ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ত্রৈমাসিক আর্থিক ঝুঁকি মূল্যায়ন রিপোর্ট

ব্যাংকবহির্ভূত বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা নাজুক ॥ ‘রেড’ জোনে ১২টি, ৩৩টির মধ্যে ২৯টিই সমস্যায়

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২২ নভেম্বর ২০১৭

ব্যাংকবহির্ভূত বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা নাজুক ॥ ‘রেড’ জোনে ১২টি, ৩৩টির মধ্যে ২৯টিই সমস্যায়

রহিম শেখ ॥ নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) বেশিরভাগের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। এ তালিকার ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৯টি সমস্যাগস্ত। এর মধ্যে ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ১৭ টি মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করছে। অর্থাৎ কোনভাবে টিকে আছে এসব প্রতিষ্ঠান। তবে সবচেয়ে ভাল অবস্থায় রয়েছে মাত্র ৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ত্রৈমাসিক আর্থিক ঝুঁকি মূল্যায়ন’ প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে। জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তদারকি করতে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে যারা ভাল করছে তাদেরকে গ্রিন জোনে, যারা মাঝারি মানের তাদেরকে ইয়েলো জোনে এবং যাদের অবস্থা খারাপ তাদেরকে রেড জোনে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপ সামলানোর সক্ষমতা পরীক্ষা বা স্ট্রেস টেস্টিং রেটিংয়ে ১৭টি প্রতিষ্ঠান ইয়েলো জোনে অবস্থান করছে। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা মাঝামাঝি অবস্থানে। মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভাল। আর ১২টি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা একেবারেই নাজুক। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের জুন ভিত্তিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রেড জোনে ছিল ১১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর ইয়েলো জোনে ছিল ১৮ প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া গ্রিন জোনে ছিল চারটি প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ নতুন প্রতিবেদনে রেড জোনে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা একটি বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেড জোনে থাকার অর্থ হলো, এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বড় ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছে। যা যে কোন মুহূর্তে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি করতে পারে। এসব কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ তদারক করার প্রয়োজন পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান বা স্প্রেড কমে যাওয়া, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়া, প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে না পারা এবং শেয়ারবাজারে দুর্বল পারফর্মেন্সের কারণেই এনবিএফআই খাতে দুর্বলতা বেড়েছে। তবে গ্রিন জোনে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা ও আর্থিক সক্ষমতা দুটোই বাড়ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের কারণ থাকলেও তা এখনও হতাশাজনক অবস্থানে যায়নি বলে মনে করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিএলএফসিএর চেয়ারম্যান ও ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টি রেড জোনে থাকা সুস্থতার লক্ষণ নয়। তবে আগামী প্রান্তিক পর্যন্ত হয়তো এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের সূচকে উন্নতি হবে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানই ঋণ বিতরণে সচেতন হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে নিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা কমার পেছনে স্প্রেড কমে যাওয়াটাও ভূমিকা রেখেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, তাদের কাঠামোগত দুর্বলতা। বাজারে কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী কিছু প্রতিষ্ঠানকে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে দেখা যাচ্ছে। বাকিগুলো তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না। কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী না হওয়ায় তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। তিনি বলেন, এজন্য ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিসর বাড়াতে হবে। লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও মনিটরিং বাড়াতে হবে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান খারাপ নয়। তবে যেগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ এবং দুর্নীতি ও লুটপাট বেশি হয়েছে, প্রয়োজনে সেগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি তিন মাস পর ফিন্যান্সিয়াল এ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৫ সাল শেষে ৩২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গ্রিন জোনে ছিল চারটি। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ১৮টি ইয়েলো ও ১০টি রেড জোনে ছিল। এরপর ২০১৬ সাল শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সূচকে কিছুটা উন্নতি হয়। তখন গ্রিন জোনে ছিল পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ২১টি প্রতিষ্ঠান ইয়েলো ও সাতটি প্রতিষ্ঠান রেড জোনে ছিল। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানেই ১১টি প্রতিষ্ঠান রেড জোনে চলে গেছে। গ্রিন জোন থেকে একটি প্রতিষ্ঠান কমে ৪-এ নেমে এসেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ইয়েলো জোনে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৮টি। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও আর্থিক স্বাস্থ্য বিবেচনায় গ্রিন, ইয়েলো ও রেড এ তিন শ্রেণীতে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সাত বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে সর্বনিম্ন নিট মুনাফা করে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। গত বছর দেশের ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান মোট নিট মুনাফা করেছে ৪৭০ কোটি টাকা। অথচ ২০১৫ সালেও ৯৭০ কোটি টাকার নিট মুনাফায় ছিল দেশের এনবিএফআই খাত। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে নিট মুনাফা ৫১ শতাংশের বেশি কমে গেছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা ও মুনাফায় উচ্চপ্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখলেও অন্য কয়েকটি কোম্পানির লোকসানের কারণে পুরো খাতটিই পিছিয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে ৪৩৬ কোটি টাকা নিট মুনাফা করে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে এ খাতের মুনাফা। ২০১০ সালে ৬১০ কোটি, ২০১১ সালে ৭০০ কোটি, ২০১২ সালে ৬১০ কোটি, ২০১৩ সালে ৮০০ কোটি, ২০১৫ সালে ৯৫০ কোটি টাকা নিট মুনাফায় ছিল দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। এরপর ২০১৫ সালে খাতটি ৯৭০ কোটি টাকা নিট মুনাফা করলেও ২০১৬ সালে তা ৪৭০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ২০১০ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের ইকুইটির বিপরীতে গড় আয় (আরওই) ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। কিন্তু ছয় বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সাল শেষে এ খাতের গড় আরওই ৪ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে তা ৪ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। একইভাবে ২০১০ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে সম্পদের বিপরীতে আয় (আরওএ) ছিল প্রায় ৩ শতাংশ। কিন্তু ২০১৬ সালে এ খাতের আরওই শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। মার্চ শেষে আরওই নেমেছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৬ সাল শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ২ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। অথচ এ সময়ে খাতটিতে ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হয়েছে। সে হিসেবে ২০১৬ সাল শেষে ৫৪০ কোটি টাকার সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে। গত বছর শেষে এ খাতের বিতরণকৃত ঋণের ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল খেলাপির খাতায়। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে খেলাপির হার বেড়ে ৮ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মার্চ শেষে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে কার্যরত ছিল ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে তিনটি সরকারী ও ২০টি বেসরকারী কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাকি ১০টি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাইসেন্স নিয়েছে। চলতি বছরে আরও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২৩টি বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। ২০১৬ সালে এর মধ্যে নয়টির মুনাফা কমেছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারের বাইরে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয় বলে জানা গেছে।
×