ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মোতাহার হোসেন

স্বপ্নজয়ী এক নেতার প্রয়াণ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৪ ডিসেম্বর ২০১৭

স্বপ্নজয়ী এক নেতার প্রয়াণ

আনিসুল হক রাজনীতিতে আসলেন, দেখলেন, জয় করলেন। তারপর অকস্মাৎ চলে গেলেন। তার এই আসা-যাওয়ার মাঝে নিজে স্বপ্ন দেখলেন, অন্যকেও স্বপ্ন দেখালেন। এই সঙ্গে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগালেন নগরবাসীকে। বহু বিশেষণে বিশেষায়িত হতে পারেন তিনি। তিনি ছিলেন একাধারে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক। মেয়র হিসেবে এই মানুষটি স্বপ্ন দেখেছেন নগর ও নগরবাসীকে নিয়ে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেল। তিনি রাজনীতির ধ্রুবতারা, কর্মে, মানবতায় উন্নয়নে, সংস্কারে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করলেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হওয়ার পর নগরীকে নিয়ে, নগরীর মানুষের সমস্যা সমাধানে স্বপ্ন দেখলেন, স্বপ্ন দেখালেন উন্নয়নের, সম্ভাবনার। নগরীকে নিয়ে, নগরবাসীর সমস্যা নিয়ে সেই স্বপ্ন বাস্তায়নের পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল। দৃশ্যমান হলো তার স্বপ্নের বুনন ও বাস্তবায়ন। তার কর্মজীবন এবং জীবনাচার ও স্বপ্ন দেখা এবং তা বাস্তবায়নের যে পথনির্দেশিকা রেখে গেলেন তা থেকে রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, মানবতাবাদী, উন্নয়নকর্মী নির্বিশেষে সকলের শিক্ষণীয় এবং অনুকরণ করার আছে অনেক কিছু। তিনি জীবন এবং কর্মকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন বলেই জীবনের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি কাজে এসেছে সফলতা। তিনি নিজেই কথা প্রসঙ্গে বলতেন, ‘জীবন হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র, প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই জীবন।’ সত্যিকার অর্থে তার যাপিত জীবনের প্রতিটি সময়ে, প্রতিটি কাজে প্রায় তিন বছরের মেয়রকালকে নিয়ে বর্ণনার অবকাশ আছে। বর্ণনাটা এ জন্যই যে, যারাই জনপ্রতিনিধি হবেন বা আছেন, যারা জনগণের কল্যাণ, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি নিয়ে ভাবেন, কাজ করেন তাদের কাছে এটি একদিকে শিক্ষণীয়, অন্যদিকে অনুকরণীয় এবং অনুসরণযোগ্য বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। ২০১৫ সালের এপ্রিলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ নেয়ার পর নাগরিকবান্ধব কিছু উদ্যোগ নেন আনিসুল হক। এর মধ্যে অন্যতম তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা থেকে ফার্মগেটের রেলগেট পর্যন্ত সড়ক থেকে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত। ওই বছরের ২৯ নবেম্বর অভিযানও চালানো হয়। তখন কিছু ট্রাক মালিক তাকে অবরুদ্ধ করে। তবে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদে তিনি সফল হন। পরে ওই সড়কটির আধুনিকায়ন করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। সড়কের আইল্যান্ডে লাগিয়েছেন দৃষ্টিনন্দন গাছ। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি এ সড়কটি কার পার্কিং ঘোষণা করেন আনিসুল হক। কাজের মান নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা ভুঁইফোড় ঠিকাদারদের প্রশ্রয় দিতেন না আনিসুল হক। সেসব ঠিকাদার বিভিন্ন সময় মেয়রের নানা জনবান্ধব কাজে বাধাও দিতেন। কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে পিছু হটেননি মেয়র। পেশাদার ঠিকাদার ছাড়া অন্যদের নগরভবনে ঘোরাঘুরি নিষিদ্ধ করেন তিনি। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর রাজধানীর কাওরান বাজার থেকে মহাখালী ও যাত্রাবাড়ীতে কাঁচাবাজার সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেন মেয়র। এজন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেন তিনি। ব্যবসায়ীরাও তার এ উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দেন। এ বছরের ১৮ মে নারীদের কেনাকাটার জন্য মহাখালীতে একটি উইমেনস হলিডে মার্কেট উদ্বোধন করেন আনিসুল হক। এর অংশ হিসেবে প্রত্যেক নারী উদ্যোক্তার জন্য কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা করে জামানতবিহীন ঋণের ব্যবস্থার ঘোষণা দেন তিনি। পরিচ্ছন্নতা কাজে গতি বাড়াতে কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেন ডিএনসিসি মেয়র। পরিচ্ছন্নতা কাজসহ অন্যান্য উন্নয়ন কাজ পরিদর্শনে তিনি প্রায়ই ভোরে, কখনও গভীর রাতে ঝটিকা অভিযানে বের হতেন। অনেক আগে সড়কে এলইডি বাতি সংযোজনের পরিকল্পনা করেছিলেন আনিসুল হক। এজন্য বড় একটি প্রকল্পও হাতে নেন। মেয়র হিসেবে আনিসুল হকের কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল আমিন বাজার থেকে শ্যামলী সড়ক পার্কিং ফ্রি ঘোষণা, হয়রানি রোধে ঠিকাদারদের বিল অফিসে পৌঁছে দেয়া, সড়কে সাড়ে চার হাজার আধুনিক বাস সার্ভিস চালু, ২২টি ইউলুপ নির্মাণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ৭২টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন স্থাপন, ২০ হাজার বিলবোর্ড উচ্ছেদ ও পরিকল্পিত বিলবোর্ড স্থাপন, সবুজায়নে ইকো-বাস সার্ভিস চালু, জলাবদ্ধতা নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ, প্রধান সড়কগুলো রিক্সামুক্ত করা, গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন, পাবলিক টয়লেট স্থাপন। আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকে টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন আনিসুল হক। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিটিভিতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে মুখোমুখি বসিয়ে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন তিনি। ব্যবসায়ী হিসেবেও আনিসুল হক ছিলেন সফল। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালে বিজিএমইএ-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ও ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সভাপতি নির্বাচিত হন। এ বছরের ২৯ জুলাই লন্ডনে যান আনিসুল হক। সেখানে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। সেরিব্রাল ভাসকুলাইটিসে (মস্তিষ্কের রক্তনালীর প্রদাহ) আক্রান্ত এই গুণীজনের জীবনাবসান হলো সেখানেই। ৩০ নবেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আনিসুল হক। এই অকাল প্রয়াণ কাজ দিয়ে তার ইতিহাস গড়ার স্বপ্নটা থমকে গেল। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনার পাশাপাশি প্রত্যাশা থাকবে নগরীকে নিয়ে, নগরীর মানুষকে নিয়ে তার অসমাপ্ত স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে। একই সঙ্গে দেশের আপামর মানুষের উন্নয়ন, ভাগ্য পরিবর্তনে যারা রাজনীতি করেন তাদের কাছে প্রয়াত আনিসুল হকের কর্ম, স্বপ্ন, স্বপ্ন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নিষ্ঠা, সততা, আন্তরিকতা, প্রতিশ্রুতিতে অটল এবং বিশ্বস্ত হয়ে এগোবেন ভবিষ্যতের পথে। তবেই এক স্বপ্নবাজ, প্রতিশ্রুতিশীল, জনবান্ধব প্রয়াত আনিসুল হকের আত্মা শান্তি পাবে। একই সঙ্গে দেশ, জাতি সমভাবে উপকৃত হবে। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×