ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পরীক্ষার ভার

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২২ নভেম্বর ২০১৭

পরীক্ষার ভার

রবিবার থেকে শুরু হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রথম দিনেই অনুপস্থিত এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮৩ পরীক্ষার্থী। বলা দরকার, এই পরীক্ষায় যারা অংশ নিয়ে থাকে সেইসব কোমলমতি শিশুর বয়স দশ-এগারোর মধ্যে। এই বয়সে একটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে তাদের ওপর বাড়তি মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। শিক্ষা মানে শুধু অর্থকরী কাজ বা চাকরির জন্য কিছু সনদধারী তৈরি করা নয়, শিশুর ওপর শুধু বইয়ের বোঝা চাপিয়ে তাকে মানবিক গুণসম্পন্ন আদর্শ মানব রূপে গড়ে তোলাও অসম্ভব। রাশি রাশি হাসি আর মজার খেলার মধ্য দিয়ে শিশুর পাঠদান নিঃসন্দেহে সুফল বয়ে আনে। পরীক্ষার মতো চাপসম্পন্ন শৃঙ্খলা যে একটি শিশুর ওপর বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজকে আমরা যদি চিত্রকর, সঙ্গীতশিল্পী ও ফুটবল, ক্রিকেটের মতো খেলার সঙ্গে জড়িত সফল ব্যক্তিদের দিকে তাকাই এবং তাদের জীবনে বেড়ে ওঠা সম্পর্কে খোঁজখবর নিই, তাহলে আমরা দেখব তারা শৈশবকাল থেকেই এ ধরনের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাদের ঝোঁক ছিল এসব বিষয়েই। তাই কোন শিশুর কোন দিকে ঝোঁক এবং কিসে সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও আগ্রহ বোধ করে সেসব বিবেচনা করে তার শিক্ষাদান নির্ধারণ করা দরকার। শুধু শুধু পরীক্ষার বোঝা চাপালে শিশুর মানসিক বিকাশ রুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেই তার জীবন ব্যর্থÑ এমন ধারণাও অমূলক। ২০১৫ সালে বেসরকারী সংস্থার মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দেশের ৮৬ দশমিক ৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়েছে। আর ৭৮ শতাংশ সরকারী বিদ্যালয়ে কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক। পাসের হার বাড়াতে খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়ম হচ্ছে। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে লেখা এবং উত্তরপত্র মেলানোর জন্য শেষের ৪০ থেকে ৬০ মিনিট অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই পরীক্ষার জন্য প্রাইভেট পড়ার নির্ভরশীলতা বাড়ছে, পাঠ্যবইকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে গাইডবই। শিশুরা শেখার আনন্দ পেতে এবং সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক স্তরে এই পাবলিক পরীক্ষার ফল সুদূরপ্রসারী নয়, এতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনাও অসম্ভব। অসুস্থ প্রতিযোগিতা কখনোই একটি শিশুকে প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পারে না। প্রসঙ্গত শিশুমন কোমল, নরম মাটির সঙ্গে তার তুলনা চলে। নরম মাটিকে যে কোন রূপ দেয়া যায়, শিশুর মনের ওপর চাপ দিয়ে বা প্রভাব বিস্তার করেও তাকে অনাকাক্সিক্ষত রূপ দেয়া সম্ভব। তাই শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের প্রয়োজনে সুষ্ঠু শিক্ষা অপরিহার্য। আর সে কারণেই জ্ঞানী-গুণীরা সব ‘বড়’ মানুষ ও শিক্ষাবিদরা শিশুপুস্তক রচনা ও প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। যুগের সঙ্গে শিক্ষা উপকরণে যৌক্তিক পরিবর্তন আসাটা অস্বাভাবিক নয়, বরং সেটাই প্রত্যাশিত। তবে সে সবই হতে হবে সুবিবেচনাপ্রসূত এবং কল্যাণের জন্য। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাই তাদের ভবিষ্যত নির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখাই হচ্ছে তাৎপর্যপূর্ণ একটি কাজ। সেই কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য সব পক্ষের সক্রিয় সহযোগিতা জরুরী। অদরকারী পরীক্ষার ভার থেকে মুক্ত হয়ে শিশুরা আনন্দময় শিক্ষা অর্জনের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠুক- এটাই প্রত্যাশা।
×