ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্গতির সূচনা...

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১২ নভেম্বর ২০১৭

দুর্গতির সূচনা...

সাভারে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী ট্যানারির বর্জ্যে দূষণের শিকার হচ্ছে ধলেশ্বরী নদী। এক সময় বুড়িগঙ্গা নদীর মারাত্মক দূষণের কারণগুলোর অন্যতম ছিল হাজারীবাগের চামড়াশিল্প। এবার বুড়িগঙ্গার সেই দুর্ভাগ্য চেপেছে ধলেশ্বরীর ওপর। ঢাকা মহানগরের চারপাশের নদ-নদীগুলোর মধ্যে ধলেশ্বরীর অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত ভাল। টাঙ্গাইল, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলার প্রাণ হচ্ছে এ ধলেশ্বরী। কিন্তু এখন সাভারে স্থানান্তরিত চামড়াশিল্পের বর্জ্যরে কারণে প্রাণ প্রবাহ হারাচ্ছে ধলেশ্বরী? অথচ সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরী গড়ে তোলা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। এই পরিকল্পনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ওই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর চামড়াশিল্পের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব রোধ করা। সে জন্য চামড়া প্রক্রিয়াকরণ থেকে উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থ যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরিশোধন ও নিষ্কাশনের বাধ্যবাধকতাও আছে। এমনকি প্রতিটি চামড়া প্রক্রিয়াকরণ কারখানার নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করাও বাধ্যতামূলক। কথা ছিল পুরো শিল্পটির সমস্ত বর্জ্য পদার্থ সঠিকভাবে পরিশোধনের পর তার যথাযথ নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। শুধু ট্যানারিশিল্পই নয়, নদী তীর ঘেঁষা বিভিন্ন শিল্প-কারখানার বর্জ্যরে কারণেও ধলেশ্বরীর পানি দূষিত হচ্ছে। বলা যায়, নদীটির দুর্গতির সূচনা। জানা গেছে, সাভারে বিসিক প্রতিষ্ঠিত নতুন ট্যানারি পার্কের ৬৭টি ট্যানারি ফ্যাক্টরি থেকে প্রতিদিন ১২ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হচ্ছে। সেখানে চামড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাছের নদীর পানি দূষণও শুরু হয়ে গেছে। দিন দিন বাড়ছে এর মাত্রা। সাভারে ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধন প্ল্যান্ট বা সিইটিপি এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা চালু হওয়ার আগেই সেখানে বহু ট্যানারি চালু হয়ে গেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুযায়ী সিইটিপি থেকে বের হওয়া পানির তাপমাত্রা থাকা উচিত ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সিইটিপির ১০ মিটার উজানে তা ২৩ দশমিক ৫ হাজার ৫শ’ মিটারের মধ্যে ২৩ দশমিক ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস, ৩০ মিটার ভাটিতে ২৩ দশমিক ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস পাওয়া গেছে। সিইটিপির তিনটি পয়েন্টে গড়ে ২৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা পাওয়া গেছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে এর প্রাণিকণা ও উদ্ভিদকণা ধীরে ধীরে মরতে শুরু করে। নদীর প্রতিবেশ-ব্যবস্থার প্রাথমিক খাদ্য ওই দুই কণা পানিতে অক্সিজেনও ধরে রাখে। আর পানিতে ক্ষারের পরিমাণ বেড়ে গেলে মাছসহ অন্য প্রাণীদের দেহে পচন ধরে। এতে মাছের শরীরে প্রাথমিকভাবে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় এবং পর্যায়ক্রমে তারা মারা যেতে পারে। স্বাভাবিক পানিতে ক্ষারের পরিমাণ প্রতি লিটারে থাকার কথা ৬ থেকে ৯ মাত্রায়। ধলেশ্বরীতে পাওয়া গেছে ৮ থেকে ১১ দশমিক ৩৬ মাত্রার। যা শঙ্কিত হওয়ার মতো। এতে ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে। সরকার একটি সিইটিপি স্থাপন করেছে, সেটি নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে একটি চীনা কোম্পানিকে। কিন্তু সে কোম্পানি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না বলে ধলেশ্বরী নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। দূষণের কারণে ধলেশ্বরীর পানিতে একদিকে অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমেছে, অন্যদিকে ক্রোমিয়ামসহ সাত ধরনের জৈব-রাসায়নিক পদার্থের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়েছে। পরিবেশ অধিদফতরও ধলেশ্বরীকে দূষণ থেকে রক্ষার উদ্যোগ নেয়নি। আমরা আশা করি, হাজারীবাগ থেকে যে কারণে ট্যানারিগুলো সাভারে সরিয়ে নেয়া হলো, সে উদ্দেশ্য অর্থাৎ পরিবেশ দূষণ রোধ করা, যাতে ব্যর্থ না হয় সে জন্য সরকার অবিলম্বে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেবে। অন্যথায় ধলেশ্বরীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীও দূষণের শিকার হয়ে বুড়িগঙ্গার মতো করুণ পরিণতি বরণ করবে।
×