২৮ অক্টোবর ২০১৭-এর পত্রিকায় একটি মজার খবর ছিল। সৌদি আরব পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানুষ নয়, ‘সোফিয়া দ্য হিউম্যানয়েড’ নামক একটি রোবটকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। মার্কিন অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের মতো দেখতে রোবটটি সাক্ষাৎকারে বলেছে, পৃথিবীর প্রথম রোবট হিসেবে নাগরিকত্ব পেয়ে সে অত্যন্ত গর্বিত। আমরা পৃথিবীর বাসিন্দারাও নিঃসন্দেহে গর্বিত পৃথিবীতে নিত্য নতুন আবিষ্কার এবং পৃথিবীর এই এগিয়ে চলায়। সৌদি আরব নিশ্চয়ই গর্ব করবে যে, পৃথিবীতে তারাই রোবটকে প্রথম নাগরিকত্ব দিয়েছে। কিন্তু রোবটের মতো পরিশ্রম করেও কত হতভাগা শ্রমিক সেখানে একটি ‘আকামা’র (ডড়ৎশ চবৎসরঃ) জন্য হন্য হয়ে ঘুরছে, তার খবর কে রাখে? বলা হয়, ২০৫০ সালে পৃথিবী শাসন করবে রোবট। রোবট সোফিয়াকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সে পৃথিবীকে ধ্বংস করবে কিনা এবং উত্তরে তাকে না সূচক জবাব দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে বলেছিল, সে মানবজাতিকে ধ্বংস করবে। রোবটের এই কথা কি তামাশা ছিল, নাকি সত্যি বলেছিল, আমরা জানি না। কিন্তু এটা সত্যি জানি যে, সিরিয়ান জীবিত কুর্দি শিশু আইলাইনকে এই মহাপৃথিবী জায়গা দিতে পারেনি, মৃত আইলাইনকে সাগরে ভেসে থাকতে হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গােেদর নিজ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, অসংখ্য নর-নারী, বৃদ্ধ-শিশুকে নির্বিচারে কুপিয়ে, আগুন দিয়ে, গুলি করে মারা হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে অসংখ্য নারীকে, এমনকি কিশোরী বালিকাদের। কি আপসোস! সভ্যতার এ চরম শিখরে উঠে মানুষের এ কি অসভ্য ও বর্বর আচরণ! এমন উন্নয়ন চাই না, যে উন্নয়ন মানুষকে অমানুষ ও অমানবিক করে তোলে। তার চেয়ে দারিদ্র্য ঢের ভাল। কেন এই জাতি নিধন? একটাই কারণ মিয়ানমারের জাতীয় স্বার্থ এবং পার্শ্ববর্তী কোন কোন দেশের বাণিজ্যক স্বার্থ! ধিক্ এই বাণিজ্য, ধিক্ এই উর্ধমুখী প্রবণতা! অন্য জাতি-গোষ্ঠীর লাশের ওপর দিয়ে উর্ধমুখী আরোহণকে কি সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে মেনে নেয়া যায়? কিছুতেই না। বলতে দ্বিধা নেই যে, এই স্বার্থপরতা আজ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, ব্যবসা সর্বত্র বিষ বাষ্পের মতো, ক্যান্সারের মতো ছেয়ে গেছে। সমাজ থেকে এই বিষ বাষ্প দূর করতে না পারলে কি হবে তা ভবিতব্যই জানে। পত্রিকার পাতা খুললে আজকাল মা-বাবার হাতে ছেলেমেয়ে, ছেলেমেয়ের হাতে মা-বাবা, ভাইয়ের হাতে বোন, বোনের হাতে ভাইয়ের খুন হওয়ার মতো ঘটনা আমরা হরহামেশাই দেখি। কারণ কি? কারণ, আমরা দিন দিন আবেগশূন্য হয়ে যাচ্ছি। ডিজিটাল ডিভাইডেশনের কারণে এমনিতেই আমরা আলাদা হয়ে মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের সঙ্গে বেশি সখ্য করছি। মানুষের সঙ্গে সখ্য না করে করছি রোবটের সঙ্গে সখ্য!
সেদিন বাসে যাচ্ছিলাম। একজন লোক সাহায্য চাচ্ছে এই বলে যে, সে রিক্সা চালাতে গিয়ে এ্যাক্সিডেন্ট করে তার হাত ভেঙ্গে গেছে। দেখলাম কেউ তাকে সহযোগিতা করছে না, বরং রিক্সাওয়ালাদের যাত্রীকে জিম্মি করা এবং সুযোগ পেলেই বেশি ভাড়া আদায় করার ক্ষোভ ঝাড়ছে সবাই। একজন বলল, ‘সেদিন একটা স্কুল ড্রেস পরা ছোট মেয়েকে নিয়ে মা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে রিক্সার অপেক্ষায়। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাকে ডাকল মেয়েটির মা। কিন্তু রিক্সাওয়ালা যাবে না। এরই মধ্যে হঠাৎ করে বুঝে ওঠার আগেই প্রচ- বৃষ্টি নামলে মা আবার অনেক অনুনয়-বিনয় করল তাদের তোলার; কিন্তু রিক্সাওয়ালা কর্ণপাত করল না। আশপাশে দাঁড়ানোর কোন শেড না থাকায় মা-মেয়ে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল।’ এই ঘটনাটি কি কাম্য হওয়া উচিত? মোটেই উচিত না। এখানে শুধু রিক্সাওয়ালা না, আমরা প্রায় সবাই এরকম হয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু মনে রাখতে হবে একটি সুখী সমাজ গড়ার জন্য মানবিক গুণাবলী অপরিহার্য। তাই ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবসে’ স্মরণ করি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সেই ৬ বন্ধু যারা মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিয়ে ‘সন্ধানী’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঘটনাটা এরকম - ১৯৭৭ সালের প্রথম দিকে মোঃ ইদ্রিস আলী জানতে পারেন যে, তারই এক সহপাঠী আর্থিক প্রতিকূলতার কারণে সকালের নাস্তা না করে অভুক্ত অবস্থায় দুপুর ২টা পর্যন্ত ক্লাস করেন। তাকে ব্যাপারটি ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তিনি তার অন্য পাঁচ বন্ধুকে সকালে নাস্তার টেবিলে জানান। তারা এ নিয়ে কিছু একটা করতে ৬ বন্ধু একত্রিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের এনেক্স ভবনের কড়ই গাছের নিচে। তারা আলোচনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, একজন ৭ টাকা, বাকি ৫ জন ৫ টাকা করে জমিয়ে তাদের এ বন্ধুকে দিবেন। যেহেতু তাদের বন্ধু নাস্তার টাকা নিতে চাইবে না, তাই সবার টাকা জমা করে মোঃ ইদ্রিস আলীকে দেয়া হবে এবং তিনি সহপাঠীকে বুঝিয়ে টাকা হস্তান্তর করবেন। এই মাসিক ৩২ টাকা সহপাঠীকে সহযোগিতার মাধ্যমে ১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে সন্ধানী। প্রতিষ্ঠাতা ছয়জন তাদের কাজের সাংগঠনিক রূপ দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ‘সন্ধানী’ নামে এই সংগঠনের নামকরণ করেন। পরবর্তীতে তারা দেখেন যে, রক্তের অভাবে হাসপাতালে অনেক রোগী মারা যাচ্ছে। তারা চিন্তা করলেন সবাই একটু স্বপ্রণোদিত হয়ে রক্তদান করলেই তো অনেক জীবন বেঁচে যায়। তারা ১৯৭৮ সালের ২ নবেম্বর প্রথম স্বেচ্ছায় রক্তদান অনুষ্ঠান করলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। কালের আবর্তে এখন ২ নবেম্বর ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস।’ এ স্বীকৃতিতে আমরা সন্ধানীয়ানরা গর্বিত। এ স্বীকৃতি সকল মানবতাবাদীর হোক, এ গর্ব সকল সততা ও ন্যায্যতার হোক। আদর্শ, সততা, কল্যাণ ব্যাপারগুলো সমাজ থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলোকে ধরে রাখতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মানুষের উন্নতি হোক, পৃথিবী এগিয়ে যাক। কিন্তু সরলতা, ন্যায্যতা নষ্ট না হোক। ভাল মানুষ টিকে থাকলে পৃথিবী টিকে থাকবে। মানবতাকে পরাজিত করলে পৃথিবী পরাজিত হবে।
‘আমার চক্ষু, রক্তদান দেখবে ভুবন, বাঁচবে প্রাণ’ মানবতার সেবায় উজ্জীবিত হয়ে মানুষ মানুষকে ভালবেসে মরণোত্তর চক্ষুদান ও স্বেচ্ছায় রক্তদানে এগিয়ে আসুক।
লেখক : মহাসচিব, সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি