ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

দৃশ্যমান পদ্মা সেতু ॥ জাজিরা প্রান্তে বসানো হলো প্রথম স্প্যান

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১ অক্টোবর ২০১৭

দৃশ্যমান পদ্মা সেতু ॥ জাজিরা প্রান্তে বসানো হলো প্রথম স্প্যান

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল/আবুল বাশার, জাজিরা থেকে ॥ অবশেষে দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতু। শনিবার সকালে প্রথম স্প্যান (সুপার স্ট্রাকচার) খুঁটির (পিয়ার) ওপর স্থাপন করা হয়েছে। সকাল ৮টা থেকে শুরু করে ১০টার মধ্যেই পর্যন্ত সেতুটির জাজিরা প্রান্তের ৩৭ ও ৩৮নং খুঁটির ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৫০ মিটার দীর্ঘ এই স্প্যানটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর অগ্রগতির আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। এই মাহেন্দ্রক্ষণটিতে উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, সেতু সচিব আনোয়ারুল ইসলাম, সেতুটির প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম, পদ্মা সেতুর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, সেনাবাহিনীর জেনারেল আবু সাইদ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের কোম্পানির প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। পরে বেলা সোয়া ১১টায় সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পাশের সেতুর জাজিরা জেডিতে নেমে সাংবাদিকদের সার্বিক বিষয়ে ব্রিফিং করেন। মন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বাসনোর মধ্য দিয়ে আকাশে কালো মেঘ কেটে দৃশমান হয়েছে পদ্ম সেতু। সকল বাধা উপেক্ষা করে সেতুর কাজ এগিয়ে চলেছে। যথাসময়েই সেতুর কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে। এ পর্যন্ত পুরো সেতুর কাজ সাড়ে ৪৭ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এখন পর্যায়ক্রমে অন্য স্প্যানগুলোও উঠবে। মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে খুব শীঘ্রই এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। সেতুর কাজ যাতে এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ না থাকে সেই জন্য তাঁর নির্দেশে অনানুষ্ঠানিকভাবে সেতুর স্প্যান উঠানো হয়েছে। সেতু সচিব বলেন, অনেক ক্ষেত্রে পিয়ারের গভীরতা বৃদ্ধি বা প্রয়োজন অনুযায়ী তা পরিবর্তন করে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। তার মানে সেতুর ডিজাইনের পরিবর্তন নয়। এদিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়ার পর প্রকল্পস্থলে বিশেষ পরিবেশ বিরাজ করছে। এই সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আনন্দে উদ্বেল। এই দৃশ্য দেখার জন্য অনেকে পদ্মায় এলেও সেনাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তায় কেউ প্রবেশ করতে পারেনি। তবে দূর থেকেই অনেকে এই দৃশ্য অবলোকন করছে। পদ্মা সেতুর সুপার স্ট্রাকচারবাহী ‘তিয়ান ই হাউ’ জহাজের ৩৬শ’ টন ক্ষমতার ক্রেনের সঙ্গে এখনও স্প্যানটি বাঁধা রয়েছে। এটি বেয়ারিংয়ের সঙ্গে নাটবল্টু ভালভাবে স্থাপনের পরই ক্রেনটি সরিয়ে আনা হবে। এর আগে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরের মাওয়ার কুমারভোগ কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডের ওয়ার্কসপ থেকে রবিবার স্প্যানটি রওনা হয়। রাতে ২৩ নম্বর পিয়ারের কাছে এসে যাত্রাবিরতি করে। পরের সোমবার সকালে রওনা হয়ে দুপুরে এটি ৩০ ও ৩১ নম্বর পিয়ারের মাঝামাঝি স্থানে নোঙ্গর করে। পরে শুক্রবার দুপুর ২টায় জাহাজটি স্প্যান নিয়ে হাজির হয় ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি। সন্ধ্যার আগেই খুঁটি দুটির ঠিক এক মিটার ওপরে ঝুলিয়ে রাখে। পরে শনিবার সকাল ৮টায় এটি স্থাপন শুরু করে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, প্রথম স্প্যানটি স্থাপনের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্যান্য স্প্যানও উঠানো শুরু হবে। এখন ৩৭ থেকে ৪২ নম্বর পর্যন্ত ছয়টি পিয়ার এখন সম্পন্ন পর্যায়ে। শীঘ্রই শেষ হচ্ছে ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিয়ারের কাজ। ৩৮ পিয়ারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই দুই পিয়ার ধরে আরও দুটি স্প্যান বসবে শীঘ্রই। স্প্যানের মাঝ বরাবর নিচের লেনে চলবে ট্রেন। ওপরে কংক্রিটের চার লেনের সড়কে চলবে গাড়ি। তাই এই স্প্যানের ওপরে রাস্তা এবং নিচে ট্রেন লাইন স্থাপন করা হবে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় সাড়ে ৪৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সেতুতে মোট ৪২টি পিলার থাকবে। এর মধ্যে ৪০টি পিলার নির্মাণ করা হবে নদীতে। দুটি নদীর তীরে। নদীতে নির্মাণ করা প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে পাইলিং করা হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য গড়ে প্রায় ১২৭ মিটার পর্যন্ত। একটি পিয়ার থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে দুটি পিলারের ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। এছাড়া দু’পাড়ের সংযোগ সেতুসহ সেতুটি ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আগামী বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকৌশলীরা জানান, নদীতে মূল সেতুর মোট ২৪০টি পাইলের মধ্যে ৭৫টি পাইল বসেছে। এছাড়াও দু’পাড়ের দুটি ট্রান্সজিশন পিয়ারের ৩২টির মধ্যে ১৬টি স্থাপন হয়েছে। অর্থাৎ জাজিরা প্রান্তে ৪২ নম্বর পিয়ারের ট্রান্সজিশন পিলারের ১৬টি পাইল বসে গেছে। এখন বাকি মাওয়া প্রান্তের ১ নম্বর ট্রান্সজিশন পিয়ারের ১৬টি পাইল। এটির কাজ এখনও শুরু হয়নি। ডিজাইন চূড়ান্ত হচ্ছে। এছাড়া জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সেতুর ১৮৬টি পাইল বসেছে। এখানে আর মাত্র ৭টি পাইল বাকি সংযোগ সেতুর (ভয়াডাক্ট) জন্য। আর মাওয়ায় এ পর্যন্ত সংযোগ সেতুর ১৭২টির মধ্যে ৭টি পাইল বসেছে। পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান হচ্ছে ধূসর রঙে। তাই ধূসর রঙের ‘৭এ’ নম্বর স্প্যানটি বসার অল্প সময়ের পরই বসবে পরেরটি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ‘৭বি’ নম্বর স্প্যানটির ফিটিং সম্পন্ন রয়েছে। এটিও শীঘ্রই রং করা শুরু হবে। কারণ অক্টোবরের শেষ দিকে এ স্প্যানটি বসবে ৩৮ ও ৩৯ পিয়ারের। ইতোমধ্যেই ৩৯ নম্বর পিয়ারের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। শীঘ্রই শেষ হবে এর কাজ। পদ্মা সেতুর দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানান, দুটি হ্যামার এখন হরদম পাইল বসাচ্ছে। জাজিরা ও মাওয়া উভয় প্রান্তে পাইল বসেছে। আগামী নবেম্বর মাসের শেষদিকে আরেকটি হ্যামার জার্মানি থেকে আসছে মাওয়ায়। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, এই হ্যামারটি ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই পাইল স্থাপানের কাজে যোগ দিবে। পদ্মা সেতুর ৪২টি খুঁটিতে প্রয়োজন হবে ৪১টি স্প্যান। প্রথম স্প্যানটি (৭এ) স্থাপন হলেও মাওয়ার কুমারভোগ আরও ৯টি স্প্যান রয়েছে। এর মধ্যে ফিটিং হয়েছে ৭টি। এছাড়া আরও ১২টি স্প্যান চীনে তৈরি রয়েছে। এগুলো পর্যায়ক্রমে মাওয়া আনা হবে। এছাড়া বাকি আরও ১৯টি স্প্যানও তৈরির প্রক্রিয়া চলছে চীনে। শরীয়তপুরের জাজিরা পাড়ে ২টি পিলারের ওপর পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর খবরে বাপ-দাদার ভিটে মাটি হারানো পদ্মা পাড়ের লোকজনসহ শরীয়তপুরে বইছে আনন্দের বন্যা। পদ্মা সেতুর ২টি পিলারে প্রথম সুপার স্ট্রাকচার (স্প্যান) বসানো হবে এমন খবরে শনিবার ভোর থেকেই জাজিরার নাওডোবা এলাকায় পদ্মা পাড়ে লোকজনের ভিড় জমে। কিভাবে বসানো হবে, কারা এবং কেমনভাবে এটা বসাবে এ নিয়ে পদ্মা পাড়ে উপস্থিত সাধারণ লোকজনের মধ্যে ছিল নানা কৌতূহল। সেতুটির ৩৭ ও ৩৮নং পিলারের ওপর স্প্যানটি স্থাপনের পর এখন দেখা যাচ্ছে পদ্মা সেতুর কাঠামো। ধূসর রঙের পদ্মা সেতুর এই স্প্যানটি ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে এবং যা নদীর পানি থেকে এর উচ্চতা ৫০ ফুট। স্প্যানটি স্থাপনের কাজে ৩৬শ’ টনের ক্ষমতার স্ট্রাকচারবাহী তিয়ান ই-হাউ ক্রেনটি ব্যবহার করা হয়। খুঁটির ওপর বসানো স্টিলের তৈরি স্প্যানটির ওজন প্রায় ৩ হাজার ২শ’ টন। পদ্মা সেতুতে ৪২টি খুঁটির ওপর মোট এ রকম ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। এই স্প্যানটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতু। এখন সেতুর ১৫০ মিটার আকৃতি দৃশ্যমান হয়েছে। পুরো কাজ শেষ হলে এমন আকৃতি দেখা যাবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, পদ্মা সেতুর এই প্রথম স্প্যান বসানোর ক্ষেত্রে কোন আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। তবে সেতুর এই প্রথম স্প্যানটি স্থাপনের পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার অনুভূতি ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের বলেন, ওপারে যখন ঘন কুয়াশা, বিশ^ব্যাংক যখন পদ্মা সেতু ছেড়ে চলে যায়, সেদিন একটা অনিশ্চয়তার অন্ধকার ছিল, হতাশার মেঘ ছিল, অনেকে ভেবেছিলেন এই কুয়াশা কাটানো যাবে না। অনেকেই হয়ত ভেবেছিলেন পদ্মা সেতু আর হবে না। কিন্তু সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বীর কন্যা, দেশরত্ন শেখ হাসিনা সেদিন অসীম সাহসে সেদিনের মশাল হাতে নিয়েছিলেন। মহান আল্লাহর কাছে শোকরিয়া প্রকাশ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বের সোনালি ফসল আজকের এই দৃশ্যমান পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু এখন আর কোন রঙিন স্বপ্ন নয়। পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি ৪৯ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, স্প্যান যখন একটা বসে গেছে, আরও ৪০টি স্প্যান কয়েকদিন পর পর বসবে। যথা সময়ে আমরা পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করব। জানা গেছে, ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর মোট ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। প্রত্যেক পিলারে ৬টি করে পাইল সাজানো। স্প্যানের ভেতরে থাকছে রেলপথ ও ওপরে সড়ক পথ। দ্বিতল পদ্মা বহুমুখী সেতুর পুরোটা হবে স্টিল আর কংক্রিট স্ট্রাকচারে। সেতুর ওপরের তলায় থাকবে চার লেনের মহাসড়ক, নিচ দিয়ে যাবে রেললাইন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করে সেতুটি চালু হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
×