ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

স্ট্রোক ॥ কি, কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

স্ট্রোক ॥ কি, কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

আগামী ২৯ অক্টোবর পালিত হবে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘স্ট্রোক প্রতিরোধে আপনার কারণ কি?’ আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা আছে যে স্ট্রোক একটি হৃৎপিন্ডের রোগ। বাস্তবে এটি মোটেই সত্য নয়, স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালীর দুর্ঘটনাকেই স্ট্রোক বলা যায়। এ দুর্ঘটনায় রক্তনালী বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটেও যেতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। স্ট্রোক সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের রক্তনালীর জটিলতাজনিত রোগ। স্ট্রোকে আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ ভাগ মারা যায়, আর ৩০ ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা বেঁচে থেকেও দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি ৬ সেকেন্ডে একজন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। বছরে আক্রান্ত হচ্ছে ৬ কোটি এবং মারা যাচ্ছে ২ কোটি মানুষ। স্ট্রোকের কারণে দেড় কোটি লোক পঙ্গু হচ্ছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক যেমন ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা, একই সঙ্গে অনেক মানুষ হারাচ্ছে তাদের কর্মদক্ষতা, হচ্ছে প্রচুর অর্থ ব্যয়। সুতরাং স্ট্রোক জাতীয় ও বিশ্বজনীন সমস্যা। প্রতি ৬ জনে ১ জনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকে। স্ট্রোকে আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়েই চলছে। অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবেই এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দেশে এখন ১৫ থেকে ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী রয়েছে। প্রতি হাজারে গড়ে ৩ থেকে ৫ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন। সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার বেশি লক্ষ্য করা গেলেও যে কোন বয়সেই তা হতে পারে। ৫০ বছর বয়সের পর প্রতি ১০ বছরে স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। মহিলাদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার কম। ফাস্টফুডে আসক্তদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। শিশু ও তরুণদের অনেকে খাদ্যাভ্যাসের কারণে স্ট্রোক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন। স্ট্রোক কেন হয়? অনেক কারণেই স্ট্রোক হয়। যেমন- ১. অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ। ২. ধূমপান, তামাক পাতা, জর্দ্দা, মাদক সেবন। ৩. অতিরিক্ত টেনশন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তে বেশি মাত্রায় চর্বি। ৪. অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ। ৫. কিছু কিছু ওষুধ যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমিয়ে দেয় যেমন এ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রেল প্রভৃতি ব্যবহারে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ৬. ঘুমের সময় নাক ডাকা, ঘুমের সময় শ্বাসকষ্টজনিত উপসর্গ। ৭. যে কোন ধরনের প্রদাহ অথবা ইনফেকশন ও জন্মগতভাবে ব্রেনে কিংবা মস্তিষ্কে সরু রক্তনালী থাকা। ৮. অনেক সময় বংশানুক্রমে কিংবা পূর্বের স্ট্রোক, হার্ট এ্যাটাক ও দূরবর্তী রক্তনালী বন্ধ হওয়ার কারণেও স্ট্রোক হতে পারে। স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ ১. শরীরের কোথাও বা একাংশ অবশ ভাব লাগা কিংবা দুর্বলবোধ করা। ২. কথা বলার সমস্যা অর্থাৎ কিছুক্ষণের জন্য কথা জড়িয়ে যাওয়া, অস্পষ্ট হওয়া ও একেবারে কথা বলতে বা বুঝতে না পারা। ৩. এক চোখ বা দুই চোখেই ক্ষণস্থায়ী ঝাপসা দেখা বা একেবারেই না দেখা। ৪. মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ঘোরা, দৃষ্টি ঘোলা লাগা, হঠাৎ করে কিছুক্ষণের জন্য হতবিহবল হয়ে পড়া, বমি বমি বোধ অথবা বমি করা। ৫. পা দুইটিতে দুর্বল বোধ করা। ৬. স্ট্রোকের মারাত্মক উপসর্গ হচ্ছে অজ্ঞান হওয়া, খিচুনি, তীব্র মাথা ব্যথা ও বমি। স্ট্রোক হলে কি চিকিৎসা দিতে হবে ১. স্ট্রোক হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল। রোগীর উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। যদি খেতে না পারেন তবে নাকে নল দিয়ে খাবার ব্যবস্থা করা হয়। প্রস্রাব ও পায়খানা যাতে নিয়মিত হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রয়োজনে প্রস্রাবের রাস্তায় ক্যাথেটার দিতে হবে। চোখ, মুখ ও ত্বকের যত্ন নিতে হবে। বেডসোর প্রতিরোধ করার জন্য নিয়মিত পাশ ফেরাতে হবে। ২. উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ৩. পাশাপাশি অনেক স্ট্রোক রোগীর হার্টের রোগ থাকে। এসব ক্ষেত্রে কারডিওলজিস্টের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। ৪. অন্যান্য চিকিৎসা স্ট্রোকের ধরন অনুযায়ী করা হয়। যেমনÑ ইশকেমিক স্ট্রোকের বেলায় এসপিরিন, ক্লোপিডগ্রিল জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়। রক্তক্ষরণের কারণে স্ট্রোক হলে অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে। ৫. সকল হাসপাতালেই থাকা উচিত একটি স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট, যেখানে ডাক্তার, নার্স, থেরাপিস্ট এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সমম্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসা দেবেন। ৬. একজন স্ট্রোক রোগীর প্রয়োজন হয় নিউরোলজিস্ট এবং নিউরোসার্জনের। অনেক স্ট্রোক রোগীর অপারেশন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ৭. অনেক রোগীর শ্বাসকষ্ট, বেডসোর প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। সুতরাং রেসপিরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট, প্লাস্টিক সার্জনসহ সবার সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে। ৮. রোগীর অঙ্গ সঞ্চালন করে জড়তা কাটিয়ে তুলতে রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট প্রয়োজন হয়। ৯. রোগী কথা বলতে না পারলে প্রয়োজন স্পিচ থেরাপিস্টের। ১০. স্ট্রোক কেয়ার ইউনিট, সমম্বিত স্ট্রোক কেয়ার টিমের ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসায় আসবে সুফল, রোগী ও রোগীর স্বজন হবেন চিন্তামুক্ত, রোগী লাভ করবে আরোগ্য। কিভাবে আমরা এই ভয়াল দানবকে রুখে দাঁড়াতে পারি? যেভাবে প্রতিরোধ সম্ভব ‘স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য রোগ।’ স্ট্রোক ব্রেন বা মস্তিষ্কের কঠিন রোগ। ব্রেনের কোষগুলো একবার নষ্ট হলে পুনরায় পুরোপুরিভাবে কার্যকর হয় না অথবা জন্মায় না। ‘চিকিৎসার চেয়ে এই রোগ প্রতিরোধই উত্তম।’ এই রোগ মস্তিষ্কের রক্তনালী থেকে উদ্ভূত হয়। স্ট্রোক হলে অনেক সময় রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। এর জন্য সুনির্দিষ্ট ও জরুরী চিকিৎসা প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে কিংবা শহরে যে কোন হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব। ১. নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ২. ধূমপান, মদ্যপান, মাদক দ্রব্য, তামাক পাতা ও জর্দ্দা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ৩. হৃৎপি-ের রোগের চিকিৎসা, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ৪. চর্বি ও শর্করাযুক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফাস্টফুড, বাদাম, সন্দেশ-রসগোল্লা, দুধ-ঘি-পোলাও-বিরিয়ানি, পাঙাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া, গরু বা খাসির মাংস, নারিকেল বা নারিকেলযুক্ত খাবার ইত্যাদি কম খাওয়া উচিত। ৫. শাক-সবজি, অল্প ভাত, পাঙাশ-চিংড়ি-কাঁকড়া বাদে যে কোন মাছ, বাচ্চা মুরগি ও ডিম খেলে কোন ক্ষতি হয় না। ৬. নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। বাড়তি ওজন কমাতে হবে। স্ট্রোক অবশ্যই একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য। আক্রান্ত রোগী নিজে মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, পরিবারের জন্য অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ান। তাই প্রতিরোধ করাই সর্বোত্তম। লেখক : অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ ডিন, মেডিসিন অনুষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×