ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনা

মিয়ানমার সমস্যা সৃষ্টি করেছে সমাধানও তাদের করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মিয়ানমার সমস্যা সৃষ্টি করেছে সমাধানও তাদের করতে হবে

মাননীয় স্পীকার, আজকে যে বিষয়টি নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করছি এবং মাননীয় সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপু মনি যে প্রস্তাবটি এখানে উত্থাপন করেছেন আমি তার প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এটুকু বলব যে, আমাদের বাংলাদেশে আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষ আজ আশ্রয় নিয়েছে। এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কারণ একটি দেশের নাগরিক, তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচারের যে সমস্ত চিত্র আমরা দেখলাম তা নিন্দা করবার ভাষা আমি পাচ্ছি না। রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারেরই নাগরিক এটা তো সকলেরই জানা। ১৯৫৪ সালে বার্মা অর্থাৎ বর্তমান মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী উ-নু রোহিঙ্গাদের অন্যান্য যে জাতিগোষ্ঠী আছে যেমন- কাটিন, কাইয়া, মুন, রাখাইন, সান- এ ধরনের আরও বিভিন্ন প্রায় এক শ’ পঁয়তাল্লিশটির মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি আছে। তাদের সকলের সঙ্গেই সমান অধিকার এই রোহিঙ্গাদের আছে। সে কথা তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং রেডিওতে তা প্রচার করা হয়েছিল। কাজেই, যে অধিকার তারা একবার দিয়েছিল এবং তাদের ভোটের অধিকার ছিল, সবকিছুই ছিল কিন্তু সেখানে দেখা গেল যে, ১৯৭৪ সালে এই বার্মা, বর্তমান মিয়ানমারের মিলিটারি জান্তা এই অধিকার কেড়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। আমরা লক্ষ্য করলাম যে, ১৯৭৮ সালে এ রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা শুরু করেছিল। এরপর তারা ১৯৮২ সালে যে ‘সিটিজেন আইন’ করে সে আইনে একটা চার স্তর বিশিষ্ট সিটিজেনশিপ প্রয়োগ করে। এটা করার উদ্দেশ্যই ছিল এদের অধিকারটা কেড়ে নেয়া। আর ২০১৫ সালে এসে এই রোহিঙ্গাদের সমস্ত ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়। এভাবে একটা জাতির প্রতি এই ধরনের আচরণ মিয়ানমার সরকার কেন করছে, এটা সত্যিই আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা বারবার এটার প্রতিবাদ করেছি এবং বিশেষ করে ’৭৮ সালে একদফা এই রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে আশ্রয় নেয়। এরপর ১৯৮১-৮২ সালে, এরপর ১৯৯১-৯২ সালে। মাননীয় স্পীকার, ইতোমধ্যে আপনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে শুনেছেন যে, তখন তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা কূটনৈতিক সম্পর্ক হয় এবং একটা সমঝোতা স্মারক হয়। যার ফলে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা তাদের নিজের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে। তখন এই আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নিয়ে গেল। ১৯৭৮ সালে যারা এসেছিল তারাও সকলে চলে গেল। ১৯৮১-৮২ সালে যারা এসেছিল তাদেরও ফেরত নেয়া হলো। ১৯৯১-৯২ সালে যারা এসেছিল তাদেরও ফেরত নেয়া হলো। কিন্তু সেখানে কিছু রোহিঙ্গা থেকে গেল। সেখানে সেই সময়ে রেজিস্টার্ড প্রায় ২৫ হাজারের মতো ছিল আর আন-রেজিস্টার্ড বেশকিছু তারা থেকে গিয়েছিল। তাদের আর ফেরত নেয়া হলো না। সেখানেই একটা বাধা পড়ল। আমরা বারবার এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বলেছি যে, তাদের নাগরিকদের তাদের ফিরিয়ে নেয়া উচিত। আমি যতবার মিয়ানমার গিয়েছি সেখানে সেই সময়ে মিয়ানমারে তখনও গণতন্ত্র ফিরে আসেনি, সেখানে মিলিটারি শাসকেরাও ছিল। তাদের আমরা অনুরোধ করেছিলাম যে, এরা আপনাদেরই নাগরিক, আপনারা তাদের ফেরত নিয়ে যান, এরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এরপরে যখন গণতন্ত্র ফিরে এলো, অং সান সু চি হচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার সঙ্গে আমার বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে। যখনই দেখা হয়েছে তাকেও আমরা এই অনুরোধটা করেছি যে, যারা এখন আমাদের দেশে আছে তাদের ফিরিয়ে নাও। কিন্তু ফিরিয়ে নেয়া তো দূরের কথা, আমরা দেখলাম এরপরে আবার সেই ২০১২ সালে একদফা আবার এই রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। কারণ তাদের ওপর একটা অমানবিক অত্যাচার শুরু হলো। এরপর ২০১৫-১৬ সালে, আবার এই ২০১৭ সালে এখন ব্যাপক হারে এসেছে। এই ঘটনার সূত্রপাতটা আমরা যেটা দেখি ওখানে কোন একটা গোষ্ঠী আছে তারা মিলিটারির ওপর হামলা করেছে। মিয়ানমারের যে বর্ডার ফোর্স তাদের ওপর হামলা করে বেশ কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করে। ২০১২ সালে একবার এই ঘটনা ঘটায়। তখনই সাধারণ নাগরিকের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। আবার ২০১৬ সালে এবং ১৯১৭ সালে ঠিক একই ঘটনা ঘটানো হলো। সেখানে অনেকগুলো বর্ডার ফোর্সের সদস্যদের, বর্ডার পুলিশকে হত্যা করেছে। আর্মির ওপরে তারা আক্রমণ করেছে। যার ফলাফলটা হলো যে সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন শুরু হলো। এই নির্যাতন এমন পর্যায়ে এখন গেছে যে, যেটা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। যখন মানুষ আসতে শুরু করেছে আমরা দেখেছি নারী, শিশুই বেশি। নৌকাডুবি হয়ে সেখানে শিশুর লাশ নাফ নদীতে ভাসছে। এমনকি গুলি খাওয়া, মাথায় এবং বুকে গুলি খাওয়া লাশ নদীতে অথবা সাগরে ভেসে ভেসে সেই লাশ চলে আসছে। সেখানে আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হচ্ছে। মাননীয় স্পীকার, এই দৃশ্য দেখা যায় না! আমরা তো মানুষ! আমাদের ভেতরে তো একটা মনুষ্যত্ব আছে। তাদের আমরা নিষেধ করব কীভাবে? কারণ আমাদেরও তো অভিজ্ঞতা আছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঠিক যেভাবে, যে কায়দায় আমাদের ওপর অত্যাচার শুরু করেছিল, অগ্নিসংযোগ করা, মেয়েদের রেপ করা, মানুষকে হত্যা করা এবং ছোট্ট শিশুকে হত্যা করাÑ ঠিক সেই ঘটনার সেই দৃশ্যগুলো যেন আবার চোখের সামনে ভেসে আসছে। আর এরা জীবনের ভয়ে পালিয়ে আসছে। আমাদের জন্য এটা কঠিন যে, এতগুলো মানুষকে এখানে রাখা, তাদের আশ্রয় দেয়া। কিন্তু এরা তো মানবজাতি। আমরা তো ফেলে দিতে পারি না। কারণ আমরা তো ভুক্তভোগী, আমরা জানি। আমিও তো রিফিউজি ছিলাম ছয় বছর। ’৭৫-এ যখন আমার মা-বাবা, ভাই-বোন সকলকে হত্যা করল। আমিও তো দেশে আসতে পারিনি। কাজেই একটা রিফিউজি হয়ে থাকা সেটা যে কতটা অবমাননাকর এই যন্ত্রণা তো আমি আর আমার ছোট বোন রেহানা আমরা খুব ভালভাবে বুঝি। তাই আমরা এদের আশ্রয় দিয়েছি মানবিক কারণে। কিন্তু আমরা চাই তারা তাদের নিজের ভূমিতে যেন ফিরে যায়। আমরা সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়Ñ এই নীতিতে বিশ্বাসী। আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পররাষ্ট্র নীতি দিয়েছেন সেই নীতিমালা অনুসরণ করেই আমরা প্রত্যেক দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। কারও সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক হোক সেটা আমরা চাই না। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়েই থাকতে চাই। মিয়ানমার সরকারকে আমি এইটুকু বলব যে, তাদের নাগরিক, শত শত বছর ধরে তারা বাস করছে। এক সময় তাদের ভোটের অধিকার ছিল। তাদের সবই ছিল। হঠাৎ তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া বা তাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া বা তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা, এর ফলাফল ঠিক কী দাঁড়াতে পারে সেটা কি তারা চিন্তা করেছে? কেন তারা এ ধরনের কাজ করছে? মাননীয় স্পীকার, এটা ঠিক যে এক সময় আমাদের দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেয়া হতো প্রতিবেশী দেশে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- বা ইনসার্জেন্স এ্যাক্টিভিটি চালানোর জন্য। আমি যখন থেকে সরকার গঠন করেছি, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছে তখন থেকে আমরা সোজা ঘোষণা দিয়েছি যে, আমাদের এই মাটি আমরা কাউকে ব্যবহার করতে দেব না কোন প্রতিবেশী দেশে কোন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানোর। সেটা কিন্তু আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছি। এ ধরনের কোন কিছু আমরা করছি না। বারবার আমরা আমাদের বর্ডার গার্ড এবং মিয়ানমারের বর্ডার পুলিশ তাদের সঙ্গে সবসময় আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আমরা কথা-বার্তা বলছি, আলোচনা করছি। কখনও কোন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সেটা জানানো হচ্ছে। যখনই আমাদের কাছে কেউ ধরা পড়ছে, আমরা তাদের হাতে ফেরত দিচ্ছি। আমরা কখনই এ ধরনের কোন কর্মকা-কে সমর্থন করব না। কারণ আমাদের একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের দেশেও পার্বত্য চট্টগ্রামে একটা অশান্ত পরিবেশ ছিল। দুই দশক ধরে অর্থাৎ সেই ১৯৭৬ সাল থেকে এই সমস্যাটা সৃষ্টি হয় এবং সেটা অব্যাহত ছিল। ১৯৯৬ সালে যখন আমরা সরকার গঠন করি, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা শান্তি চুক্তি করি। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই অশান্ত পরিবেশ মোকাবেলা করার জন্য এখানে সামরিক কায়দায় এটাকে সমাধানের চেষ্টা করা হতো। যখন আমাদের দেশে যে সামরিক জান্তারা ক্ষমতায় ছিল তারা ঐ পথ অনুসরণ করত। আমি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে ঘোষণা দিয়েছিলাম যে, এটা সামরিকভাবে সমাধান করার যোগ্য না। এটা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে ছোট্ট একটা সেল গঠন করি এবং সঙ্গে সঙ্গে জানার চেষ্টা করি। যখন ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করি, দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে পার্লামেন্টের একটা কমিটি করে আমরা এটা সমাধান করি। আমরা শান্তি চুক্তি করি এবং বাংলাদেশের যারা নাগরিক ভারতে রিফিউজি হিসেবে ছিল তাদের সকলকে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করি। কারণ আমি মনে করি, যারা আমার দেশের নাগরিক, তারা অন্য দেশে রিফিউজি হয়ে থাকা এটা আমার দেশের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়। কারণ আমাদের নাগরিক আমাদের দেশেই থাকবে। অন্য দেশে তারা কেন থাকবে? তাই তাদের আমরা ফিরিয়ে এনেছি। আমি এ কথাটা বার বার মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যখনই আমার কথা হয়েছে তখনই বলেছি। এমনকি এদের পুনর্বাসনের জন্য আমরা এটাও বলেছি যে, আমরা আমাদের বহু গৃহহারা মানুষ, নদীভাঙ্গা মানুষ, ভূমিহীন মানুষ তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে থাকি। কাজেই আমরা এ বিষয়ে তাদের সহযোগিতা করতে পারি। আমাদের অভিজ্ঞতা তারা যাতে কাজে লাগাতে পারে, সে ব্যবস্থা আমরা করে দেব। কিন্তু তারা যেন তাদের লোকগুলো ফেরত নিয়ে যায়। মাননীয় স্পিকার, আপনি শুনেছেন, আমাদের পররাষ্ট্র সচিব বার বার তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেখানে গেছেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গেছেন, আলোচনা করেছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, তারা ফেরত নেয়া তো দূরের কথাÑ এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করল যে, আজকে সমস্ত বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। যখন দেখা যাচ্ছে যে, এভাবে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে এবং তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করা হচ্ছে। আমি ঠিক জানি না। বিশ্বব্যাপী আমি যদি তাকাই আমার খুব কষ্ট হয়। সমস্ত বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ওপরে আক্রমণ করার একটা মানসিকতা দেখতে পাচ্ছি। মুসলমানরা এসব রিফিউজি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে। আমরা যেমন আইলানের লাশ দেখেছি সাগর পাড়ে ঠিক তেমনি নাফ নদীতে দেখি শিশুদের লাশ। কেন? আমাদের আর একটা দুর্ভাগ্য হলো যে, আমাদের সমস্ত মুসলিম দেশ বা মুসলিম উম্মাহ যদি এটা অনুভব করতে পারত আর সবাই যদি ঐকমত্যে থাকতে পারত; তাহলে মুসলমানদের ওপর এই অত্যাচারটা কেউ করতে পারত না। আমি বারবার ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেলকে বলেছি। যখন সম্মেলন হয়েছে তখনও বলেছি। আমি বিভিন্ন মুসলিম দেশের নেতাদের সঙ্গে যখন কথা বলেছি তখনও বলেছি যে, কোন রকম সমস্যা থাকলে আমরা আলোচনা করি, আমরা সমাধান করি। কিন্তু আমরা অন্যের হাতের খেলার পুতুল কেন হব? কিন্তু দুর্ভাগ্য, এটা আমি দেখতে পাচ্ছি বিশ্বব্যাপী এরকমই একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এখানে কে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, বৌদ্ধÑ এটা কোন কথা না। আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি এবং মানবিকভাবে তাদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি। কারণ, এখানে শুধু মুসলমান না, বেশকিছু হিন্দুও নির্যাতিত হয়ে এসেছে। আজকে আমরা যখন দেখি ওই লাশের ছবি, আজকে সত্যিই বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এখানে অনেকেই আউং সান সুচির ব্যাপারে তুলেছেন কথা। আপনারা জানেন যে, মিয়ানমারে দীর্ঘদিন মিলিটারি ডিকটেরশিপ চলেছে। কেবল গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু। কিন্তু সেখানেও আইন করে আউং সান সুচিকে কিন্তু মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি হতে দেয়নি বা সরকারপ্রধান হতে দেয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছে। কাজেই তার ক্ষমতাইবা কতটুকু আছে, সেটাও আপনাদের একটু বিবেচনা করতে হবে। নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে পার্লামেন্টে, সেখানেও কিন্তু তাদের সংখ্যাধিক্য বেশি। মিলিটারি প্রতিনিধির সংখ্যা বেশি। পলিসি মেকিংয়ে তারা যেটা বলবে, সেটাই। কাজেই এখানে যেটা দেখা যাচ্ছে যে, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিচ্ছে। তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করছে। কেন তারা এটা করছে? সেটাই হলো আমাদের প্রশ্ন। আজকে আমরা মানবিক কারণে তাদের জায়গা দিচ্ছি। আমাদের সমস্যা যে, এত লোক এখানে এসে গেছে, ছোট ছোট শিশুরা, নারীরা; এদের আমরা কোথায় ঠাঁই দেব? আজকে আমরা তাদের জায়গা দিচ্ছি। কারণ আমরা তো অমানুষ হতে পারি না। আমরা তো অমানবিক আচরণ করতে পারি না। কিন্তু মিয়ানমারকে এটা স্পষ্টভাবে মানতে হবে যে, তাদেরই নাগরিক; আইন করে যেভাবেই হোক তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে পারবে না। মিয়ানমারের এক জেনারেল ঘোষণা দিয়েছেন, এরা সবাই বাঙালী। বাঙালী তো শুধু বাংলাদেশে নাই, বাঙালী তো পশ্চিমবঙ্গেও আছে। বাঙালীও পৃথিবীর বহু দেশেই আছে। বাঙালী বলেই তাদের তাড়িয়ে দেবে, এটা কেমন কথা? তাদের ভাষা, সবকিছু তো আলাদা, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ আলাদা, সবই তো বার্মিজ, মিয়ানমারেরই। তো তাদের আবার কালার দেয়া হবে কেন? আর মানুষ কখনও এদিকে আসে, ওদিকে যায়, এরকম তো যাতায়াত করতেই থাকে, যুগ যুগ ধরে হয়েছে। কিন্তু এত শত শত বছর ধরে মিয়ানমারেই থেকেছে, ওখানে তাদের আদি নিবাস। তাহলে তাদের কেন এভাবে বিতাড়িত করা হবে? অত্যাচার করা হবে? এভাবে নির্যাতন করা হবে? সেই সঙ্গে আমি বলব যে, যারা দুইটা পুলিশ মারল, দশটা পুলিশ মারল, কি পাঁচটা মিলিটারি মারল বা একশ’টা আর্মি লোক মারলÑ এটা মেরে তারা কী অর্জন করছে? তারা কি এটা বোঝে না যে, তাদের এ সমস্ত কারণে আজকে লাখ লাখ মানুষ, যারা নিরীহ, তাদের ঘরবাড়ি পুড়ে যাচ্ছে? তারা মৃত্যুবরণ করছে, তাদের ওপরে আঘাত করছে, ছোট ছোট শিশুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, তাদেরই মা-বোনদের ওপর পাশবিক অত্যাচার হচ্ছে। তাহলে এ অত্যাচারের সুযোগটা এরা কেন সৃষ্টি করে দিচ্ছে? আর এ থেকে তারা কী অর্জন করেছে? হয়তো যারা এদের অস্ত্র সরবরাহ করছে, তারা লাভবান হচ্ছে। কারণ অস্ত্র বিক্রি করতে পারছে। এদের অর্থ যারা জোগান দিচ্ছে, হয়তো তারা লাভবান হচ্ছে। কিন্তু আজকে তাদের এ সমস্ত সন্ত্রাসী কর্মকা-ের কারণে আজকে মিয়ানমারের লোকগুলো কষ্ট পাচ্ছে। আজকে তারা গৃহহারা, ঘরবাড়ি হারা, মানবেতর জীবনযাপন করছে। কাজেই আমি এটা বলব যে, এ সমস্ত কর্মকা- বন্ধ করতে হবে। মিয়ানমার সরকারকেও আমরা এটাও বলছি যে, আমরা এদের আমরা কোনমতেই প্রশ্রয় দেব না। আমাদের যে সিদ্ধান্ত, এটা আমরা সব সময় রক্ষা করি। আমরা কখনও প্রশ্রয় দেব না। কিন্তু মিয়ানমারকেও সে রকম ব্যবহার করতে হবে যে, কয়েকটা লোক, যারা অপরাধী তাদের খুঁজে বের করুন। কিন্তু কিছু ঠকবাজদের কথা বলে এরা সাধারণ মানুষকে হত্যা করবে; ছোট ছোট শিশু কি অপরাধ করেছে? নারীরা কি অপরাধ করেছে? তাদের ওপরে অত্যাচার হবে, এটা আমরা কখনও মানতে পারি না। এটা কিছুতেই মানা যায় না। কাজেই তাদের এটা বুঝতে হবে। তাদেরই নাগরিক, যারা আজকে বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সকলকে তাদের ফেরত নিতে হবে। সেখানে তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা আজকে দেশ ছেড়ে চলে এসেছে, তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে ‘সেফ জোন’ করে তাদের সেখানে রেখে সমস্ত নিরাপদ ব্যবস্থা তৈরি করে দিতে হবে। আর রাখাইন রাজ্য থেকে যাদের বিতাড়িত করেছে, তাদেরও তাদের ফেরত নিতে হবে। আর কোফি আনান যে সুপারিশটা করেছেন তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এই আনান কমিশন মিয়ানমার সরকারই গঠন করেছে। তারা আনানকে আসতেও দিয়েছে, সেখানে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। তাহলে তার সুপারিশটা তারা গ্রহণ করবে না কেন? আর যদি সেখানে তাদের কোন আপত্তি থাকে, তারা আলোচনা করতে পারে। আলোচনা করে তারা যেভাবে হোক এ সমস্যাটা সমাধান করুক। আমাদের এখানে যারা আশ্রয় নিয়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে এবং এখন যারা এসেছে, তাদের প্রত্যেক নাগরিককে তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। কারণ এ সমস্যা মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে। এ সমস্যার সমাধানও মিয়ানমারকেই করতে হবে। এটা হলো বাস্তবতা। এখানে যদি কোন রকম সহযোগিতা লাগে, হ্যাঁ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা সে সাহায্য করব। আমি এটুকু বলতে চাই যে, অনেকে আজকে যারা আমাদের এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে: তাদের আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি। আমি এটুকু বলব যে, এরা আজকে কষ্ট করে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের এ দুর্ভোগ্যের সুযোগ নিয়ে কেউ যেন একদিকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা না করেন। আর কেউ কেউ এখান থেকে নিজেদের ভাগ্য গড়ার জন্য চেষ্টা যেন না করে। আর্থিক সুবিধা নেয়ার চেষ্টা যেন না করে। ষোলো কোটি মানুষকে আমরা খাবার দেই, তার সঙ্গে আরও এরকম দু-চার-পাঁচ লাখ লোককে খাবার দেয়ার মতো সে শক্তি বাংলাদেশের আছে। এটুকু আমি অন্তত বলতে পারি। আমাদের সাধ্যমতো আমরা সে চেষ্টা করে যাব। হ্যাঁ, তারপরে যারা যারা সাহায্য দেবেন ইতোমধ্যে আমাদের কমিটি করা আছে, সে কমিটির মাধ্যম এটা দিতে হবে। আমাদের প্রত্যেক এলাকায় আমাদের লোক আছে। আর প্রত্যেকে, যারাই ঢুকবে, প্রত্যেকের ছবি তোলা, তাদের নাম, ঠিকানা লেখা এবং তার একটা সম্পূর্ণ হিসেব আমরা ইতোমধ্যে করতে শুরু করেছি। এ জন্য কোন প্রকল্প না। আমি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে এবং কল্যাণ তহবিল থেকে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি ইতোমধ্যে। এটা করার জন্য যা যা খরচ লাগে, ইতোমধ্যে আমরা দেয়া শুরু করেছি এগুলোর সমস্ত তালিকা করে। কেউ দুই লাখ বলবেন, কেউ পাঁচ লাখ বলবেন, কেউ দশ লাখ বলবেন। যে যারা মতো বলতে থাকবেন, সেটা না। সত্যিকার যারা এসেছে তাদের সম্পূর্ণ ছবি থাকবে, তাদের আইডেন্টিটি থাকবে যে, তারা কারা। তাদের আপাতত মানে সাময়িকভাবে একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা, সেটাও আমরা করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছি। সেটা আমরা করে দিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে যদি কেউ সহযোগিতা করেন নিশ্চয়ই আমরা সেটা নেব। কিন্তু আবার এদের এ দুর্দশাকে মূলধন করে কেউ কারও ভাগ্য গড়বে, সেটা আমরা করতে দিতে চাই না। কেউ যেন এটা নিয়ে রাজনীতি না করে; মানে কোন সাহায্য নাই, সহযোগিতা নাই বড় বড় এক একখানা স্টেটমেন্ট দিয়ে আর বড় বড় কথা বলবেন, সেটা কিন্তু হবে না, সেটা আমরা চাই না। আপনারা জানেন যে, আমি ১৬ তারিখে জাতিসংঘে যাচ্ছি। সেখানে সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দেব। নিশ্চয়ই আমি আমার বক্তব্যে মিয়ানমারের বিষয়টা তুলে ধরব। আমাদের যারা ওখানে স্থানীয় সংসদ সদস্যরা আছেন, যে সমস্ত প্রতিনিধিরা আছেন, তাদের সকলেই এদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাছাড়া, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, আমাদের বর্ডার গার্ড থেকে শুরু করে সকলে এখন সক্রিয় আছেন। সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে আমাদের দলের থেকেও ত্রাণের ব্যবস্থা আমরা করেছি। তারাও কাজ করে যাচ্ছে। মানবতার খাতিরে আমরা এদের পাশে দাঁড়িয়েছি। এদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। কিন্তু এটা সাময়িক ব্যবস্থা। অবশ্যই মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকত্বের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের নিজের ভূমিতে ফেরত নিতে হবে মিয়ানমারকেই, সে কথা বলেই আজকে যে প্রস্তাবটি এসেছে, মাননীয় স্পিকার, সেটা হলো মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ধর্মীয়, জাতিগত, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অব্যাহত নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধ, তাদের নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশে ‘পুশ-ইন’ করা থেকে বিরত থাকা এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্বের অধিকার দিয়ে নিরাপদে বসবাসের ব্যবস্থা গ্রহণে মিয়ানমার সরকারের ওপর জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলে জোরালো কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানানো হোক। সংসদে এই যে প্রস্তাবটি আমাদের ড. দীপু মনি নিয়ে এসেছেন, আমরা এ প্রস্তাবটিকে সর্বাত্মকরণে সমর্থন জানাচ্ছি। মাননীয় স্পিকার, আপনাকে ধন্যবাদ। [মিয়ানমারের শরণার্থী বিষয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ]
×