ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাথাভারি আকার ধারণ করেছে জনপ্রশাসন

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

মাথাভারি আকার ধারণ করেছে জনপ্রশাসন

তপন বিশ্বাস ॥ পিরামিড আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে মাথাভারি আকার ধারণ করেছে জনপ্রশাসন। এতে ব্যাপকসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদায়ন করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইনসিটো করতে হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী পদ সৃষ্টি না করা, শূন্য পদের চেয়ে অধিকসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা শুধু প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষেত্রে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তার পদেও অতিরিক্ত পদোন্নতি দেয়া হয় না। এবার দাবি উঠেছে অন্যান্য ক্যাডারেও একইভাবে যোগ্যতা অজর্ন করলে পদোন্নতি দেয়ার। প্রশাসনের আকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব প্রতি ক্ষেত্রে পদের চেয়ে অনেক বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে পদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ কর্মকর্তা থাকারও নজির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে ৮৩৫ উপসিচব পদের বিপরীতে ১ হাজার ৫শ’ ৫২ কর্মকর্তা রয়েছেন। এছাড়া যুগ্ম-সচিবের ৪৩০ পদের বিপরীতে এখন কর্মকর্তার সংখ্যা ৭৯৮। অতিরিক্ত সচিবের ১২০টি পদের বিপরীতে বর্তমানে ৪৫৫ কর্মকর্তা রয়েছে। এতে অনেক অতিরিক্ত সচিব এখন যুগ্ম-সচিব এবং যুগ্ম-সচিব উপসিচবের দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক উপসচিবও সিনিয়র সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রশাসনের উপরের দিকে পদের চেয়ে ব্যাপকসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়ায় কাজের গতি শ্লথ হয়ে আসছে। বর্তমানে সিনিয়র সহকারী সচিবের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সচিবালয়সহ বিভিন্ন জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ শূন্য থাকছে। কর্মকর্তার অভাবে তা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন অফিসে উপসচিব দিয়ে সিনিয়র সহকারী সচিবের কাজ চালানো হচ্ছে। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে মুখে বলা হয় এক, আর কাজের বেলায় মেলে ভিন্ন চিত্র। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক যুগ্ম-সচিব জনকণ্ঠকে বলেন, স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এ ক্ষেত্রে বেঞ্চ নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। তা পূরণে শিক্ষাগত সনদের ভিত্তিতে নম্বর বণ্টন করা হয়ে থাকে। যদিও শিক্ষা সনদের নম্বর নির্ধারণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করার লক্ষ্যে। এছাড়া চাকরি জীবনের রেকর্ড পর্যবেক্ষণের সুযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক তথ্য পরিবেশন করা হয় না। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের তালিকা প্রদান করেন। এই তালিকা অনুমোদন করতে প্রয়োজনীয় সকল তথ্যও তারা সরবরাহ করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ওই তালিকা যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয় না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পছন্দের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে আসছেন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি একাধিকবার উপলব্ধি করেন পদোন্নতি দিতে গিয়ে। যে কারণে এখন পদোন্নতির ফাইল গেলে প্রধানমন্ত্রী তা দেখতে চান। আগে সঙ্গে সঙ্গে ফাইল অনুমোদন করার নজির থাকলেও এখন তা হচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে এক দুই সপ্তাহ পরে ফাইল অনুমোদন করেন। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে পদোন্নতি প্রদানের কারণে প্রশাসনের মাথাভারি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখনও সরকারকে উল্লেখযোগ্য কোন পরিকল্পনা দিতে পারেনি। দেশের সাড়ে ৭ কোটি লোকের প্রশাসন এখন ১৬ কোটি লোকের প্রশাসন হয়েছে। কিন্তু সে হারে পদ বাড়ানো হয়নি। বিশেষ প্রয়োজনে দুই-একটি পদ বাড়ানো হলেও চাহিদার তুলনায় তা অতি নগণ্য। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে আজও এ জাতীয় কোন প্রস্তাব পাঠানো হয়নি। এমনকি উদ্যোগও নেয়া হয়নি। অতীতে অপরিকল্পিতভাবে প্রশাসনে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হলেও পরবর্তীতে তা সমন্বয়ের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি। এদিকে প্রশাসন দলীয়করণ হওয়ায় কর্মকর্তাদের চাপে ব্যাপক হারে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। তাতে পিরামিড আকৃতির প্রশাসন এখন মালভূমির আকার ছাড়িয়ে মাথাভারি প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ে বেশি করে পদ সৃষ্টি করে সেখানে কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে শীর্ষ পর্যায়ে এবং মধ্যম পর্যায়ের পদও বাড়াতে হবে। সূত্র জানায়, বিসিএসের মোট ২৮টি ক্যাডারের মধ্যে ২৭টি ক্যাডার পদোন্নতি বঞ্চিত থাকছে বছরের পর বছর। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতাবান। এমনকি অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতির ক্ষমতাও এই ক্যাডারের হাতে। এছাড়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন এই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এমনকি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে তাদের অবাধ বিচরণ এবং গুরুতপূর্ণ বিভিন্ন পদে কর্মরত থাকেন। তারা সরকারের সঙ্গে যেভাবে দেন-দরবার করতে পারেন, অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তার কিছুই পারেন না। এ প্রসঙ্গে তথ্য ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলেন, আমাদেরও সকল যোগ্য কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে হবে। পদ না থাকলে আমরাও ইনসিটো থাকব। প্রশাসনের ক্ষেত্রে যদি হতে পারে তবে আমাদের ক্ষেত্রে কেন নয়? শিক্ষা ক্যাডারের এক নেতা বলেন, আমাদের ইনসিটো করা বেশি সহজ। এর জন্য আলাদা কোন চেয়ার বা বসার জায়গার প্রয়োজন হয় না।
×