ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ বিপন্ন মানবতার জয় হবেই

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১২ নভেম্বর ২০১৭

অভিমত ॥ বিপন্ন মানবতার জয় হবেই

জাতিগত সহিংসায় পুড়ছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষ। সামরিক জান্তার লালসার শিকার হয়ে নারী তার সম্ভ্রম হারাচ্ছে। প্রাণ রক্ষা আর পাশবিকতার হাত থেকে বাঁচতে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে শরণার্থীর ঢল নেমেছে বাংলাদেশ অভিমুখে। এর মধ্যে অনেক আদম সন্তানের সলিল সমাধি হয়েছে সাগরবক্ষে। লাশ হয়ে ভেসে উঠেছে বাংলাদেশের ডাঙ্গায়। মানবতার তাগিদে বাংলাদেশ আশ্রয় দিচ্ছে এই প্রাণে বাঁচা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে। ইতোমধ্যে শরণার্থীর সংখ্যা ৯ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মানবতার তাগিদে দেশের ষোলো কোটি মানুষ একবেলা অনাহারে থেকেও আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। আমাদের গর্বের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার লড়াই। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অতর্কিতে রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালীদের নিশ্চিহ্ন করতে। ‘ঙঢ়বৎধঃরড়হ ঝবধৎপয ষরমযঃ’-এর নামে অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশকে পোড়ামাটি করার মানসে হায়েনার দল আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাদের হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের তাণ্ডবে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। নির্বিচারে গণহত্যায় ৩০ লাখ বাঙালী প্রাণ হারাল হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে, ২ লাখ মা-বোন ধর্ষিত হলো হায়েনা দলের লালসার শিকার হয়ে। আমরাও তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাঁচাতে শরণার্থীর কাফেলায় শামিল হলাম। ঘোর অমানিশার অন্ধকার ভেদ করে অবশেষে আমরা ভারতে আশ্রয় নিলাম। এখানেও মানবতা জেগে ওঠে আপন শক্তিতে। ভারত আশ্রয় দিল বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে। কিন্তু এই ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের জোর কূটনৈতিক তৎপরতায় বিশ্ববিবেক দ্রুত জেগে ওঠে এবং স্বল্পকালের মধ্যেই শরণার্থীরা মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। ৯৩ হাজার পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এবারের এই মানবিক বিপর্যয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ উজাড় করে দিয়েছে। আশা করব বিশ্ববিবেকের জাগ্রত হওয়ার সময় আবার এসেছে ১৯৭১-এর মতো। দুর্গত মানুষের সাহায্যে বিভিন্ন দেশ ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ করছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পূর্ণ মর্যাদায় মিয়ানমারে নিজ ভূমে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে ভারত, আমেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এ ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ দিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৩ৎফ কমিটিতে ওআইসি প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ঈড়সসড়হবিধষঃয চধৎষরধসবহঃধৎু ধংংড়পরধঃরড়হ-এর সম্মেলনে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে সদস্যগণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের সর্বসম্মতিতে সভাপতির বিবৃতি অনুমোদন করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের এই অনুমোদন বাংলাদেশের এতদিনের কূটনৈতিক তৎপরতার একটি বড় বিজয় এবং বিশ্ববাসীর বিবেক জাগ্রত হওয়ার একটি আশাপ্রদ লক্ষণ। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অনুকূল বাতাস বইছে। ইতোমধ্যে রাজনীতি বিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি রোহিঙ্গা সমস্যা আলোচনা করে ঢাকা সফর করে গেছেন। এ মাসে মিয়ানমারে শুরু হতে যাওয়া আসেম সম্মেলনের পূর্বে চীন, জার্মানি, জাপানসহ চারটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ বাংলাদেশ সফর করবেন এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন। সরেজমিনে বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে শক্তিধর দেশের মন্ত্রীগণ আসেম সম্মেলনে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারবেন। চলমান এ সমস্ত অগ্রগতিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সফল কূটনীতির ফসল। চূড়ান্ত লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে বহুমাত্রিক কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। এমতাবস্থায়, এ যাবতকালের অর্জিত অগ্রগতি পর্যালোচনায় আশা করা যায়, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দীর্ঘকালের লালিত-পোষিত এই মানবসৃষ্ট সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হবেই। রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডির অবসান হবে। বিশ্ববিবেক আবার জেগে উঠেছে। মানবতার জয় অবশ্যম্ভাবী। লেখক : প্রাক্তন সরকারী কর্মকর্তা বিসিএস প্রশাসন [email protected]
×