ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

সঙ্কট নিরসনে একাত্তরের ন্যায় ঐক্য দরকার

প্রকাশিত: ০২:২৯, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সঙ্কট নিরসনে একাত্তরের ন্যায় ঐক্য দরকার

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ মিয়ানমার একটি ভয়াবহ মানবিক যুদ্ধ বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। সরকারের উচিত হবে এখনই মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জন্য বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অস্বীকারকারী ‘রাষ্ট্রীয় নীতি’ সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাঁদেরকে নাগরিক অধিকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না দেয়া পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। তাই বাংলাদেশেকে দীর্ঘ মেয়াদি চিন্তা করতে হবে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষদের নিয়ে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। সঙ্কট নিরসনে তাই একাত্তরের ন্যায় ঐক্য প্রয়োজন। বৃহস্পতিবার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ৭১ মিলনায়তনে ‘রোহিঙ্গা সংকট: সমাধানের উপায় ও ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সারা পৃথিবী যখন রোহিঙ্গা সঙ্কট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একা এই সঙ্কট মোকাবেলা করায় প্রধানমন্ত্রীর সাহসের প্রশংসা করেন বক্তারা। বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন, রাষ্ট্রদূত এম. জমির ও মুন্সি ফায়েজ আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, ডিবিসি নিউজের প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম, আইওএমের সাবেক কান্ট্রি প্রধান আসিফ মুনির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম. শাহেদুজ্জামান এবং মানবাধিকারকর্মী সাইফুল হক অমি। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান। তিন ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠানে আলোচনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন বক্তারা। গত দুই হাজার বছরের ইতিহাসে পৃথিবীতে ৮/১০টি মর্মান্তিক ঘটনার মধ্যে রোহিঙ্গা সংকট অন্যতম উল্লেখ করে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বাংলাদেশের জনগণ মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এখন কূটনৈতিকভবে হোক আর রাজনৈতিকভাবে হোক, এ সমস্যার সমাধান করতে হয়। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই সঙ্কট নিরসনে একাত্তরের ন্যায় ঐক্য দরকার। তিনি বলেন, এই মূহূর্তে পৃথিবীতে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হচ্ছে অং সাং সূচি। পশ্চিমা স্বার্থে তাকে নোবেল দেয়া হয়েছে। পশ্চিমারাও জানত না যে, সূচি এতটা বর্বর হয়ে যাবে। এ সময় তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে সূচি ও সেদেশের সেনাবাহিনীর প্রধানের বিচারের দাবী জানান। ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিমানে অক্সিজেন সংকট হলে বলা হয়, প্রথমে আপনি নিজে অক্সিজেন নিন, তারপর আপনার সন্তানকে দিন। অর্থাৎ আমাদের নিজেদেরকে আগে বাঁচতে হবে। তিনি বলেন, খুব সহজে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এই মুহূর্তে আমাদের ঐক্য দরকার। রোহিঙ্গাদের অস্বীকারকারী যে রাষ্ট্রীয় নীতি সেটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। নাগরিক অধিকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না দেয়া পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। মিয়ানমারের শক্তি- সামর্থ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত হয়েই সরকারকে সামনে দিকে আগানোর পরামর্শ দেন তিনি। রোহিঙ্গা সমস্যা কঠিন মন্তব্য করে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার দুটি রূপ- বানের ¯্রােতের মতো রোহিঙ্গা আসছে, মিয়ানমারে তাদের থাকার অধিকার নেই। সুতরাং রোহিঙ্গাদের শুধু ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেই চলবে না, তারা যেন সেখানে পূর্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার নিয়ে ফিরে যেতে পারে এবং বসবাস করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের একার পক্ষে এ দুটি কাজ করা প্রায় অসম্ভব। এ জন্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এখনই মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির জন্য সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। মিয়ানমারের নেত্রী অং সাং সূচির সমালোচনা করে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. জমির বলেন, সূচি বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পাবলিক রিলেশন অফিসারে পরিণত হয়েছেন। সুতরাং তার কাছ থেকে সমস্যার সমাধান আশা করাটা বাতুলতা। গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই ঘটনা বিশে^ কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে সেটা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মুন্সি ফায়েজ আহমেদ বলেন, ভারত তাদের স্বার্থে যেকোনো অবস্থান নিতেই পারে। আমাদের সরকারের ভারতকে বোঝানো দরকার যে, এটি একটি মানবিক ইস্যু। ভারতের উচিত মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো। একইভাবে চীন ও রাশিয়াকে বোঝাতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, তারা যেন নিরাপদে থাকে সেটা নিশ্চিত করে তাদের ফেরত পাঠাতে হবে। এই সমস্যা মানবজাতির। সমস্যা সমাধানে কূটনীতিকে আরো জোরধার করতে হবে বলে এ সময় তিনি মত দেন। মিয়ানমার একটি মানবিক যুদ্ধ বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এই মন্তব্য করে সোহরাব হাসান বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ কখনো সীমান্ত পার হয়নি। এই যুদ্ধে আমাদেরকে জয়ী হতেই হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে হবে। আমরা যদি মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিকভবে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপের ব্যবস্থা করতে পারি তাহলেই এ সমস্যার আশু সমাধান হতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে বিশে^র শান্তিকামী মানুষদের নিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। বড় দেশগুলোর অবস্থান পরিবর্তন না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না বলে এ সময় তিনি উল্লেখ করেন। মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। সরকারের উচিত গণমাধ্যমে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা। সরকার এই মুহূর্তে তিনটি কাজ করতে পারে-জনমত তৈরি করা, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও তথ্যের সঠিক সরবরাহ নিশ্চিত করা, এ জন্য বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্মীদের অবাধ গমনের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভাবতে হবে উল্লেখ করে আসিফ মুনির বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য যে পরিবেশ তৈরি করতে হবে, সে কাজটি মোটেও সহজ নয়। এজন্য বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভাবতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আগামী তিন মাসেও যদি তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো না যায়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী কী সমস্যায় পড়তে পারে তা এখনই ভাবতে হবে এবং সে সমস্যা মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। অধ্যাপক এম. শাহেদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ অনেক বেশি পেশাগত কূটনীতির ওপর নির্ভর করেছে। গতানুগতিক কূটনীতির বাইরে যেতে পারেনি। এজন্য সংকট আরো ঘনিভূত হচ্ছে। ভারত ও চীনের সঙ্গে আলোচনা করে এ সমস্যার সমাধান করার কথা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনে কেন আসেনি? রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন কালপর্বে প্রবেশ করেছে এমন মন্তব্য করে মানবাধিকারকর্মী সাইফুল হক অমি বলেন, স্বাধীনতার পরে এত বড় আন্তর্জাতিক সমস্যায় বাংলাদেশ পড়েনি। তাই এই মুহূর্তে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সরকারকে অনেক ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, সারা পৃথিবী যখন সঙ্কট দেখে মুখ ফিরিয়েছে তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী একা সাহসের সঙ্গে সঙ্কট মোকাবেলা করছে। তাঁর এক হাতে সার্বভৌমত্ব আর অন্যহাতে মানবতা। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন- ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. এ এম এম হামিদুর রহমান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. গোলাম মওলা চৌধুরীসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ।
×