ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

শেষ দিনের তল্লাশি শেষে বাড়িটি বিস্ফোরকমুক্ত ঘোষণা, সিলগালা

মিরপুরের আস্তানা থেকে আরও ৭ বোমা ও হাজার ইগনিশন কর্ক উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মিরপুরের আস্তানা থেকে আরও ৭ বোমা ও হাজার ইগনিশন কর্ক উদ্ধার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মিরপুরের জঙ্গী আস্তানায় তল্লাশি অভিযানের শেষ দিন শুক্রবারেও সেখান থেকে সাতটি শক্তিশালী বোমা ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। বোমায় ব্যবহৃত অন্তত এক হাজার ইগনিশন কর্ক উদ্ধার হয়েছে। প্রতিটি কর্ক একটি বোমায় ব্যবহৃত হয়। অভিযান শেষে বাড়িটি বিস্ফোরকমুক্ত বলে ঘোষণা করেছে র‌্যাব। এ নিয়ে গত পাঁচদিনের অভিযানে বাড়ি থেকে প্রায় শ’ খানেক শক্তিশালী বোমা, বোমা তৈরির খোল, দশ কেজি গান পাউডার, পনেরো কেজি স্পিøন্টার ও নানা ধরনের শতাধিক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হলো। বাড়িটির ছয়তলায় বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির কারখানা বা ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছিল। উদ্ধারকৃত এবং বিস্ফোরিত বিস্ফোরক দিয়ে ভয়াবহ নাশকতা চালানো সম্ভব ছিল। আস্তানায় যাতায়াত ছিল পলাতক ছয় দুর্ধর্ষ জঙ্গীর। এদের মধ্যে ডন নামে একজন সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য মিলেছে। যাতায়াতকারী জঙ্গীদের আর্থিকসহ নানাভাবে সহযোগিতা করত আব্দুল্লাহ। প্রতিমাসে আব্দুল্লাহর খরচ ছিল অন্তত লক্ষাধিক টাকা। আব্দুল্লাহর প্রায় কোটি টাকার সৌখিন কবুতর ছিল। এরমধ্যে শ’ খানেক বিস্ফোরণে মারা গেছে। বাকিগুলো সরকারের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। অভিযান শেষে বাড়িটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। বাড়িতে আপাতত কাউকে বসবাস করতে দেয়া হচ্ছে না। ভবন বিশেষজ্ঞদের মতামতের পরেই বাড়িতে বসবাসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। শুক্রবার বিকেল চারটায় অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার পর এমনটাই জানালেন র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। তিনি আরও জানান, ছয় তলা ওই বাড়িতে শুক্রবার সকাল নয়টার দিকে পঞ্চমদিনের মতো তল্লাশি শুরু করে র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিস। আস্তানা থেকে তিন ধরনের ১৭ শক্তিশালী বোমা, ৩০ হ্যান্ড গ্রেনেড, ৫০ কেমিক্যাল বোমা, এক কন্টেনার ভর্তি এসিড, ১০ কেজি গানপাউডার, ৩ কেজি সালফার, ৮ থেকে ১০ কন্টেনারে দাহ্য পদার্থ ও শতাধিক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। বাড়িটির ছয়তলায় ছিল মূলত কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি। এখান থেকে খুবই সুরক্ষিত অবস্থায় থাকা শক্তিশালী বোমা ও বিস্ফোরক উদ্ধার হয়। এরমধ্যে দুটি ফ্রিজের মধ্যে আইইডি ছিল, যা খুবই শক্তিশালী। ছয় তলা বাড়িটি চার ইউনিটে তৈরি। প্রতি তলায় চারটি করে ফ্ল্যাট রয়েছে। এরমধ্যে পঞ্চম তলার দুটি ইউনিটে সন্দেহভাজন জঙ্গী আব্দুল্লাহ পরিবার নিয়ে বসবাস করত। ষষ্ঠ তলার অর্ধেক অংশে আব্দুল্লাহ কবুতর পুষত। বাকি খোলা জায়গায়ও কবুতর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যবহার করত। ষষ্ঠ তলার একটি অংশে তল্লাশি চালিয়ে ২৩ ফ্রিজ পাওয়া গেছে। এই র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, বাড়ি থেকে গত পাঁচদিনের তল্লাশিতে প্রচুর বিস্ফোরক, শক্তিশালী বোমা ও অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধারকৃত বিস্ফোরক ও অস্ত্রশস্ত্র এবং আস্তানায় বিস্ফোরিত বিস্ফোরক দিয়ে দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালানো সম্ভব ছিল। মূলত বড় ধরনের নাশকতা চালাতেই বিস্ফোরকগুলো সেখানে মজুদ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই আস্তানায় অন্তত ছয় দুর্ধর্ষ জঙ্গীর যাতায়াত ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এদের মধ্যে ডন নামের একজন সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। পলাতকদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। আব্দুল্লাহর কাছে যাতায়াতকারীদের আর্থিক সহায়তাসহ নানাভাবে সহযোগিতা করত আব্দুল্লাহ। কারণ আব্দুল্লাহর কাছে যথেষ্ট অর্থ ছিল। জঙ্গী আস্তানা আবিষ্কৃত হওয়ার ঘটনায় বাড়ির মালিক হাবীবুল্লাহ বাহার আজাদ ও নৈশপ্রহরী সিরাজুল ইসলামকে ৫ দিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‌্যাব। স্থানীয় ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল্লাহর তেমন কোন লেখাপড়া নেই। তারা সাত ভাই। বোনের সংখ্যা জানা যায়নি। প্রতিবন্ধী এক বোন মেহেরুন্নেছা র‌্যাবের কাছে আস্তানা থেকে বেরিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। আব্দুল্লাহ ও তার আরেক ভাই খোকা প্রায় ২৫ বছর ধরে মিরপুরের দিয়াবাড়ি এলাকায় বসবাস করছিল। তারা দিয়াবাড়ি এলাকার একটি ইলেকট্রিকের দোকানের কর্মচারী ছিল। পরবর্তীতে খোকা দিয়াবাড়ি এলাকায়ই থেকে যায়। আর আব্দুল্লাহ বর্ধনবাড়ি এলাকায় ব্যবসা খুলে বসে। দিয়াবাড়ির পাশেই হরিরামপুর এলাকায় তাদের এক বোনও থাকত। তাদের দুই ভাই যাত্রাবাড়ীতে বসবাস করত। খোকাও আব্দুল্লাহর মতো আইপিএস, ইউপিএস ও কবুতরের ব্যবসা করত। আব্দুল্লাহ দুই স্ত্রী নাসরিন ও ফাতেমা এবং দুই সন্তান ওমর ও ওসামাকে নিয়ে বর্ধনমান বাড়ির ওই বাড়িতে প্রায় পনেরো বছর ধরে ভাড়ায় বসবাস করে আসছিল। আব্দুল্লাহ ২০০৫ সাল থেকে জেএমবির সঙ্গে জড়িত। পরবর্তীতে তিনি নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। এরপর থেকেই তার আস্তানায় জঙ্গীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। সংগঠনের খরচ চালাতে তিনি কবুতর ও আইপিএস-ইউপিএস ব্যবসা শুরু করেন। আব্দুল্লাহ কমল প্রভা নামের ওই বাড়ির তিনটি ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করছিলেন। একটিতে কবুতর পালন, একটিতে বসবাস ও আরেকটিতে ফ্যাক্টরি বা ল্যাবরেটরি গড়ে তুলেছিলেন। প্রতি ফ্ল্যাটের ভাড়াই ছিল ১৫ হাজার টাকা করে। সে হিসেবে ৪৫ হাজার টাকা শুধু ভাড়াই ছিল। এরসঙ্গে আনুসঙ্গিক মিলিয়ে প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ হতো। এরসঙ্গে দুইজন সহযোগী ছিল। তাদের মাসিক বেতন ছিল ন্যূনতম পনেরো হাজার টাকা করে হলেও ৩০ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে লাখ টাকার উপর খরচ ছিল আব্দুল্লাহর। আব্দুল্লাহ তার আইপিএস-ইউপিএস নিজস্ব লোক দিয়ে পুরনো ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে বাজারজাত করতেন। তার প্রায় কোটি টাকার কবুতর ছিল। এরমধ্যে কোন কোন কবুতরের একজোড়ার দাম ছিল কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে এসব কবুতর বিক্রি করতেন। এসব কবুতর বিদেশ থেকে আমদানি করতেন আব্দুল্লাহ। বিস্ফোরণে অন্তত শ’ খানেক কবুতর মারা গেছে। বাকিগুলোর সেবা করা হচ্ছে। সেগুলো সুস্থ হওয়ার পর সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। প্রসঙ্গত, গত ৪ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে মাজার রোডের বর্ধমান বাড়ির ২/৩/বি নম্বর ছয়তলা বাড়িটিতে জঙ্গী আস্তানাটির সন্ধান পায় র‌্যাব। অভিযানের আগে বাড়িটির ২৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৩টি ফ্ল্যাটের ১৫ শিশু, ২৪ নারী ও ২৬ পুরুষ সদস্যকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়। এরপর থেকেই আস্তানায় থাকাদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। আব্দুল্লাহর প্রতিবন্ধী বোন মেহেরুন্নেছা আত্মসমর্পণ করে। পরবর্তীতে আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে অন্যদের আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা করা হয়। মঙ্গলবার আব্দুল্লাহ রাজি হয়েও শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ না করে রাত দশটার দিকে আত্মঘাতী হয়ে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটায়। আস্তানা থেকে র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। চার র‌্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন। বুধবার আস্তানা থেকে সাতটি মাথার খুলি ও পুড়ে একপ্রকার কয়লা হয়ে যাওয়া শরীরের বিভিন্ন পোড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উদ্ধার হয়। বৃহস্পতিবার আস্তানা থেকে আরও বিস্ফোরক ও একটি আলিশান পনেরো তলা ভবনের নকশা উদ্ধার হয়। তাতে বিভিন্ন জায়গায় মার্কিং করা। ভবনটিতে হামলা চালাতে বা উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল বলে র‌্যাব বলছে। বুধবার বাড়ি থেকে উদ্ধারকৃত সাত জনের খুলির সুরতহাল শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, আগুনে পুড়ে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে আব্দুøল্লাহর পরিবারের চার সদস্য ছাড়াও কামাল উদ্দিন নামে একজন ছিল বলে এক দম্পতি দাবি করেন। ওই দম্পতির দাবি, তাদের ছেলে কামাল আব্দুল্লাহর কবুতরের খামারে কাজ করে তার সঙ্গেই থাকত। বোমা বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। মৃতদেহগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। হাড়-মাংস কিছুই ছিল না। অনেক কষ্টে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য মেরুদ-ের সামান্য হাড় সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া শরীরের ধ্বংসাবশেষ থেকে লোহার টুকরো, দস্তা ও টিনের টুকরো সংগ্রহ করা হয়েছে। ফরেনসিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া নিহতদের বয়স জানার কোন উপায় নেই। এমনকি কে নারী আর কে পুরুষ তাও নির্ণয় করা যাচ্ছে না। শুধু দুটো শিশুর মৃতদেহ থাকার বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে। এরমধ্যে একজনের বয়স আড়াই থেকে ৩ বছর। আরেকজনের বয়স আট থেকে দশ বছর বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ইতোপূর্বে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানান, প্রচন্ড বিস্ফোরণে বাড়িটির ফ্লোর ধসে পড়েছে। আস্তানায় গুলশান হামলার মাস্টারমাইন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তামিম চৌধুরীসহ শীর্ষ জঙ্গীদের যাতায়াত ছিল। বছরখানেক ধরে আব্দুল্লাহর সন্ধান চলছিল। আস্তানাটি আবিষ্কৃৃত হওয়ায় দেশ ও জাতি বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে। বাড়িটি ভাড়া নিয়ে আব্দুল্লাহ ও তার সহযোগীরা বড় ধরনের নাশকতা চালাতে বিপুল বিস্ফোরক মজুদ করেছিল।
×