ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুরে এসেছি আইসল্যান্ড

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঘুরে এসেছি আইসল্যান্ড

প্রায় ২২ বছর আগে আমি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নরওয়ের উত্তরাঞ্চলের ভার্দু শহরে ৫ দিনরাত ছিলাম। নিশিথ সূর্যের দেশ নরওয়ের ভার্দুতে একাধারে শীতকালে কয়েক মাস ধরে সূর্য দেখা যায় না। নিকষ আধারে দিন রাতের হিসাব ঘড়ি ধরে রাখেন সেখানকার জনগণ। আমি ৫ দিন রাতের একটানা সময়ে সূর্যের দেখা না পেয়ে সেই অন্ধকারে নিজেকে এবং সহযোগীদের অস্তিত্ত্বকে গভীর আত্ম সন্দীপনায় সমর্পণ করেছিলাম। তখন থেকে আমার ইচ্ছে হয়েছিল যে আমি উত্তর মেরু সংলগ্ন এসব এলাকায় আবার যখন সূর্য ৩ মাস ধরে এক নাগাড়ে ডুবে যাবে না তখন আগের অনুভূত নিজের অস্তিত্বকে গভীর উপলব্দির নিলয়ে বিপরীত পরিবেশে অনুভব করার চেষ্টা করব। সেই সুযোগ এল ২০১৭-এর জুন মাসে। স্ত্রী সিতারা, ছেলে জয় ও তার ছেলে অনিম এবং মেয়ে অড়িকে নিয়ে আইসল্যান্ড ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম ১ সপ্তাহ ধরে। বিষুব রৈখিক উষ্ণ এলাকার অধিবাসী হিসাবে উত্তর মেরু সংলগ্ন এই প্রায় চির তুষারের দেশে সেখানকার ভূ-প্রকৃতি ও জনমানুষের সঙ্গে পরিচিতি ও মেলামেশা ছিল এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। মে মাসের এক সকালে আমরা আইসল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ক্যাফলাভিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামি। সেখানে আগ থেকে ভাড়া করা একটি সুপরিসর এসইউভি নিয়ে আমাদের যাত্রা হয় শুরু। ইউরোপের চেক এলাকা থেকে আগত এক তরুণ কর্মী জয়কে গাড়ির নিয়ন্ত্রণীয় প্রক্রিয়াটি বুঝিয়ে দিয়ে চাবিটি হাতে তুলে দেন। তিনি বলেন যে কোন জায়গায় গাড়িটি থেমে গেলে কিংবা ওর কোন মেরামত প্রয়োজন হলে আমরা যেন তার দেয়া কাগজে লেখা মোবাইলে যোগাযোগ করি। তিনি হেসে হেসে আরও বলেন যে জনবিরল মহাসড়কে মেষের পাল মাঝে মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসে। সে সময় সাবধানে আমরা যেন সেসব পালকে এড়িয়ে চলি। মেষ আঘাত পেলে বা নিহত হলে স্থানীয় চাষী সড়কে উঠে প্রতিবাদ করবেন। প্রায় ৭ মিনিটে গাড়ির এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব এলাকায় এ ধরনের সহজ ও ঝামেলাবিহীন গাড়ি ভাড়া ও হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া আমাকে আকৃষ্ট করে এসেছে। আমাদের উপমহাদেশে, এমনকি এশিয়ার কোন দেশেই এ ধরনের ঝামেলা মুক্ত গাড়ি ভাড়া করা ও চালানোর প্রক্রিয়া প্রবর্তন করতে সমর্থ হইনি। আমাদের এই মহা কিংবা উপমহাদেশে পর্যটন প্রসারণের পথে এই একটি বড় অন্তরায় রূপে এখনও রয়ে গেছে। ক্যাফলাভিক বেশ প্রশস্ত অথচ জনবিরল বিমান বন্দর। এই জনবিরলতা আইসল্যান্ডের একক বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় মাঝখানে অবস্থিত এই দেশটির আয়তন প্রায় ৪০ হাজার বর্গমাইল। আর লোকসংখ্যা মাত্র ৩ লাখ ৩২ হাজার। এই মাত্রার জনবিরলতা সত্ত্বেও দেখে আশ্চর্য হলাম যে বিমানে উঠা-নামা, অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসন এবং জনগণের গমনাগমন প্রায় আপনা আপনি ছেদবিহীনভাবে নিপুণতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে হাসি মুখে প্রফুল্ল চিত্তে পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের দেশের বিমানবন্দরে এদের অভিবাসন ও প্রশাসন বিষয়ে এ দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ কিছু শিক্ষণীয় বিদ্যমান বলেই আমার ধারণা। জেনে স্বস্তি পেলাম যে, আইসল্যান্ড পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ যেখানে মাথাপিছু আয় বছর প্রতি প্রায় ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার। দেশে বিদ্যমান বিশাল জলবিদ্যুত উৎপাদনের কাঠামো ও ভূ-গর্ভস্থ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রায় অশেষ মজুদের ভিত্তিতে আইসল্যান্ডে মাথাপিছু হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বিদ্যুত উৎপাদিত হয়। বিশ্ব শান্তি সূচক অনুযায়ী আইসল্যান্ড পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে শান্তিপূর্ণ দেশ। উপকূল রক্ষীবাহিনী ন্যাটো চুক্তির মোড়কে এর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। যুক্তরাষ্ট্রের সতেজ বিমান ঘাঁটি বিদ্যমান। আইসল্যান্ডে উপকূল রক্ষীবাহিনীর বাইরে কোন আনুষ্ঠানিক সামরিক বাহিনী নেই। এদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অতি উচ্চমাত্রার। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে আইসল্যান্ড সারা পৃথিবীতে প্রথম (২০০৭-২০০৮)। তেমনি প্রখ্যাত ইকনোমিস্ট পত্রিকার হিসেব অনুয়ায়ী (২০১১) আইসল্যান্ডের জীবনের উৎকর্ষ সারা পৃথিবীতে ২য় শীর্ষতম। আইসল্যান্ডে কোন রেলপথ নেই। পরিবহনের প্রধান মাধ্যম সড়ক যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩ হাজার মাইলেরও বেশি। আইসল্যান্ডে মাথাপিছু গাড়ির মালিকানা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি; প্রতি দেড়ডজন মানুষের জন্য এ দেশে একটি গাড়ি রয়েছে। আমরা ভাড়ায় নেয়া এসইউভি নিয়ে বিমানবন্দর থেকে রাজধানী রিকজাভিকে গিয়েছি। পথিমধ্যে প্রায় জনবিরল সড়কের দু‘ধারে প্রত্যক্ষ করেছি আইসল্যান্ডের পরিবেশবান্ধব ভূ-প্রকৃতি। রিকজাভিক আইসল্যান্ডের সবচাইতে বড় শহর ও রাজধানী। দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক এই রাজধানীতে বাস করে। যেমনই দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সাওলে সেদেশের এক তৃতীয়াংশ লোকের বাস। কেফলাভিক থেকে রিকজাভিক এর দূরত্ব ৫০ মাইল। যাওয়ার পথে দুজায়গায় থেমে কাছ থেকে ভূ-গর্ভস্থ বাষ্প ধূসর ধোঁয়ার মতো ভূমির ওপরে কু-লী পাকিয়ে উঠতে দেখেছি। এদের ঘিরে রয়েছে উষ্ণ প্রস্র্রবণ। যেখানে পর্যটকদের সঙ্গে আইসল্যান্ডিরা পা ডুবিয়ে শীতের পরিম-লে উষ্ণতার অনুভূতি পেয়ে অনাবিল আনন্দ এবং সম্ভবত একসঙ্গে এক জায়গায় সমঅধিকারী মানুষ হিসেবে বাঁচবার কবোষ্ণ জীবনানুগ অনুভূতি আত্মীকৃত করেন। রিকজাভিকে যখন পৌঁছেছি তখন স্থানীয় সময় রাত ৯টা অথচ বাইরে আমাদের দেশের দিনের মতো আলো ছড়ানো চারদিক। রিকজাভিক সমুদ্রের পারে অবস্থিত প্রায় ৩ দিকে পানি ঘেরা এক শহর। ঘড়ির কাঁটার রাত ১০ টায় দিনের আলোর মতো ঝলমলে পরিবেশে স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ মানুষজন উদ্বেগবিহীনভাবে সমুদ্র পাড়ে হাঁটছেন। কেউ কেউ সড়ক পথের কয়েক স্থানে পরম যতেœ সৃজিত বাগানে বসে আছেন এবং ছিটানো ছড়ানো রেস্তরাঁতে বসে রাতের খাবার খাচ্ছেন। কলকাকলী মুখরিত পরিবেশে কোন জটলা নেই, ভিড় নেই, কারও সঙ্গে কারও বিবাদ নেই, প্রকৃতির প্রদত্ত অফুরানো সম্পদের পরশে সবাই জীবনকে সৃষ্টির আশীর্বাদ হিসেবে উপভোগ করেছেন। রিকজাভিকের এই প্রকৃতি অনুগত মানবিক পরিবেশ আমাদের মনকে স্পর্শ করেছে। বিস্ময়ের সঙ্গে আমি ভেবেছি কেমন করে বৈভবের ভিত্তিতে নির্মোহভাবে নিজের অনুভূতিকে ছড়িয়ে দিয়ে নিজকে সুযোগ-সমৃদ্ধ সমঅধিকার সম্পন্ন মানুষ হিসেবে সবাই ভাবতে ও প্রযুক্ত করতে পারে। ভেবেছি, আমাদের দেশে সমঅধিকারী চেতনাবোধ বিস্তৃত করার পরিধি এখনও বিস্তৃত। রাত ১১টার দিকে পূর্ব নির্ধারিত একটি হোটেলে আমরা উঠেছি। তখনও ঘুমাতে যাওয়ার কোন আকর্ষণ বাইরের রোদেলা রাতের পরিবেশে আমরা অনুভব করিনি। হোটেলের ম্যানেজার সুদেহী মহিলা আমাদের বলেছেন ঘুমাতে হলে জানালার সকল ভারি পর্দাগুলো টেনে নিও। আমি পর্দা টানতে গিয়ে জানালা সংলগ্ন একটি চেয়ারে বসে রাতের মাধুরিময় রোদেলা দুপুর দেখতে চেয়েছি। অনিম তার বিছানা থেকে নেমে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে কখন আজকের দিন কালকে হবে। উত্তরে আমি হেসেছি, কোন কিছু গুছিয়ে বা বুঝিয়ে বলতে পারিনি। তার পরদিন হোটেলের উন্মুক্ত টেবিল থেকে নিজেদের নাস্তা ও কফি নিজেরা গুছিয়ে নিয়ে সড়ক পারের খোলা টেবিলে বসে ধীরে ধীরে খেয়েছি। তারপর নাস্তার নির্ধারিত দাম নিজেরা একটি বাক্সে জমা দিয়ে বেরিয়ে পরেছি আইসল্যান্ডের মাঝখান দিয়ে টেনে দেয়া মহাসড়কে। রিকজাভিক থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল আরকানাইজ। যাওয়ার পথে কয়েক জায়গায় উষ্ণ প্রস্র্রবণ দেখেছি। সমুদ্রের পার ঘেঁষে সড়ক পথকে ভূমি আর ঢেউ দোলানো জলরাশির মাঝখানের সীমা রেখা হিসেবে আকাশ ছড়ানো নীলের পটে দেখে ধীর ছন্দে এগিয়েছি। পথে কোন ধারে তেমন কোন লোকালয়ের আভাস দেখিনি। কেবল কয়েকটি সীমা চিহ্নিত খামারে চড়তে থাকা মেষ শাবক ও ঘোড়া দেখে এসব এলাকায় মানুষের বাসের নিশানা পেয়েছি। যা সবচেয়ে বেশি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো সড়ক পথের পরিচ্ছন্নতা । কোথাও কোন আবর্জনা, এমনকি কাগজ বা প্লাস্টিকের টুকরোও নেই। পাশের ছোট বড় গাছগুলোর ওপর পরম যতেœর ছোপ আইসল্যান্ডজুড়ে মানুষের গাছগাছালির পরিচর্যা করার এক মোহনীয় ছোপ আমাদের অবাক করেছে। পথমধ্যে এক রেস্তরাঁয় সুহাসিনী সেবিকা বললেন যে, সারা আইসল্যান্ডে কয়েক বছর আগ থেকে গাছ লাগানোর এক বিরাট সামাজিক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। যেতে যেতে দূরে সাগরে ভাসা ধীর গতির মাছ ধরার জাহাজ দেখেছি। আমাদের বলা হয়েছে সেই রেস্তরাঁয়, যে পৃথিবীর সবচাইতে বেশি তাজা সামুদ্রিক মাছ মানুষকে একমাত্র আইসল্যান্ডের রেস্তরাঁগুলোই খাওয়াতে সক্ষম। এই উক্তির বিপরীতে কোন প্রমাণ স্বাদে বা দৃষ্টিতে আমরা আইসল্যান্ডে দেখিনি। একই মহাসড়ক ধরে আরকানাইজ থেকে তার পরদিন আমরা গিয়েছি বাউলা। বাউলা থেকে বেশ কয়েকটি সুড়ঙ্গ বা টানেলের ভিতর দিয়ে পৌঁছেছি বলনদুসে। পথে দেখেছি পাহাড়ের পটে হিমশৈল আর জলপ্রপাত। আকাশের নীলের নিচে এত স্পষ্ট পটভূমিকায় হিমশৈলগুলো পাহাড়ের উপত্যকা ধরে নেমে আসা রোদে ঝলমল হিমবাহ বা বরফের প্রবাহ আমাদের মনকে করেছে প্রকৃতি আকুল। পৃথিবীর অন্য কোথাও প্রকৃতির এক পটে অমলিনভাবে মিলানো নিপুণ শিল্পীর তুলিতে তুলে ধরা এখন ছবি আমাদের চোখে খুব বেশি পারেনি। এর পরে আকুইরি পৌঁছে ঘড়ি ধরে দিনের আলোয় আরেক রাত্রি যাপন। আকুইরি আইসল্যান্ডের ২য় বৃহত্তম শহর। এ শহরের সমুদ্র তীর থেকে দেখা যায় তিমি মাছের বহর। উত্তর আমেরিকার নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে এ ধরনের তিমির শোভা যাত্রা এর আগে আমাদের দেখা। আমাদের চোখে এই আকুইরির পার ঘেঁষে অসংখ্য ঝাঁক ঝাঁক তিমির দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রে মুক্ত বিচরণ ফকল্যান্ডের দক্ষিণ মেরু সংলগ্ন দক্ষিণ মহাসাগর ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না। আকুইরিতে আবার সেই দিনের আলোয় মোড়া রাত কাটিয়ে তার পরদিন আমরা ডেটিফোসের সেই নামকরা জলপ্রপাত দেখতে গিয়েছি। ডেটিফোসের জলপ্রপাত ইউরোপের মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী জলপ্রপাত হিসেবে নাম কেড়েছে। জনবিরল দুই পাহাড়ের চূড়া থেকে সমতলে প্রবল বেগে ফেনা ছড়িয়ে নেমে আসা এই জলপ্রপাত প্রকৃতির এক অবিস্মরণীয় পরিচয় বহন করছে। মনে হয় আকাশ থেকে পাহাড়ের চূড়া বেয়ে নেমে আসছে জীবনের সঞ্জীবনী। ডেটিফস থেকে জনবিরল সেই মহাসড়ক ধরে আমরা পৌঁছেছি এগলাসতায়র শহরে। এই শহরের লাগোয়া ফিওর্ডগুলো উত্তর মহাসাগর থেকে নীল জলরাশিকে আইসল্যান্ডের ভিতরে ঢুকিয়ে আকাশের নীল আর দু’ধারের পাহাড়ের ধূসরের ছটার সঙ্গে সরু সমতল ভূমির এক অপূর্ব লীলার মেলবাঁধনে ধরে রেখেছে বলে মনে হলো। ঘড়ি ধরে রাত্রির সময় জেনে আলোয় মোড়া শহরে ঘুরে ঘুরে দেখেছি মুক্ত মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং প্রকৃতির মাঝে নিজেদের অস্তিত্বকে অবলীলায় প্রকাশ করানো চলাফেরা। এগলাসতায়ের থেকে তার পরদিন উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তীর ধরে ইউরোপের সবচাইতে বড় হিমবাহ ভাতনাজুকুল ডানে রেখে আমরা থেমে থেমে উপভোগ করেছি প্রকৃতি প্রদত্ত আকাশ মাটি আর জলরাশির লীলাখেলা। এ মহাসড়ক আমাদের নিয়ে গেছে ডায়েরহোল যা আইসল্যান্ডের সর্ব দক্ষিণ বিন্দু। এই ডায়ারহোলে দু’পাশে সমুদ্রের বেলাভূমি কালো। বলা হয়েছে পেছনের ভূমিতে লভ্য এবং সময়ের ব্যপ্তিতে পাহাড় থেকে নেমে আসা খনিজের গুঁড়ো ছড়িয়ে যুগের পর যুগ ধরে গড়ে উঠেছে এই কালো বেলাভূমি। এই ধরনের কালো বেলাভূমি আমরা পৃথিবীর অন্য কোন স্থানে দেখেনি। এই সহাসড়কের পাশে রয়েছে কাতলা আগ্নেয়গিরি, যা থেকে সর্বশেষ অগ্ন্যুপাত ঘটেছিল ১৯১৮ সালে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এর থেকে আরেকটি অগ্ন্যুপাতের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এর অদূরেই আরেক আগ্নেয়গিরি, ইফজাকুলল, যার সর্বশেষ অগ্ন্যুপাত ঘটেছিল ২০১০ সালে। এই আগ্নেয়গিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত ভস্মকণা সে বছর আটলান্টিক মহাসাগরের দু’তীরে বিমান পরিবহন বিপর্যস্ত রেখেছিল দু’সপ্তাহ ধরে। সেখান থেকে মহাসড়ক ধরে আমরা ফিরে এসেছি রাজধানী রিকজাভিকে। প্রকৃতিকে বিনষ্ট না করে প্রকৃতির মাঝে জীবন সমৃদ্ধ করে থাকা এই নগরীতে আবার আরেক রোদেলা রাত্রি থেকে পরদিন ক্যাফলাভিক বিমানবন্দর হয়ে ফিরে গিয়েছিলাম আটলান্টিকের ওপাড়ে আমেরিকাতে। আইসল্যান্ডে এই ৭ দিন ধরে ঘুরে এই দেশটির আপেক্ষিকতায় আমাদের দেশে করণীয় কতিপয় পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে আমরা সচেতন হয়েছি। এক. আইসল্যান্ডে প্রকৃতির অমলিন পরিবেশকে নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণের এক বিরল চেতনাবোধ আমাদের মোহিত করেছে। আমরা আমাদের দেশে অভাবের তাড়নায় কিংবা প্রাচুর্যের প্রাপ্তির ফলশ্রুতিতে প্রকৃতিকে যথাযথভাবে রক্ষা করিনি এবং এভাবে রক্ষা না করে নিজেদের জীবনকে প্রকৃতির আশীর্বাদের নিলয় হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হইনি। আইসল্যান্ডের এ ক্ষেত্রে সামাজিক চেতনাবোধ আমাদের দেশের প্রাকৃতিক আশীর্বাদকে যুগ যুগ ধরে জিইয়ে রাখার সন্দীপন দিতে পারে। দুই. আইসল্যান্ডে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক সমতার অবিচ্ছেদিয় নারী-পুরুষের সমতা ও মুক্ত চালচলন আমাদের মুগ্ধ করেছে। সকল মানুষকে সমান অধিকারী হিসেবে মনে করে পূর্ণ মাত্রায় সামাজিক বিকাশ অর্জনে আমরা এখন পিছিয়ে গেছি। আইসল্যান্ডসহ অন্য স্ক্যান্ডিনিভিয়ান দেশসমূহে দৃষ্ট ও অনুসৃত লিঙ্গ সমতার পরিপূর্ণতা আমাদের সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সঞ্জীবিত করতে পারে। তিন. আইসল্যান্ডের মাছ ধরা সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের শৈলী থেকে আমরা আমাদের সম্প্রতি ক্রমাগতভাবে বেড়ে আসা মৎস্য সম্পদ থেকে সর্বাত্মক উপযোগ গ্রহণ করতে পারি। বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক মাছ আহরণ ও সংরক্ষণ, আহরিত মৎস্য প্রক্রিয়াজাত ও রফতানিকরণ প্রক্রিয়া আমরা আইসল্যান্ডের অভিজ্ঞতার আলোকে উন্নততর ও অধিকতর ফলপ্রসূ করতে পারি। এ লক্ষ্যে আমাদের মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন আইসল্যান্ডের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠাতে পারেন। একই সঙ্গে আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (ময়মনসিংহ) তাদের মৎস্য বিভাগে কর্মরত শিক্ষক ও গবেষকদের আইসল্যান্ডের সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সহযোগিতামূলক কার্যক্রমে যুক্ত করতে পারেন। আইসল্যান্ডের কতিপয় কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনার আলোকে বলা চলে যে এই ধরনের গবেষণা জানাবেন। চার. আইসল্যান্ডে শ্রমস্বল্পতা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আমরা এখনও সেখানে মানব সম্পদ রফতানির পদক্ষেপ নেইনি। আইসল্যান্ডের কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে আমার ধারণা হয়েছে যে সেদেশের নির্মাণ ও সেবা ক্ষেত্রে তারা আমাদের দেশ থেকে প্রেরণীয় শ্রমিকদের স্বাগত জানাবেন। এই লক্ষ্যে আইসল্যান্ড সরকার এবং সেখানকার ব্যক্তি উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা ও সমঝোতা হওয়া দু’দেশের জন্যেই কল্যাণকর হবে বলে আমার ধারণা। আমাদের শ্রমিকরা বৈধ ও অবৈধ উভয় পথ ধরেই উত্তর ইউরোপের অন্য দেশসমূহে গিয়ে লাভজনক কর্ম সংস্থান পেয়েছেন। এসব দেশের জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের দেশের শ্রমিকরা প্রমাণ করেছেন যে আইসল্যান্ডে তারা সক্ষমতার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণ করা যেতে পারে সারা আইসল্যান্ডে স্বাস্থ্য সেবা এবং শিক্ষা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যয় মুক্ত। লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আমলা
×