ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফজলুল হক খান

বন্যা ॥ ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলাই রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২৮ আগস্ট ২০১৭

বন্যা ॥ ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলাই রাজনীতি

সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যা রূপ নিয়েছে মহাপ্লাবনে, গ্রাস করে নিয়েছে সমগ্র দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূখন্ড। লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন, অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট নিয়ে কলাগাছের ভেলা, নৌকায় করে দিগি¦দিক ছুটে বেড়াচ্ছে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এত মানুষের সংস্থান করা, দু’বেলা দু’মুঠো খাবার মুখে তুলে দেয়া, রোগ-ব্যাধিতে ওষুধপত্র, চিকিৎসাদান ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ফলে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মানুষ যাপন করছে এক মানবেতর জীবন। বন্যাদুর্গত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। সীমিত সম্পদ নিয়েই তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে সমস্যা দেখা দিয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে মানুষের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। সরকার ইতোমধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সচল করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। বন্যার পানিও হ্রাস পেতে শুরু করেছে। আশা করা যায়, দু’এক সপ্তাহের মধ্যে উপজেলাগুলোর সঙ্গে জেলা শহরসমূহের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্স্থাপিত হবে। সুতরাং আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সবাই এগিয়ে আসা উচিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে, পরবর্তী ফসল ঘরে না ওঠা পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। তবে এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব, অন্ন, বস্ত্র, ওষুধপত্রের সংস্থান করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে এসেছেন। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী যে যা পারছেন তুলে দিচ্ছেন বন্যাদুর্গতদের হাতে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক, সামাজিক-সমাজসেবী সংগঠনগুলোরও অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত। আনসার, পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীর সদস্যরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন বন্যাদুর্গতদের সেবায়। মেডিক্যাল টিমগুলোও বন্যাদুর্গতদের সেবায় দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। বন্যাদুর্গত মানুষের সহযোগিতার ক্ষেত্রে সর্বস্তরের মানুষের আন্তরিকতা দেখে মনে হয় বন্যাসৃষ্ট দুর্যোগ অচিরেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সহানুভূতির সঙ্গে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে এক খ- রুটি কিংবা একমুঠো ভাত তুলে দেয়া, তাদের শক্তি ও সাহস যোগানো প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। রাজনৈতিক স্বার্থে বন্যাকবলিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে পুঁজি করে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে দূর থেকে দাঁড়িয়ে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা প্রত্যক্ষ করা এবং সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে মানুষকে উপহাস করা অত্যন্ত দুঃখজনক। রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য। তাই ঐক্যবদ্ধভাবে বন্যা মোকাবেলাই হলো রাজনীতি। মানুষের কল্যাণের রাজনীতি যদি দাবা খেলায় পরিণত হয়, মানুষকে সেবা করার পরিবর্তে, যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার পরিবর্তে দাবার চালে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার রাজনীতির প্রবণতা শুরু হয় তবে সে রাজনীতির কাছে মানুষের বিবেক বুদ্ধি পরাজিত, ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে বৃহত্তর স্বার্থ ক্ষুণœ। সভ্য মানুষ, সভ্য জাতি রাজনীতিতে দাবা খেলা দেখতে চায় না, দেখতে চায় মানুষের কল্যাণে রাজনৈতিক দর্শন। বন্যার জন্য কাউকে দোষারোপ না করে একটা বাস্তব সত্যকে স্বীকার করা উচিত। আমরা যে ভৌগোলিক অবস্থানে বসবাস করছি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের ইন্টারভেলে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েছে। ১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় গোর্কি। গোর্কির আঘাতে বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫ লাখের ওপর। ১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিল কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারায় ১৫ হাজার। ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০১৩ সালে মহাসেনসহ এ ধরনের আরও ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় অঞ্চলে বয়ে গেছে। তবে এসব ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যা খুবই কম। এর অর্থ এই নয় যে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা কম ছিল। শুধু সতর্কতামূলক পূর্ব প্রস্তুতির কারণে প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছরই কম-বেশি বন্যা হয়। তবে ১৯৭৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮ এবং ২০০৪ সালের বন্যা ছিল স্মরণকালের উল্লেখযোগ্য। তার মধ্যে ১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী। মহাপ্লাবনে গ্রাস করেছিল সমগ্র দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ভূখ-, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি মানুষ। বিদেশীদের এবং বিরোধী দলের ভাষ্য ছিল ১ কোটি মানুষ অনাহারে মারা যাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উক্ত দুর্যোগ মোকাবেলা করেছিল। দুর্যোগকে মোকাবেলার জন্য আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। এত বড় বিপর্যয়, এত বড় দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য ’৭১-এ আমরা যেমন পরস্পরের হাত ধরে বাঁচতে শিখেছি, তেমনি সমগ্র জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানব কল্যাণে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং প্রকৃতিকে কিভাবে জয় করা যায়, কি ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন সে সম্পর্কে কোন আলোচনা হয় না। আলোচনা যেটুকু তার সবটুকুই বন্যার উৎস কথা সম্পর্কিত। ভারতে বন্যা হওয়ার দরুন ফারাক্কা বাঁধ কিংবা তিস্তা ব্যারাজ খুলে দেয়ার জন্য আমাদের দেশে বন্যা এ প্রচারণাই বেশি চলে। একটা কথা আমরা ভুলে যাই যে, অর্থনীতির ধর্ম মুনাফার দিকে ধাবিত হওয়া আর পানির ধর্ম নি¤œদিকে প্রবাহিত হওয়া। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ীই আমাদের দেশে বন্যা হবে এ জন্য কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। প্রকৃতি আমাদের যেমন দিয়েছে দুর্যোগ তেমনি দিয়েছে উর্বর মাটি। বন্যায় ফসলের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব তবে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। পরবর্তী ফসল না ওঠা পর্যন্ত কৃষি পুনর্বাসন কার্যক্রম, সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী গ্রহণ করা উচিত। এর ইতিবাচক সুফল অবশ্যই পাওয়া যাবে। তবে দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম হিসেবে বিভিন্ন শহর এবং এলাকা রক্ষা বাঁধগুলো সংস্কার ও মেরামতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকাকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা এবং বন্যাদুর্গত মানুষ ও গবাদি পশুর নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি খাদ্য মজুদ বৃদ্ধির জন্য বাফার স্টক, বন্যামুক্ত এলাকায় এলাকাভিত্তিক খাদ্য গুদাম নির্মাণও প্রয়োজন- যাতে করে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ায় কোন বিঘœ না ঘটে। এ জন্য বাস্তবমুখী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। শুধু বন্যার উৎস কথা নিয়ে আলোচনা কিংবা বন্যার জন্য কাউকে দায়ী করে মানুষকে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা যেতে পারে তাতে বন্যা থেমে থাকবে না এবং দেশের মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করাও সম্ভব হবে না। লেখক : বীমা ব্যক্তিত্ব
×