ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

তাকডুম তাকডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল...

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

তাকডুম তাকডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল...

সমুদ্র হক দেশজুড়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের ঢাকের বাদ্যি বেজে উঠেছে। ঢাকিরা ছন্দের তালে নেচে নেচে ঢোলের ওপর কাঠি ঠেকিয়ে দিচ্ছেন। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকের সুমধুর সুর। প্রতিটি স্থানের পূজা কমিটি ঢাকিদের আগে থেকেই চুক্তি করে রেখেছে। ঢাকিরা ঢোলকে রং করে, রঙ্গিন কাপড়ে সাজিয়ে তুলেছেন। উপমহাদেশের খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মণের কণ্ঠে ১৯৭১ সালের সাড়া জাগানো গান ‘তাকডুম তাকডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল...’ কালের সাক্ষ্য হয়ে আছে। এই ঢোল বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির প্রাচীনতম বাদ্যযন্ত্র। সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গে ঢোলের বাদ্য না হলেই নয়। গ্রামীণ মেলা, পূজা পার্বণ, শোভাযাত্রা, আনন্দ মিছিলে ঢোল বাজে। লোকগান, বাউল, ভাটিয়ালী, জারি সারি বিয়ের গান, লাঠি খেলা ঢোল ছাড়া হয় না। ঢোল ছন্দ ও তালের অনন্য বাদ্যযন্ত্র। সঙ্গীত শাস্ত্রে ঢোলকে আনন্দ শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র মনে করা হয়। আদিকালে ঢোল বাজানো হতো দুই হাতের তালু দিয়ে। সঙ্গে আঙ্গুলের ছন্দায়িত ব্যবহারে আলাদা ছন্দ হতো। এরপর কাঠি দিয়ে বাজানো শুরু হয়। ঢাকের কাঠি বেত ও কঞ্চিতে তৈরি করা হয়। পূজা ম-পগুলোতে পূজা অর্চনায় ঢাকের বাদ্যের তালে ধূপের ধোঁয়ায় দেয়া হয় আরতি। বগুড়ার দুর্গাহাটার ঢাকি বিমল চন্দ্র বললেন, সারাবছর দুর্গা পূজার ডাকের অপেক্ষায় থাকেন। বংশ পরম্পরায় তিনি ঢাকি। পূজা অর্চনায় কখন ঢাকের কোন্ বাদ্য বাজাতে হবে তা তিনি শিখেছেন পূর্বসূরিদের কাছ থেকে। ঢোলের বাদনেরও সুর তাল আছে। ত্রিতাল, কাহারবা, দাদরার লয়ে ঢোল বাজানো হয় বেশি। ঢাকি বা ঢুলি শরীরের ছন্দময় দুলুনিতে এমনভাবে ঢোল বাজায়- মনে হবে যেন ঢাকি নৃত্য হচ্ছে। কত কৌশল ও কসরত করে যে ঢোল বাজানো হয়- বাহুতে ফিতা দিয়ে ঝুলিয়ে ঢোল শরীরের বাম পাশে রেখে দুই হাতে কাঠি দিয়ে বাজানো হয় বেশি। এ ছাড়াও ঢোল মাটিতে রেখে, তিন ঢোল পাশাপাশি রেখে একসঙ্গে, একজনের ঢোলে আরেক জন কাঠি দিয়ে বাজায়। ঢোলের সঙ্গে খোল ও ঢপকি নামের এক ধরনের ঢোল থাকে। ঢোলের সঙ্গে সম্পূরক বাদ্য হিসেবে থাকে বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার, দোতরা। তবে ঢোল কখনও একক কখনও সম্পূরক বাদ্য হয়। এই ঢোলকে ঘিরেই বিশ্বের দেশে দেশে বানানো হয়েছে ড্রাম সেট, বেসটম, স্লায়ারসহ নানা কিছু। সবই ঢোলের হাইটেক সংস্করণ। আদি ঢোল দেখেই রক ও জ্যাজ মিউজিকে বিশেষ ধরনের নানা আকৃতির ড্রাম সেট বানানো হয়েছে। তিন ধরনের ড্রামের সঙ্গে স্টিলের সিম্বেল ও হাই হেড মিলিয়ে সেটের বিন্যাস করা হয়। কোন কোন ড্রাম সেট প্লাস্টিক জাতীয় সিনথেটিক দিয়ে বানানো। যে ড্রামই বানানো হোক তা বিভিন্ন ধরনের আদি ঢোল থেকেই নেয়া। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মালদ্বীপ ভুটান ও নেপালে ঢোলের ব্যবহার প্রতিদিনের। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতিতে ঢোলের ব্যবহার আছে। বিশেষ করে ধ্রুপদী নাচে ঢোলের ব্যবহার চমৎকার ও আকর্ষণীয়। আফ্রিকা মহাদেশের প্রতিটি স্থানে ঢোলের ব্যবহার নিত্যদিনের। লাতিন আমেরিকার নাচে গানে হাজার বছরের ঐতিহ্য এই ঢোল। বিশ্বখ্যাত সাম্বা নাচে প্রধান ভূমিকা পালন করে ঢোল। বলা হয় ঢোল ছাড়া সাম্বা নাচ হবেই না। ক্যারিবিয়ান, লাম্বাডা নাচে ঢোল অপরিহার্য। বাংলাদেশে ঢোলের আগমন ঠিক কবে তার সঠিক কাল নিয়ে একাধিক মত আছে। তবে ঢোল যে প্রাচীনতম বাদ্য এই বিষেয়ে কোন দ্বিমত নেই। অতীতে দেশের প্রতিটি খেয়াঘাটের কাছাকাছি থাকত ঢুলিদের বাস। তারা বিভিন্ন উৎসব পার্বণে, বিয়ে বাড়িতে ঢোল বাজাত। নবান্নের সময় নৌকা করে মাঝ নদীতে গিয়ে ঢোল বাজানো হতো। বাইচের নৌকায় ঢোল ও কাসরের বাদ্য থাকবেই। তা না হলে বৈঠা দ্রুত চলবেই না। শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন, বাংলার সংস্কৃতিতে এই অঞ্চলে ঢোল এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। বাংলা ঢোল শব্দের উৎপত্তি ফারসী ‘দহ’ শব্দ থেকে। অনেকে মনে করেন ভারতীয় উপমহাদেশে ঢোলের উদ্ভাবন করেন ওস্তাদ আমীর খসরু। বাংলাদেশে অন্তজ শ্রেণীর সম্প্রদায় ঢুলি নামে পরিচিত। সিলেট অঞ্চলে ঢোল বানানোর অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। টাঙ্গাইলে ঢোলের আলাদা হাট আছে। যেখানে ঢোল বেচাকেনা হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন ঢোল সংগ্রহের জন্য টাঙ্গাইল ও সিলেটে যায়।
×