ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বর

একুশ শতক ॥ কোটি বাংলাদেশী বিদেশে চিকিৎসা করাতে পারে না

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ১৯ নভেম্বর ২০১৭

একুশ শতক ॥ কোটি বাংলাদেশী বিদেশে চিকিৎসা করাতে পারে না

॥ এক ॥ থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক শহরের একটি চার তারকা হোটেলে বসে এই নিবন্ধটি লেখা শুরু“ করেছিলাম। শহরের সবচেয়ে অভিজাত সুশোভিত এলাকার এ্যাম্বাসিডর হোটেলটি আমার অনেক দিনের চেনা। এর আগে এখানে থেকেছিও বহুবার। তখন এর একটিমাত্র ভবন ছিল। একটু পুরানো ধাঁচের হোটেল। আমরা প্রচুর ডিসকাউন্ট পেতাম। বিমানের সঙ্গে চুক্তি ছিল। এখন চার তারকা হয়ে গেছে। নতুন টাওয়ার উইং চালু হয়েছে। সেখানে বসেই লিখছিলাম। ব্যাঙ্কক শহরটিও আমার অনেক চেনা। কলকাতা বা ব্যাঙ্কক এই দুটির যে কোন একটি আমার সফর তালিকার প্রথম বা দ্বিতীয় হবে। ব্যাঙ্কক শহরের প্রথম সফরটা ছিল ভয়াবহ। যেদিন এই শহরে প্রথম পা দিই সেদিন রাতে নাবিস্কো বিস্কুট খেয়ে থাকতে হয়েছিল। হোটেলটি ছিল চায়না টাউনে। তাতে কোন রেস্তরাঁ ছিল না। হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়েই দেখলাম সামনে একটি রেস্তরাঁ যাতে জীবন্ত কী যেন ঝুলছিল। গন্ধটা এত খারাপ ছিল যে, কোন রেস্তরাঁয় ঢুকে আর খাবার ইচ্ছা হয়নি। বরং বমি বমি লাগছিল। ফলে রাস্তা থেকে রুমে ফিরে এসে বিস্কুট খেয়ে নৈশভোজ সারতে হয়। জীবনে প্রথম বিদেশ যাই ভারতে। সেই একাত্তর সালে। তখন ভারতের ভেতরে যাইনি। কেবল ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলাম। গারো পাহাড়ের পাদদেশে মুজিব বাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য যা যা করার দরকার সেটাই কেবল করেছিলাম। এরপর ১৯৭৬ সালে ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে পাসপোর্ট ভিসায় ভারতের কলকাতায় যাই। ভারতের পরই একই ট্রিপে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর আসি। তখন বিদেশ মানেই আমাদের বড় আকর্ষণ ছিল কেনাকাটা। কলকাতায় গেলে শাড়ি। আর ব্যাঙ্কক সিঙ্গাপুর গেলে গায়ে মাখা সাবান, টুথপেস্ট, গেঞ্জি, শ্যাম্পো, টিভি, টুইন ওয়ান ইত্যাদি। বস্তুত সবই বিদেশ থেকেই নিতে হতো। কম দামে সুতি কাপড় কেনার-বিশেষত গেঞ্জির জন্য ব্যাঙ্ককের সিলম রোডের ফুটপাথ আমার পছন্দের জায়গা ছিল। সিলম রোডের মেষ মাথার জুতার দোকানগুলোতে খুব ভাল চামড়ার জুতা পাওয়া যেত। ফুটপাথের ফলের দোকান ও হিমালী চাচার ভাতের দোকান বা রোজ গার্ডেন আমার অতি চেনা। সেন্ট্রাল স্টোরটা অনেক ভাল লাগত। রবিনসনও বেশ প্রিয় ছিল কেনাকাটার জন্য। লুম্পিনি পার্ক, কুমির খামার, থাই গ্রাম রোজ গার্ডেন, চাওফিয়া নৌভ্রমণ ও ভাসমান বাজারসহ দেশটার টুরিস্ট আকর্ষণগুলোও আমার দেখা। এক সময়ে বিনে পয়সায় আকাশপথের টিকেট পেতাম বলেও বেশি আসা হতো এই শহরে। এই শহরটি ঢাকার মতোই যানজটে বন্দী। তবে এর সবচেয়ে ভাল বিষয়টি হলো ওরা তাদের মাতৃভাষাকে অনেক সম্মান দেয়। পুরো শহরে এমন কোন তথ্য পাওয়া যাবে না, যা থাই ভাষায় লেখা নেই। কোথাও কোথাও, বিশেষত টুরিস্ট এলাকায় ইংরেজী থাকে বটে, তবে থাই নেই ইংরেজী আছে তেমনটা চোখে পড়বেই না। টুকটুক, ট্যাক্সি বা দোকানদাররা আকারে ইঙ্গিতে হলেও বিদেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এমনকি সেক্স ওয়ার্কারদেরও ইংরেজী জানা নেই। থাইরা ইংরেজী বলতে গেলে জানেই না। ইদানীং কিছুটা ইংরেজী চর্চা হয় তবে থাই ভাষার বিকল্প ইংরেজী নয়। কিন্তু এজন্য তাদের কোন হীনমন্যতা নেই। অবশ্য তাতে তাদের টুরিস্ট আসা থামেনি। এক সময়ে সেক্সট্রেডের জন্য এর সুনাম ছিল। ইউরোপীয় ও আরবরা সেক্সের জন্য এখানে আসত। এখনও আসে। তবে এতদিনে টুরিস্টদের আরও আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। এখন সেসব ছাপিয়ে তাদের অগ্রগতি সবারই নজরে পড়ে। এই শহরটি এখন চিকিৎসা সেবার একটি দারুণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ধনীরা সিঙ্গাপুরে বা লন্ডনে চিকিৎসা করে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ অনেক জনপ্রিয়। ব্যাঙ্ককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল বহুদিন ধরে ধনীদের পছন্দ। তবে এর পাশাপাশি ব্যাঙ্কক হাসপাতালও বেশ চেনা নাম। ঢাকায় এদের অফিসও আছে। হাসপাতালে হাঁটতে গেলে দু’চারজন বাংলাদেশীর সঙ্গে থাক্কা লাগবেই। সব সেন্টারের কোন না কোন রোগীর বাড়ি বাংলাদেশে। বোঝা যায় চিকিৎসার নামে বাংলাদেশের মানুষ বিপুল পরিমাণ টাকা এই দেশে ব্যয় করে। আমার নিজের ধারণা, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি লোক ভারতে যায় চিকিৎসার জন্য। এর পরই থাইল্যান্ডের স্থান। বেশি নয়, মাত্র বার তিনেক এই দেশটির সঙ্গে চিকিৎসার সম্পর্কটা নিজে দেখার সুযোগ হয়েছে। প্রথমে একবার আমার ছোট ভাই রাব্বানীর ছেলে রাতুলের চিকিৎসার জন্য বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে এসেছিলাম। হাসপাতালটিকে তখন পছন্দ হয়নি। একটি পাঁচ তারকা হোটেল বলে মনে হলেও ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে হতাশ হয়েছিলাম। আমার স্যার প্রয়াত ডঃ হুমায়ূন আজাদ তখন বামরুনগ্রাদে চিকিৎসারত ছিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। এরপর চিকিৎসার জন্য আমি নিজে আসি ১৩ মে ২০১১। তবে বামরুনগ্রাদে নয়, ব্যাঙ্কক হসপিটালে। দারুণ বিপদে পড়ে সেই আসা। ১১ সালের জানুয়ারির দিকে একদিন শীতের মাঝেও ঘেমে যাই। একটু অস্বস্তিবোধ আমাকে ভীত করে তোলে। আমাদের প্রধান নির্বাহী জেসমিন খুব দ্রুত বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানকার ইমার্জেন্সির ডাক্তাররা টেস্ট ও পরীক্ষা করে আশ্বস্ত করেন যে আমার কোন স্ট্রোক হয়নি। কিন্তু তারা আমাকে এই বিষয়ক পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেয়। সেটা করতে গিয়েই বিপদে পড়ি। আমাকে বলা হয় এনজিওগ্রাম করতে হবে এবং রিং পরানোর ব্যবস্থাও করতে হতে পারে। আমার এনজিওগ্রামের অভিজ্ঞতা ভাল ছিল না। এর আগে বিজয়ের মারও এনজিওগ্রাম করা হয়। অথচ তখন জানা যায় যে সেটির কোন দরকারই ছিল না। হৃদরোগের পরীক্ষা হিসেবে ইটিটি বা ইএসটির পর এনজিওগ্রামের কথা ভাবা হয়। কিন্তু আমাদের ডাক্তাররা সবার আগে এনজিওগ্রাম করে থাকেন। আমি সেই ভয়ে এনজিওগ্রাম করিনি। আমার বন্ধু কাফি আমাকে প্রথম পরামর্শ দেয় ব্যাঙ্কক যাওয়ার। ডাঃ রাপিন নামক একজনের সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আমাকে ব্যাঙ্কক নিয়ে যায়। রাপিন আমার সকল কাহিনী শুনে কিছু রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি ইটিটি করান। রিপোর্ট দেখে তিনি আমাকে হাঁটাহাঁটি ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দিলেন। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কখন বুঝব যে আমার হৃদয়ের অসুখ হয়েছে? তিনি সহজ করে আমাকে বোঝালেন, যেদিন এক কিলোমিটার হাঁটার পর আপনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন বা ছয় তলায় সিঁড়ি বেয়ে ওঠতে পারছেন না কিংবা বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করবেন তখন ডাক্তারের কাছে যাবেন। সাড়ে ছয় বছর পর আবার সেই রাপিনের কাছে গিয়েছি। রাপিন আবারও রক্ত পরীক্ষা করালেন। ইএসটি করালেন। বললেন, ডায়াবেটিসটা আরও একটু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমি মনে মনে বললাম ৩০ বছরের ডায়াবেটিস আর কত নিয়ন্ত্রণে রাখব! ১০ নবেম্বর ’১৭ ঢাকা থেকে মালয়েশীয় একটি আকাশযানে চড়ে কুয়ালালামপুরে পৌঁছাই। পরের দিন মনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে বিজয় জব্বারের স্নাতক সমাবর্তন ছিল। বহুদিন পর কুয়ালামপুর দেখে এক ধরনের মুগ্ধতা কাজ করছিল। সানওয়েতে ছেলের গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানটি ছিল চমকে দেয়ার মতো। যেটুকু চলাফেরা করলাম তাতে বোঝা গেল মাহাথির মাল্টিমিডিয়া সুপার করিডোর স্থাপন করে যে দেশটাকে ডিজিটাল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা এতদিনে পত্র-পুষ্পে পল্লবিত হয়ে ওঠেছে। গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ১২ নবেম্বর ’১৭ বিকেলে ব্যাঙ্ককে আসি। ১৫ নবেম্বর শহরটি ত্যাগ করার ইচ্ছা নিয়ে মাঝখানের দুটি দিন নিজের ও পরিবারের অন্যদের চেক আপ করার জন্য রেখে দিই। কাকতালীয়ভাবে আমার চেক আপের সঙ্গে পুত্র, স্ত্রী, কন্যা ও কন্যার জামাই এরও চেক আপ বা চিকিৎসার ব্যাপার জমা হয়েছিল। আমরা সবাই কোন না কোনভাবে ঢাকার অপচিকিৎসার শিকার। প্রথম দিনটা হাসপাতালে কাটিয়ে মাথায় প্রশ্নটি দেখা দেয় এভাবে একটি স্বাধীন দেশের স্বাস্থ্য সেবা কেমন করে চলতে পারে? এর জবাব জানা জরুরী। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বিশাল বিনিয়োগ ছাড়াও বেসরকারী খাতের বিকাশে আমরা স্বাস্থ্য সেবার কোন্ স্তরে আছি তার মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ৪০ বছর আগে যখন প্রথম দেশটিতে পা দিই তখন আমরা সকল দিক থেকেই সবার চেয়ে পিছিয়ে ছিলাম। থাইল্যান্ডও আমাদের মতো কৃষি প্রধান দেশ থেকে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছিল। তাদের অবকাঠামো বা সেবা কোনটাই আমাদের চাইতে ভাল ছিল না। বরং দেশটির কুখ্যাতি ছিল সেক্সট্রেডে নিমজ্জিত একটি দেশ হিসেবে। সেই দেশ এখন কেবল বাংলাদেশ নয়, আরব দেশসমূহ বা ইউরোপের চিকিৎসা কেন্দ্র হয়ে ওঠেছে। এমন কি ম্যাজিক ওদের আছে যা আমাদের নেই? ১৬ কোটি মানুষের দেশটা যখন মাত্র ৮ বছরে ৫০০ ডলারের মাথাপিছু আয়কে ১৬১০ ডলারে নিতে পেরেছে তখন তার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এমন ভঙ্গুর কেন? কেন আমাদের ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা লন্ডন যেতে হয় বেঁচে থাকার জন্য? চলবে...
×