ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লাস ভেগাসের লাশ!

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৬ অক্টোবর ২০১৭

লাস ভেগাসের লাশ!

যুক্তরাষ্ট্রের আনন্দ-ফুর্তির শহর লাস ভেগাসে এলোপাতাড়ি গুলিতে ৫৯ জনের মৃত্যুর পর প্রশ্ন উঠেছে কেন নির্বিচারে এই হামলা। কিন্তু মিলছে না সদুত্তর। ৬৪ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক কেন এই খুনের নেশায় মত্ত হয়েছিল তা এখনও অজানা তদন্তকারীর কাছে। ভয়ঙ্কর এই বন্দুকবাজির ঘটনা ১৯৪৯ সালের পর সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের হামলা এটাই প্রথম নয়, এর আগে গত বছরের ১২ জুন অরল্যান্ড শহরে সমকামীদের নৈশ ক্লাবের ভেতর একজন বন্দুকধারীর হামলায় ৪৯ জন নিহত হয়েছিল। দুটি ঘটনার পর আইএসের দাবি তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এবারের হামলার পর দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, হামলাকারী অসুস্থ ও মতিভ্রষ্ট ব্যক্তি। এই ভাষ্য খুনীকে রক্ষার কৌশল হতেই পারে। খুনীর পিতা ছিলেন একজন ব্যাংক ডাকাত। এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড দশজনের তালিকায় ছিল এই ডাকাত। আর খুনী সব নিয়মকানুন মেনেই অস্ত্র ও গুলি কিনেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক শ’জনের মধ্যে ৮৮ জনই বন্দুকের মালিক। বিশ্বে বেসামরিক লোকদের মালিকানায় যত বন্দুক রয়েছে তার প্রায় অর্ধেকই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে অথচ সে দেশে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগ। বন্দুকের ব্যক্তিগত মালিকানার দিক থেকে দেশটি বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে যত গোলাগুলির ঘটনা ঘটে তার প্রায় এগারো গুণ বেশি সংঘটিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বন্দুকের গুলিতে হত্যার ঘটনা ঘটে। বলা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব খুনের নেপথ্যে থাকে একজন মানুষ। প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত রাগ বা ক্ষোভ থেকে কিংবা মানসিক অবসাদগ্রস্ততা থেকে ঘটে এসব। লাস ভেগাসের অভাবিত হত্যাকা-টি ছিল চলতি বছরের ২৭৫ দিনে ২৭৩তম গণখুনের ঘটনা। এ সময়ে নিহত হয়েছে ১১ হাজার ৭শ’ জন। গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে যত খুন হয়েছে তার ৭৩ ভাগ মারা গেছে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে। প্রতিবছর গুলিবিদ্ধ হয় লাস ভেগাসের মানুষ। দেশটিতে ব্যক্তি মালিকানায় যত বন্দুক রয়েছে তার অর্ধেক শুধু তিনভাগ লোকের হাতে। ৭৭ লাখ মার্কিনীদের হাতে রয়েছে আটটি থেকে ১৪০টি বন্দুক। নারীদের মধ্যে ১২ ভাগের মালিকানায় রয়েছে বন্দুক। এতো খুন-খারাবির দেশে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তার কারণ অস্ত্র আইন। যে কোন মার্কিনই কিনতে পারে অস্ত্র। কোন কোন রাজ্যে এ আইন খুবই শিথিল। লাস ভেগাস যে রাজ্যে, সেই নেভাদাতে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ানো স্বাভাবিক বিষয়। অস্ত্র কেনার জন্যও প্রয়োজন হয় না নিবন্ধনের। বর্ণবাদী চেতনা থেকে নাগরিকদের আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই করা হয়েছিল আইনটি। কিন্তু অপরাধের রেকর্ড ও মানসিক অবস্থার বিচারে কেউ অস্ত্র কেনার উপযুক্ত কিনা তা সব সময় যথাযথভাবে যাচাইও হয় না। এমনিতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কারাবন্দী যুক্তরাষ্ট্রেÑ ২২ লাখ ৩৯ হাজার ৭শ’ ৫১ জন। অর্থাৎ প্রতি লাখে ৭১৬ জন। বন্দুকবাজি যুক্তরাষ্ট্র নামক দেশটির রীতি হিসেবেই পরিগণিত। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বারবার কথা ওঠে। কিন্তু সেসব বাতাসেই মিলিয়ে যায়। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে দেশটির সুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ একমত হলেও কার্যকর করা যায় না ন্যাশনাল রাইফেলস এ্যাসোসিয়েশনের কারণে। তাদের যুক্তি, অস্ত্র হাতে একজন খারাপ লোককে প্রতিরোধ করার সহজ উপায় ভাল লোকের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া। এই যুক্তির সমর্থক দেশের অধিকাংশ মানুষ। তবে তারাও চায় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ। ১৭৯১ সালে গৃহীত মার্কিন শাসনতন্ত্রে দেশটির নাগরিকদের অস্ত্র বহনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বন্দুকবাজদের নিয়ন্ত্রণের জন্য অস্ত্র আইনের রাশ টানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অস্ত্র উৎপাদক ও ব্যবসায়ী লবির কারণে তা করতে পারেননি। এর বিরোধিতা করেছিলেন ট্রাম্প, যিনি অস্ত্র রাখার অধিকারের কট্টর সমর্থক এবং এটা জনগণের মৌলিক অধিকার বলে মনে করেন। অস্ত্র বহনের অধিকারকে দেশটিতে পূতপবিত্র বলে মনে করা হয়। যে কারণে সন্ত্রাসী হিসেবে সরকারী তালিকাভুক্তরা যাতে অস্ত্র কিনতে না পারে সেজন্য ওবামার আনা প্রস্তাবও বিলীন হয়ে গেছে। নির্বাচনী প্রচারণাকালে ট্রাম্প বলেছিলেন ক্ষমতায় গিয়ে তিনি সাড়ে পাঁচ কোটি অস্ত্রধারীর অধিকার রক্ষা করবেন। সেই অধিকার রক্ষার ফল এখন যেন দাঁড়িয়েছে নির্বিচারে মানুষ হত্যা। সন্ত্রাসী হামলা সারাবিশ্বের জন্য উদ্বেগের কারণে পরিণত হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিনই ঘটছে খুন, সন্ত্রাস, অথচ রাষ্ট্র তা নিয়ন্ত্রণ করে না। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করা না হলে খুন-খারাবি অব্যাহত থাকাই স্বাভাবিক। লাস ভেগাসে ৫৯ জনের লাশ জানান দিল অস্ত্র বহনের মৌলিক অধিকার গণহত্যার ক্ষেত্রই প্রসারিত করছে। এ ধরনের হত্যাকা- বন্ধে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।
×