ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অনন্য সেনাবাহিনী জানিসারী

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অনন্য সেনাবাহিনী জানিসারী

তুরস্কের উসমানী (Ottoman) খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গাজী উসমান। এই উসমানের নামেই রাজত্বের নাম হয় উসমানী সালতানাত। জানিসারী বাহিনী ছিল এই সালতানাত বা খিলাফতের অত্যন্ত শক্তিধর সেনাবাহিনী। এই বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য সংগ্রহ করা হতো বসনিয়া, হারজেগোভিনাসহ তদানীন্তন বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে। জানিসারী বাহিনীর প্রবল প্রতাপে ইউরোপের সব খ্রীস্টান রাজা প্রতিক্ষণ সন্ত্রস্ত থাকত। ইসলামের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল দীর্ঘ অধ্যায় সংযোজিত হয়েছিল উসমানী আমলে। পারস্য উপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল, সমগ্র মিসর ইউরোপের কৃষ্ণসাগরের পশ্চিম তীর থেকে শুরু করে আদ্রিয়াতিক সাগরের পূর্ব তীর পর্যন্ত সমগ্র ভূখ-, এশিয়া মাইনর, আনাতোলিয়া এবং ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ, সমগ্র বলকান উপদ্বীপ বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, বসনিয়াসহ বিশাল অঞ্চল ছিল উসমানী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব খিলাফতের নিশানবাহী হিসেবে উসমানী খিলাফতকে খুবই সম্মান করত। এখানে উল্লেখ্য, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁর রফিকুল আলা আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর কাছে চলে যাওয়ার পরে তাঁর খলিফা হিসেবে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হু সর্বসস্মতিক্রমে প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করলে খলিফা হন হযরত উমর ফারুক রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হু। তাঁর দশ বছরের খিলাফত আমলে তদানীন্তন জানা পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চল খিলাফতের অধীন এসে যায়। ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে আততায়ীর ছুরিকাঘাতে তিনি শহীদ হলে খলিফা নির্বাচিত হন হযরত উসমান রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হু। ১২ বছরকাল তিনি খলিফা ছিলেন। তিনি শহীদ হলে খলিফা হন হযরত আলী করমুল্লাহ ওয়াজহাহু। হযরত আলী করমুল্লাহ্ ওয়াজহাহু মদিনা মনওয়ারা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন কুফায়। তিনিও খারেজি নামে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ কর্তৃক নিযুক্ত আবদুর রহমান ইবনে মলজুন নামের আততায়ীর তলোয়ারের আঘাতে কুফা মসজিদে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে তিন দিন পর শহীদ হন। কিছু দিন খিলাফত নিয়ে টানাপোড়েনের উদ্ভব ঘটে। অতঃপর সিনিয়র গবর্নর আমির মুআবিয়া রাদি আল্লাহ্ তা’আলা আন্হু খলিফার দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রাদেশিক রাজধানী দামেস্কে খিলাফতের রাজধানী স্থাপন করেন এবং উমাইয়া খিলাফতের পত্তন করেন। প্রায় ৯০ বছর উমাইয়া খিলাফত টিকে ছিল। তারপর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের চাচা হযরত আব্বাস রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হুর এক উত্তর পুরুষ আবুল আব্বাস আসসাফফার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি, রবিবার জাব নদীর তীরে সংঘটিত এক যুদ্ধে উমাইয়াদের পতন ঘটে এবং আব্বাসীয় খিলাফতের সূচনা হয়। আবুল আব্বাস সাময়িকভাবে রাজধানী স্থাপন করেন আনবাঁরায়। ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে আবুল আব্বাস ইন্তেকাল করলে তাঁর ভাই আবু জাফর আল মনসুর খলিফা হন। আল মনসুর দজলা নদীর তীরে বাগদাদ নগরীর পত্তন ঘটিয়ে এখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। বাগদাদ হয়ে ওঠে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সভ্যতা এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্রস্থল। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা হালাকু খাঁ কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংস হয়ে গেলে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব খলিফাশূন্য হয়ে পড়ে। অবশ্য পরে সদলবলে হালাকু খাঁ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ১২৬১ খ্রিস্টাব্দে মিসরের কায়রোতে আব্বাসীয় খলিফাদের রুহানী বা আধ্যাত্মিক প্রাধান্য নামেমাত্র পুনরুজ্জীবিত হলেও সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ খিলাফতী শাসন প্রতিষ্ঠার জোরদার কোন উদ্যোগ কিংবা প্রচেষ্টা বহুদিন অনুপস্থিত থেকেই যায়। বিক্ষিপ্তভাবে মুসলিম শাসনের বাতি প্রজ্বলিত থাকলেও খিলাফতের সেই শৌর্ষ-বীর্য, সমৃদ্ধি, ঐতিহ্য, সেই মহা ঐক্য, সংহতি, সমতা, সুশাসন ও সম্প্রীতির যে বাঁধভাঙ্গা জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে চরা পড়ে যায়। রাজ্যে রাজ্যে দিনকে দিন বিদ্রোহ ও অরাজকতা বাড়তেই থাকে। এই নৈরাস্য ও নৈরাজ্যকর পটভূমিতে গাজী উসমান নামক এক মহাবীরপুরুষ এবং মর্দে মুজাহিদ মুসলিম শক্তিকে নবউদ্দীপনায় ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আবির্ভূত হন। তিনি ইকনিয়ামের সেলজুক শেষ সুলতান দ্বিতীয় আলাউদ্দীন কায়কোবাদের সেনাপতি ছিলেন। জানা যায়, এই সুলতান দ্বিতীয় আলাউদ্দীন কায়কোবাদ চাঁদ-তারা খচিত পতাকা প্রবর্তন করেন। আজও তুরস্কের পতাকায় তা রয়েছে। সুলতান দ্বিতীয় আলাউদ্দীন কায়কোবাদের ইন্তেকালের পর সেনাপতি গাজী উসমান ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে সালতানাতের মসনদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি এক নতুন সালতানাতের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন, যা উসমানী সালতানাত নামে পরিচিত হলেও পরে উসমানী খিলাফত (Ottoman Caliphate) নামে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজীতে একে অটোমান এম্পায়ারও বলা হয়। খিলাফতের পরম্পরাগত ধারায় উসমানী খিলাফত মুসলিম জাহানের একতা, সংহতি ও শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে সবার কাছ থেকে সম্মান এবং স্বীকৃতি লাভ করে। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে গাজী সুলতানের উত্তরপুরুষ তুর্কী সুলতান প্রথম সেলিম মিসর জয় করেন। সমগ্র মিসর তুর্কিজ সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এই সময়ে মিসরে আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ তুর্কী সুলতান সেলিমকে মুবারকবাদ জানান এবং মুসলিম দুনিয়ার খিলাফত প্রদান করেন। সুলতান সেলিম খিলাফতের খিলাত ও খাস নিদর্শনস্বরূপ প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পিরহান মুবারক, ঝান্ডা, লাঠি, দান্দান মুবারক, পবিত্র কেশ এবং সীলমোহর খলিফা মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত হয়ে রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে আসেন এবং তা মর্যাদা ও যতেœর সঙ্গে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এসব পবিত্র নিদর্শনা আজও তুরস্কের তোপকাপী জাদুঘরে অতি যতেœর সঙ্গে সংরক্ষিত রয়েছে। সুলতান সেলিম (১৫১২-১৫২০) খিলাফতের খিলাত ও সনদ পেয়ে মক্কা মুকাররামার হেরেম শরীফ এবং মদিনা মনওয়ারার মসজিদুন নববীর হেরেম শরীফের খাদিম বা সেবক হিসেবে খাদিমুল হারামায়নিশ্ শরীফাইন লকব ধারণ করেন। ইতোমধ্যে উসমানী সালতানাত উসমানী খিলাফত হিসেবে পরিচিত হয়। ইসলামের ইতিহাসের খিলাফতের শেষ নিশান সমুন্নত রেখেছেন তুরস্কে স্থাপিত সালতানাত বা খিলাফতের মহান শাসকগণ; যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন : গাজী উসমান, ওরহান পঞ্চম মুরাদ, প্রথম বায়যীদ, প্রথম মাহমুদ, সুলায়মান, দ্বিতীয় মাহমুদ, দ্বিতীয় বায়যীদ এবং প্রথম সেলিম। উসমানী আমলে একটি দুুঃসাহসী, শক্তিশালী এবং ব্যতিক্রমী সৈন্যবাহিনী গঠিত হয় যা বিশ্বকে চমক লাগাতে সমর্থ হয়। এই বাহিনীর নাম জানিসারী। তুর্কী ভাষায় একে বলা হয় ইয়াকীচেরী বা ইয়ানীচেরী- যার অর্থ নবীন বাহিনী, আবার আরবী-ফারসী মিশ্রিত জানিসারী শব্দের অর্থ প্রাণ উৎসর্গকারী। (বাকী অংশ আগামী শুক্রবার) লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (স)
×