনাকেও আপনাদের ডি-প্রজন্ম পরিবারকে ধন্যবাদ।
×