ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুষমার সফর ॥ বাংলাদেশ কী পেল -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ২৬ অক্টোবর ২০১৭

সুষমার সফর ॥ বাংলাদেশ কী পেল -স্বদেশ রায়

শেখ হাসিনা প্রায় একক দায়িত্বে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন। আশ্রয় দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে তিনি বিশ্বে নন্দিত হয়েছেন। এই নন্দিত হওয়াই একজন নেতার জন্য শেষ নয়। নেতা যে কারণে নন্দিত হন ওই কারণেই তাঁকে নিন্দিত হতে হয়েছে এমন নজির পৃথিবীতে বহু আছে। রোহিঙ্গা সমস্যার যদি সফল সমাধান শেখ হাসিনা না করতে পারেন, ইতিহাসের কোন এক জেনারেশন তাঁকে বন্দনা না করে তিরস্কারও করতে পারে। তাই শেখ হাসিনার কাঁধে এখন কঠিন দায়িত্ব, একদিকে যেমন রোহিঙ্গাদের প্রতিপালন করতে হবে, তারা যাতে স্থানীয়দের বিরাগভাজনের কারণ না হয়- সে জন্য দ্রুত বিছিন্ন একটি স্থানে তাদের নিতে হবে। আবার এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে এই সমস্যার সমাধান করে শেখ হাসিনা শুধু মানবিক নেত্রী নন, একজন কূটনৈতিকভাবে সফল নেত্রী হিসেবেও তাঁর নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। শেখ হাসিনা তাঁর এই কাজে বড় এক ধাপ এগিয়েছেন সুষমা স্বরাজের এবারের বাংলাদেশ সফরে। বাংলাদেশে দুই দিনেরও কম সময়ের ওয়ার্কিং ভিজিটে এসে সুষমা স্বরাজ সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলেছেন তা হলো- ‘মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে’। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক স্বার্থ অনেক- সেই সব স্বার্থ ঠিক রেখেও সুষমা স্বরাজ তার কঠোর অবস্থান জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়টি। সুষমা স্বরাজ সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তাই তাঁর এ কথার অর্থই হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্পর্কে এটাই ভারতের অফিসিয়াল বক্তব্য, ভারত এটাই চায়। কূটনৈতিক পথে শেখ হাসিনার এ মুহূর্তে দরকার ছিল রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে ভারতের কঠোর অবস্থান। শেখ হাসিনা তা আদায় করতে পেরেছেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনা যে কূটনীতিতে কোন সস্তা সেন্টিমেন্টের মূল্য দেন না, একজন প্রকৃত নির্মোহ রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্ত তিনি নেন তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে সোমবারের কেবিনেট মিটিংয়ের যে সংবাদ এসেছে পত্রপত্রিকায় সেখান থেকে। প্রাজ্ঞ অর্থমন্ত্রী মহোদয়ও যেখানে অনেকখানি বিরক্ত হয়ে বলেছেন, মিয়ানমার থেকে আমাদের চাল আনা বন্ধ করে দেয়া উচিত। সেখানে শেখ হাসিনা সবাইকে শান্ত হতে বলেছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে তাড়াহুড়ো না করার জন্য বলেছেন। কূটনীতিতে একটি সমস্যা রেখেও যে অন্যক্ষেত্রে বন্ধুত্ব চলে তাও সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সুষমা স্বরাজও বাংলাদেশে বসে মিয়ানমারকে সেই বার্তা দিয়েছেন। তাঁর কথার ভেতর দিয়ে তিনি মিয়ানমারকে জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত যেমন মিয়ানমারের সঙ্গে তার সকল রকম বাণিজ্যিক স্বার্থ ও সব ধরনের বন্ধুত্ব বজায় রাখবে তেমনি রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফেরত নিতেই হবে। এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান কঠোর এবং বাংলাদেশের সঙ্গে একই সমান্তরালে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথমেই এই সমর্থনটি প্রয়োজন ছিল। কারণ, এতদিন তাঁর কাজ ছিল, রোহিঙ্গারা যাতে প্রাণে মারা না যায়, কোনরূপ হঠকারিতা দেখিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ যেন মিয়ানমারের সঙ্গে কোন জটিল অবস্থানে জড়িয়ে না পড়ে। পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করা যে, বাংলাদেশের কোন ইসলামিক মৌলবাদী সংগঠন এমনকি তাদের আশ্রয়দাতা বিএনপিও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে কোন উত্তেজনাকর কাজ করার সুযোগ না পায়। প্রাথমিক কাজগুলো শেখ হাসিনা সফলভাবে করেছেন। এখন তাঁর সামনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দুটো কাজ প্রধান, এক তাদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশী সাহায্য যোগাড় করা- তারা যেন খাদ্য কষ্টে না পড়ে। আর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। এ কাজই কোন মতেই যুদ্ধ করে সম্ভব নয়- কূটনৈতিক পথেই সমাধান করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন বিশ্ব জনমত। সে জনমতের প্রথম ধাপেই প্রয়োজন ছিল প্রতিবেশী বড় দেশটির নিঃশর্ত সমর্থন। শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পাঠানোর জনমত গড়তে বিশ্ব সফরে না বেরিয়ে নিজ দেশে বসেই প্রতিবেশী বড় দেশটির সমর্থন আদায় করেছেন। বলা যেতে পারে শেখ হাসিনা বিশ্ব জনমত গড়ার কাজের একটি বড় অংশ শেষ করেছেন। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার পক্ষে শুধু ভারতের কঠোর অবস্থান আদায় করার ভেতর দিয়ে কীভাবে শেখ হাসিনা বড় অংশের কাজটি শেষ করলেন? বর্তমান বিশ্বের রাজনীতির হিসেব-নিকেষ যারা সব সময় লক্ষ্য করছেন তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, দক্ষিণ এশিয়ার এই মানবিক সমস্যাটির সমাধানের জন্য ভারতের সমর্থন পাওয়ার অর্থই হচ্ছে- দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতির হিসেব-নিকেষে আমেরিকা ও জাপানের সমর্থন পাওয়া। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতির কোন বিষয় নিয়ে যে মুহূর্তে ভারত-আমেরিকা ও জাপানকে বাংলাদেশের পক্ষে দেখা যাবে তখনই চীনকে যে কোন সিদ্ধান্ত দ্বিতীয় বারের জন্য ভাবতে হবে। কারণ, চীন যেমন তার মিয়ানমারের অর্থনৈতিক স্বার্থের দিকটি চিন্তা করবে তেমনি চীন অন্তত এ মুহূর্তে চাইবে না বাংলাদেশকে দূরে ঠেলে দিতে। চীনের কাছে ট্রানজিট কান্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেশি। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের যে সিটওয়েতে পুনর্বাসন করতে হবে এমন দাবি কিন্তু আসছে না। দাবি আসছে তাদের নিজ দেশে ফেরত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে চীন তার দেশের স্থানান্তরিত মানুষের জন্য যা করে মিয়ানমারেও সেটা করতে পারে। অর্থাৎ রাখাইনের কোন একটি এলাকায় আধুনিক বসতি গড়ে দিতে পারে। আর এ কাজে মিয়ানমার ও চীন বিশ্ব সম্প্রদায়ের অর্থাৎ অন্যান্য দেশের অর্থ সাহায্যও পাবে। সাধারণত রিফিউজিদের যখন নিজ দেশে পুনর্বাসন করতে হয় তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তাছাড়া চীন ও অন্যদের যে অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে গেছে সেখানে তাই এমন কোন নতুন সিদ্ধান্ত আসতেই পারে। যা হোক, সুষমার এই বক্তব্যের ভেতর দিয়ে ভারতের অবস্থান পরিষ্কার হওয়ায় ও দৃঢ় হওয়ায় মূলত কূটনৈতিকভাবে অনেকখানি এগিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। অর্থাৎ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে চলার পথটি পেল সুষমার এই সফরের ভেতর দিয়ে। এ ছাড়া দুই দেশের নদীর পানিসহ অনান্য উন্নয়ন বিষয়ক যে আলোচনাগুলো হয়েছে তা মূলত দুই দেশের যে ধারাবাহিক সহযোগিতা চলছে তার চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ আবারও তিস্তা পানি চুক্তির বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। সুষমা তেমন কোন কথা বলেননি এ বিষয়ে যা উল্লেখযোগ্য। অন্য দিকে কোন দেশে বিদেশী কোন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সরকার প্রধান বা রাষ্ট্র প্রধান এলে ওই দেশের বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করবেন এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচার। সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ দেখা করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে ভারতকে কঠোর অবস্থানে থাকার জন্য বলেছেন। পাশাপাশি তিস্তা পানি চুক্তির বিষয়টিও তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির মূল নেতা সাবেক সামরিক শাসক হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের থেকে তাঁদের সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের কথাবার্তা সব সময়েই যুক্তিপূর্ণ ও শালীন। তিনি কখনও কখনও সংসদে সবার থেকে সুন্দর বক্তব্যটি রাখেন এবং এ পর্যন্ত যত বিদেশী রাষ্ট্রের অতিথিদের সঙ্গে তিনি দেখা করেছেন সেখানে দেখা গেছে তিনি দেশের মর্যাদা রেখে কথা বলেছেন। জাতীয় পার্টি ও তাঁর নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যত কী তা এ মুহূর্তে সঠিকভাবে বলা কষ্টকর। তবে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন এরশাদ যে কথাবার্তা বলেন তা সত্যিই শোভন এবং অনেকের থেকে অনেক ভাল। সংসদে না থাকলেও তিন বাবের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া দেখা করেছেন সুষমা স্বরাজের সঙ্গে। পত্রপত্রিকার খবর, বেগম জিয়া সুষমাকে বলেছেন, বাংলাদেশে ভাল নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে ভারত যেন ভূমিকা রাখে। তাছাড়া জামায়াত- বিএনপি সমর্থক পত্রিকা প্রথম আলোর সংবাদে দেখা গেল, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছুটিতে গেছেন সে বিষয়ে তিনি সুষমা স্বরাজের কাছে নালিশ করেছেন, সরকার তাকে জোর করে ছুটিতে পাঠিয়েছে এমনটি বলে। পত্রপত্রিকার খবরেই জেনেছি, সুষমা স্বরাজ বেগম জিয়ার নির্বাচন বিষয়ক অনেকগুলো নালিশ শুধু শুনেছেন। তারপরে তিনি কূটনীতিক ভাষায় উত্তর দিয়েছেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে।’ বাংলাদেশে সবাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে। ২০১৪তে বেগম জিয়াকে নির্বাচনে আনার জন্যে শেখ হাসিনা নিজে ফোন করে আলোচনার জন্য দাওয়াতও দিয়েছিলেন। তিনি আসেননি। দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়ার জন্য মূলত দায়ী তিনি। এবারও তিনি নির্বাচনে আসবেন তার কোন গ্যারান্টি এখনও নেই। কারণ তাঁর নেতা গয়েশ্বর বলছেন, শেখ হাসিনার অধীনে তাঁরা কোন নির্বাচনে যাবে না। সুষমা স্বরাজের কাছে তত্ত্বাবধায়কের ধারণা তুলে ধরেছিলেন বেগম জিয়া- তবে সুষমা তা সমর্থন করেননি বলে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে। অন্য একটি বিষয় হলো, বেগম জিয়া প্রধান বিচারপতির ছুটির বিষয়টি কেন সুষমা স্বরাজকে জানাতে গেলেন? প্রধান বিচারপতি মণিপুরী হিন্দু বলে? তিনি কি মনে করেন, বিজেপি হিন্দুদের জন্য ভারতকে পরিচালনা করছে? তিনি যখন বাংলাদেশ পরিচালনা করেন তখন কি তিনি শুধু মুসলমানদের জন্য করেন? দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ভেতর নেয়া আর যাই হোক একজন তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শোভন নয়। তবে আমার ধারণা ভুল হতে পারে তিনি তাঁকে অন্যভাবে তাঁর সমগোত্রীয় ভেবেছেন, কারণ, তাঁর এবং তাঁর ছেলের নামে দুর্নীতির অভিযোগ, মি. সিনহার নামেও দুর্নীতির অভিযোগ। তাই তাঁরা নিজেদের একই গোত্রভুক্ত মনে করতে পারেন। [email protected]
×