ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত

সরকারকে বিব্রত করতেই প্রশ্ন ফেসবুকে!

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১০ নভেম্বর ২০১৭

সরকারকে বিব্রত করতেই প্রশ্ন ফেসবুকে!

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে অব্যাহতভাবে প্রশ্ন ফাঁসকরা অপরাধী ‘নিলয়’ গ্রেফতার হয়েছে কদিন আগেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব প্রক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিটিআরসিকেও করা হয়েছে সক্রিয়, প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে প্রবেশ করার নিয়মও করা হয়েছে। কিন্তু এত পদক্ষেপেও কোন ফল হচ্ছে না। পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্ন চলে যাচ্ছে ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চলমান জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষাতেও একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। আবার সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নে নেয়া হয়েছে বৃহস্পতিবারের বিজ্ঞানের পরীক্ষা। শিক্ষাবিদরা বলছেন সরকারকে বিব্রত করতেই প্রশ্ন দেয়া হচ্ছে ফেসবুকে। ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। এদিকে এভাবে একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস করছে একটি গোষ্ঠী। অথচ মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষা বোর্ড এমনকি বিটিআরসিও কোন কুলকিনারা পাচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ছেড়ে দেয়ার ঘটনাকে কোন কেন্দ্রের ইচ্ছাকৃত অপকর্ম হিসেবেও অভিহিত করছেন কেউ কেউ। যদিও কিভাবে কোথা থেকে কি হচ্ছে কারও কাছেই কিছু স্পষ্ট নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই এখন পরিষ্কার চলমান জেএসসি ও জেডিসিতে একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে পরীক্ষা শুরুর আগেই। তবে অপরাধী ধরার বিষয়ে সরকারের সব কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ব্যর্থ। এ অবস্থায় বৃহস্পতিবারও ঘটেছে একই ঘটনা। এদিন ছিল সাধারণ বিজ্ঞান পরীক্ষা। তবে বুধবারই ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নের সেট ছড়িয়ে পড়ে। গণমাধ্যমের অনেকের কাছেও আসে প্রশ্ন। আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে আসল প্রশ্নের মিল আছে কিনা তা জানতে অপেক্ষা করতে হয় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। পরীক্ষা শেষে দেখা গেছে এবারো ঘটেছে একই ঘটনা। ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার অবশ্য বলছিলেন, তাদের কাছে প্রশ্ন ফাঁসের কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। তার পরেও যেসব অভিযোগ আমরা পাচ্ছি তা দ্রুত খতিয়ে দেখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট শাখাকে আমরা জানিয়েছি। তারাও যে কোন অপতৎপরতার সঙ্গে সক্রিয়দের ধরতে প্রস্তুত। কেউ কোন অপরাধ করলে আগের অপরাধীর মতোই ধরা পড়বে বলে আশা করছেন সরকারের এ কর্মকর্তা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, এটা সত্য যে ইতোপূর্বে এমন ঘটনা ঘটেছে। আমরা বিষয়টি অবগত আছি। গত কয়েক দিনের ঘটনার পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কড়া নজরদারির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বিতরণের কাজ করা হয়। পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে পাঠিয়েছি যাতে কেউ প্রশ্নপত্র বাইরে সরাতে না পারে। তার পরেও যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে আমাদের কী বা করার থাকে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। একটি মহল সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। আমরা অপরাধীদের ধরার জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিটিআরসিকে প্রতিনিয়ত তথ্য দেয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা। জানা গেছে, এর আগে বেশকিছু পাবলিক পরীক্ষার আগে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস করেছে নিলম নামে এক অপরাধী। আরও সক্রিয় ছিল বেশ কয়েকজন। পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে এরা ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে প্রশ্ন ছেড়ে দিত। এক পর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ উদ্যোগে সক্রিয় হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সফলও হয় তারা। ধরা পরে নিলয় নামের অপরাধীসহ বেশ কয়েকজন। গত এক বছরে অর্ধশত অপরাধী ধরা পড়েছে। এরপর এবারের জেএসসি পরীক্ষা নিয়ে মোটামুাট নিশ্চিন্তই ছিল সাধারণ মানুষ। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি পরীক্ষা সংক্রান্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বৈঠক বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। যেখানে বাহিনীর পক্ষ থেকে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে এবারের পরীক্ষা থেকেই কেন্দ্রে প্রবেশে নতুন নিয়ম কার্যকর করার ঘোষণা দেয়া হয়। বলা হয়, পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা এড়াতে ৩০ মিনিট আগে প্রত্যেককে কেন্দ্রে আসতে হবে। কোন ব্যক্তি এমনকি শিক্ষকরাও মোবাইল নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। কেবল কেন্দ্র সচিব একটি সাধারণ মোবাইল (স্পার্টফোন নয়) প্রয়োজনে সঙ্গে রাখতে পারবেন। প্রথমবারের মতো নিয়ম হওয়ায় পুরোপুরি কার্যকর না হলেও মোটামুটি সফলভাবেই নিয়ম কার্যকর করা হয়েছে। তবে যে উদ্দেশ্যে এত উদ্যোগ সেখানে সুফল পাওয়া গেছে কমই। এবারের পরীক্ষা শুরুর প্রথম দুদিন কোন অভিযোগ পাওয়া না গেলেও এরপর প্রতিদিনই অভিযোগ উঠছে থাকে। এক পর্যায়ে গত দু’তিন দিন হুবহু প্রশ্ন ফাঁসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসতে থাকে। আগে যেখানে নিলম নামে একজনের নাম আলোচনায় ছিল এবারের আইডিতে দেখা মিলেছে আরেক নাম। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘কেভিন পোলসেন’ নামধারী এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে আসে বিজ্ঞানের প্রশ্ন। মূল প্রশ্নের সঙ্গে এর হুবহু মিলও পাওয়া যায়। সকালে পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে রাজধানীর বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দেখা যায়। জিজ্ঞাসা করতেই তারা তা লুকিয়ে ফেলেন। পরীক্ষা শেষের কিছুক্ষণ পর অভিভাবকরা অনেকেই দাবি করেন, অনেকেই প্রশ্ন পেয়েছিলেন। তারা উত্তর খুঁজে তাদের সন্তানকে বলে দিয়েছেন পরীক্ষার আগে। একদিন আগে বুধবার অনুষ্ঠিত হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের পরীক্ষা। এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও পাওয়া গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্লোজ গ্রুপে। গত অন্তত তিন পরীক্ষায় পর পর শুরুর এক ঘণ্টা আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মূল প্রশ্নের ছবি তুলে হুবহু প্রশ্ন ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে বলছেন অভিভাবকরাই। জেএসসি পরীক্ষার ইংরেজী দ্বিতীয় পত্র, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার প্রশ্নপত্রও ফেসবুকে পাওয়া গেছে। সোমবার অনুষ্ঠিত হয় ইংরেজী দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। ওই পরীক্ষা শুরুর ৫৫ মিনিট আগে প্রশ্নপত্র পাওয়া যায় একটি ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরও ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপটি সক্রিয় দেখা যায়। তাতে বুধবার অনুষ্ঠেয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘোষণাও দেয়া হচ্ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে পরীক্ষা শুরুর ঠিক আগে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য শিক্ষকদের দায়ী করা হয়। পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন বের করার পর সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশ্ন বাইরে চলে আসতে পারে বলে তাদের ধারণা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও শিক্ষকদের হুঁশিয়ার করে আসছেন। জানা গেছে, বোর্ডের পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে দ্রুত বিষয়টি পরীক্ষাসংক্রান্ত আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে বিটিআরসিকে অবহিত করে এ্যাকশন নিতে। বোর্ড কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নের বান্ডিল খোলার পরই একটি চক্র মোবাইলে সেই প্রশ্নের ছবি তুলে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকার লেনদেনেরও প্রমাণ মিলছে না বরং ফেসবুকে ছেড়ে দিয়ে একটি চক্র সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চায় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু প্রশ্ন আসলে কোথা থেকে ফাঁস হচ্ছে তার একটা ধারণা পাচ্ছেন সরকারের কর্মকর্তারা। একই ধারণা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদেরও। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন যায় এক ঘণ্টা আগে। সেখান থেকেই বান্ডিল খোলার পর এটি কোন কেন্দ্র থেকে ফাঁস করা হয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে। কারণ মোবাইলে ছবি করে হুবহু প্রশ্ন দেয়া হচ্ছে বলেই প্রমাণ মিলেছে। শিক্ষাবিদরা অনেকে ফেসবুকে প্রশ্ন ছেড়ে দেয়ার ঘটনাকে একটি চক্রের ইচ্ছাকৃত অপকর্ম হিসেবে অভিহিত করেছেন। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর বলছিলেন, বিষয়টা আসলেই উদ্বেগজনক। ফেসবুকে দিয়ে দিলে টাকা পাওয়া যাবে না। তার পরেও সেখানে দেয়া হচ্ছে। এর কারণ হলো, সরকারকে হেয় করা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে হেয় করা। শিক্ষামন্ত্রীকে বিব্রত করা। না হয় প্রশ্ন বিক্রি করে টাকা আদায় করা হতো, প্রশ্ন এভাবে ফেসবুকে দেয়া হতো না।
×