ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৭ নভেম্বর ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

ঢাকায় কোন কোন রাতে তাপমাত্রা বাইশ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে আসতে দেখে যারা আগাম শীতবন্দনা শুরু করতে চাইছিলেন তারা বিরক্ত হলেন এ সপ্তাহে। দিনের বেলা আবার অসহ্য গরমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো ঢাকাবাসীর, তাপমাত্রা চড়ে গিয়েছিল তেত্রিশেরও ওপরে। অবশ্য রাতে নেমে আসতে শুরু করেছে কুড়ির কাছাকাছি। নবেম্বরে ঠান্ডা-গরমের এমন ওঠানামা কিছুটা অস্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যের জন্য সতর্কতামূলক। আবহাওয়ার তাপমাত্রা উর্ধমুখী হলে না হয় মেনে নেয় গেল, কিন্তু যাদের বিশেষ শ্রদ্ধা করে থাকে লোকে, সেই শিক্ষক সমাজের কারও কারও মেজাজ গরম হোক, আর একজন অন্যজনের সঙ্গে হাতাহাতিতে লিপ্ত হোক প্রকাশ্যে, এমনটা প্রত্যাশিত নয়। ঢাকায় এর আগে কি এমনটা ঘটেছে? গত বৃহস্পতিবার ওই দুঃখজনক ঘটনা ঘটল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ উচ্চ বিদ্যাপীঠ দেশের প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। রাজনীতি-সচেতনতা, গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং উচ্চমানের শিক্ষা-গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ঐতিহ্যের জন্য যার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গৌরব বোধ করতে পারেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক দিকনির্দেশনার অন্যতম কেন্দ্র, সুস্থ সংস্কৃতিচর্চারও অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে যদি মারামারির ঘটনা ঘটে তবে লজ্জার সীমা থাকে না। শিক্ষকদের মর্যাদা তারা নিজেরাই ভূলুণ্ঠিত করলে তা শুধু শিক্ষাঙ্গনের জন্য গ্লানিকর হয় না, সমাজেও তার সূক্ষ্ম নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শিক্ষার্থীরা যদি মৌন মানববন্ধন করে এ ঘটনায় লজ্জিত হয়ে, আর তাদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকেÑ ‘শ্রদ্ধেয় স্যারেরা আর নিচে নামবেন না’Ñ তাহলে তাদের কি দোষ দেয়া যাবে? ঢাকায় বিগত কয়েকটা দিন বহুল আলোচিত বিষয় ছিল দুটি জোড়া খুনের ঘটনা। দুটি ভিন্ন এলাকায় ওই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। বাবা-মেয়ের খুনের পেছনে নিহত ব্যক্তির স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক দায়ী। অন্যদিকে মা-ছেলের হত্যাকা-ের নেপথ্যে রয়েছে সম্পত্তির দখল-মানসিকতা। এখানে মানুষে মানুষের সম্পর্কের যেন কোন মূল্যই নেই! কোথায় সুস্থতা, কোথায় আদর্শ ও মূল্যবোধ? পাহাড়সমান এক আত্মপরতা মানুষকে ক্রমশ নিচের দিকে নামাচ্ছে। সমাজে উঁচু তলার মানুষের ভেতর যেমন এটি দেখা যাচ্ছে, তেমনি পরিশ্রমী নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষও সমধর্মী অপরাধী কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। আমরা চলেছি কোথায়? পারিবারিক মধুর বন্ধনগুলোয় ভাঙনের সূক্ষ্ম দংশন ক্রমশ নৃশংস পরিণতি ডেকে আনছে! বর্জ্যনগরীর ভবিষ্যত বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিকতা পেরিয়ে সড়কে নেমে গাড়ির জানালা খুলে এক প্রবাসী নিঃশেষিত পানির বোতল ছুঁড়ে মারলেন রাস্তায়। এই একই কাজ তিনি বিদেশের রাস্তায় নিশ্চয়ই করেন না। এখন কেউ যদি তার গাড়ি থামিয়ে সেই বোতলটি কুড়িয়ে তাকেই ফেরত দেয় এবং বলেÑ স্যার এটা নির্ধারিত বিনে ফেলুনÑ তবে কেমন হয়? যততত্র আবর্জনা ফেলার বাস্তবতা যেন দেশের প্রতিটি নগরীরই চিরচেনা দৃশ্য। তবু ঢাকার কথা বিশেষভাবেই বলতে হয়। পরিবেশ দূষণ, রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ ও নাগরিক অস্বস্তির মতো স্পর্শকাতর বিষয় মানুষ কিভাবে এড়িয়ে যেতে পারেন! রাজধানীর অনেক সড়কের ওপরই ভাগাড়খানা দেখা যায়। সোনারগাঁও হোটেলসংলগ্ন বিএফডিসির সামনের পুরো রাস্তাটিই যেন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাট, স্কুলমাঠ, পুকুরপাড়, অলিগলি, আবাসিক, বাণিজ্যিক এলাকাসহ এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে আবর্জনার স্তূপ নেই। মহানগরীর নদী এবং খালগুলোও আবর্জনায় সয়লাব হয়ে থাকে। আবর্জনার দুর্ভোগ সবচাইতে বেশি পোহাতে হয় নিঃসন্দেহে রাজধানীবাসীকেই। ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার টন ময়লা-আবর্জনা জমে। ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সর্বোচ্চ তিন হাজার টন ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করায় সমর্থ; বাকি চার হাজার টন রাস্তাঘাটেই ছড়িয়ে থাকে, খাল ও ড্রেনগুলোকে রুদ্ধ করে রাখে এবং দূষণ বাড়ায়। চিকিৎসকদের মতে, এসকল বজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই প্রাণঘাতী জীবাণুবাহী। ইতোমধ্যে খোলা ট্রাকে ময়লা-আবর্জনা পরিবহনে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেন হাইকোর্ট। দিনের বেলায় ময়লা অপসারণ না করারও নির্দেশ দিয়েছেন সিটি করপোরেশনকে। কিন্তু পরিস্থিতির কি উন্নতি হচ্ছে? নাগরিদেরও দায়িত্ব রয়েছে। নিজে সড়কে আবর্জনা না ফেলা এবং পরিবারের প্রতিদিনের বর্জ্য জড়ো করে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছে হস্তান্তরÑ এ দুটি কাজ যথাযথভাবে করলেই শহরকে অনেকটাই পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব। যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করলে ভবিষ্যতে ঢাকার ‘বর্জ্যনগরী’ বিশেষণ জুটতে পারে। ছুটির দিনে জাদুঘরে যাদুঘরে বিচিত্র দর্শনীয় বস্তুর সমাহার থাকে, সেসব দেখার জন্য দর্শনার্থীদেরও অভাব ঘটে না। বিশেষ করে ছুটির দিন শুক্রবারে বেশি লোক আসেন। ঢাকায় বিনোদনকেন্দ্রের অভাব রয়েছে, তাই যে কয়টি বিনোদন স্পট ও প্রদর্শনকেন্দ্র রয়েছে সবখানেই ছুটির দিনে ভিড় লক্ষ্য করা যায়। সিনেপ্লেক্সগুলো সম্মন্ধেও একই কথা বলা চলে। জাদুঘর প্রাঙ্গণে প্রবেশের পরপরই ফোন পেলাম বন্ধুদের কাছ থেকে। আলোচিত চলচ্চিত্র ‘ডুব’ দেখতে গেছেন ওরা, আমার জন্য টিকেট কাটবেন কিনা। মাত্র এসেছি শাহবাগে, যমুনা ফিউচার পার্কে যাওয়ার সময় কখন পাব, তার ঠিক নেই। যদি না যেতে পারি তাহলে টাকাটা গচ্চা যাবে। তাই বললাম, যদি যাই তাহলে নিজেই কেটে নেব টিকেট। পনেরো মিনিট পরে আবার ফোন। জানা গেল কাক্সিক্ষত সিনেমার টিকেট অনেক আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। লেখক হুমায়ূন আহমেদের জীবনের ছায়া রয়েছে ওই সিনেমায়। অনেকে এটাকে লেখকের বায়োপিক-ও বলছেন। ফেসবুকে কড়া সমালোচনামূলক পোস্টের ছড়াছড়ি সম্ভবত দর্শকদের আগ্রহ আরও বাড়িয়েছে, তাই ছুটির দিনে টিকেট পাওয়াই দুষ্কর। যা হোক, বলছিলাম জাদুঘরের কথা। একইসঙ্গে ভবনের আলাদা দুটি ফ্লোরে চলছে যথাক্রমে চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য এবং আলোকচিত্র প্রদর্শনী। আবার নিচ তলার মিলনায়তনে ছিল নির্ঝরের গান। চলচ্চিত্রকার স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর নিজের লেখা গান নিজেই সুর করেছেন। অনেক শ্রোতা আসন না পেয়ে দাঁড়িয়েই গান শুনলেন। ভাস্কর ও চিত্রকর হামিদুজ্জামান খানের শিল্পী-জীবনের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সৃজিত প্রতিনিধিত্বশীল ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মের সমাহার ঘটেছে জাদুঘরের প্রদর্শনীতে। শিল্পী নিয়মিতভাবেই প্রদর্শনশালায় উপস্থিত থাকছেন। দেশের অন্যতম প্রধান ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান। জলরং, তৈলচিত্রের পাশাপাশি নিয়মিত ভাস্কর্যশিল্পের চর্চা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের অনারারি এ অধ্যাপক ৫ দশকেরও বেশি সময় ধরে শিল্পচর্চা করছেন। প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিল্প সমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেন, ‘ঢাকা শহর কিভাবে গাছপালা-পাখাপাখালি আর পানি নিয়ে ক্রমাগত বেড়ে উঠছে, তার শৈল্পিক ধারণা পাওয়া যায় হামিদুজ্জামান খানের শিল্পকর্মে।’ কবি শামসুর রাহমানের আলোকচিত্র তোলায় একনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী ছিলেন আবু তাহের। এ বিষয়ে তিনি আলোকচিত্র এ্যালবামও করেছেন। জাদুঘরের প্রদর্শনীতে অবশ্য কবির লেখা বেশ কিছু গ্রন্থও প্রদর্শন করা হচ্ছে। ৮৫ বছরের যুবক শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের জন্মদিন ছিল শনিবার। সেদিন সন্ধ্যায় এ উপলক্ষে ‘ অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টস’ একটি আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মূলত তরুণ-প্রবীণ চিত্রশিল্পীরাই এতে যোগ দেন। আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না অনুষ্ঠানে। একজন নারী শিল্পী তাঁকে পঁচাশি বছরের যুবক হিসেবেই আখ্যায়িত করলেন। এই গ্যালারিতেই সামনের শনিবার শুরু হচ্ছে শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরের একক চিত্র প্রদর্শনী। শিল্পীকে পুষ্পিত শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শিল্পী মনিরুল ইসলাম, নিসার হোসেন, রোকেয়া সুলতানা, কণকচাঁপা চাকমা, শেখ আফজাল, মাহবুবুর রহমান, মাকসুদা ইকবাল নিপা প্রমুখ। শিল্পী-পরিবারের সদস্যরা তো ছিলেনই। বক্তাদের আলোচনায় উঠে এলো সজ্জন সপ্রতিভ পরোপকারী এক শিল্প-ব্যক্তিত্বের জীবনের বিভিন্ন দিক। বিশেষ করে শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর সূচনাযজ্ঞে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অবদান আলোচিত হলো। শিল্প-রসজ্ঞ সাবেক আমলা মঞ্জুর মুর্শেদের বক্তব্যে জানলাম অসুস্থ শিল্পী এস এম সুলতানকে সম্মানজনকভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদানে তাঁর ব্যতিক্রমী ভূমিকার কথাও। দু’জন খ্যাতিমান শিল্পী তাঁদের শিল্পমানস গঠনে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ভূমিকার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলেন। একজনের স্মৃতিচারণে উঠে এলো তাঁর বিদেশে আর্ট-স্কলারশিপের ব্যাপারে এই বর্ষীয়ান গুণী শিল্পীর বিশেষ উদ্যোগের বিষয়টি। গ্যালারির সিইও নীলু মুর্শেদের আন্তরিক উচ্চারণ ছিল হৃদয়স্পর্শী। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে সংবর্ধিত শিল্পী শিল্পে নিবেদিত গোটা জীবনের টুকরো টুকরো ছবি আঁকলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর স্বদেশে ফেরার স্মৃতিচারণ সবাই উৎকর্ণ হয়ে শুনলেন। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি ছিল শিল্পীর প্রতি সকৃতজ্ঞ ভালোবাসায় সিক্ত এক উপভোগ্য আয়োজন। নগরচিত্র ঢাকার গণপরিবহন সঙ্কট ও দুরবস্থা নিয়ে নানা সময়ে নানা কথা বলা হয়। দুদিন আগের নগরের একটি চিত্র (ছবি দেখুন) অনেককেই স্পর্শ করবে। ফেসবুকে ছবিটির শেয়ার দিয়ে এক বন্ধু লিখেছেন : ‘টেম্পো’ নামক বাহনের হ্যান্ডল কোনোমতে ধরে নতমুখে লোহার শিটে কপাল ঠেকিয়ে রাখা ক্লান্ত এ সিনিয়র সিটিজেনের ছবি সকালটিকে আজ এলোমেলো করে দিল। অন্য এক সিরিয়াস বিষয়ে স্ট্যাটাস দেব বলে ভাবছিলাম। এমন সময় ফেসবুকে শেখ দীন মোহাম্মদ সাহেবের এক ক্ষুব্ধ স্ট্যাটাসে পাই ছবিটি। এ মুহূর্তে এরচেয়ে সিরিয়াস বিষয় তো আর হয় না। কারও পুত্র, কারও হাসবেন্ড, কারও পিতা, কারও বন্ধু এ প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি এ মুহূর্তে সবচেয়ে আপনজন আমার। এত মরিয়া হয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন তিনি? দুর্নীতিলাঞ্ছিত এ দেশের কোন জায়গাটি ছিল তার গন্তব্য? একটু ভাল করে লাখ করলে বোঝা যায় টেম্পোর ভিতর থেকে একজন মহিলা বয়স্ক ব্যক্তিটির হাত ধরে আছেন। সেটি যেন আরও করুণ করে তুলেছে ছবিটিকে। দায়িত্ববোধ থেকেই হয়তো তিনি মরিয়া কোথাও যেতে, আর মমতায়ঘেরা ওই হাত তাকে ভরসা দিচ্ছে। যা এই সমাজ তাকে দিতে পারেনি।’ ৫ নবেম্বর ২০১৭ [email protected]
×