নিখিল মানখিন ॥ রাজধানীতে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত চার দিনে নগরীতে শনাক্ত হয়েছে ৬০ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী। চলতি মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯৭ জনে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে মোট ৯৯৮ জন, যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। বেসরকারী হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডেঙ্গুর বিস্তার আগামী অক্টোবর পর্যন্ত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জুলাই থেকে অক্টোবর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। সে অনুযায়ী সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আরও বৃদ্ধি পাবে। আর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব চিকুনগুনিয়ায় আতঙ্কিত নগরবাসীর দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
চিকুনগুনিয়ার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ডেঙ্গু রোগী! কিন্তু সরকারী পরিসংখ্যানে রাজধানীতে বৃদ্ধি পেয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত জানুয়ারি থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত ৯৯৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। বেসরকারী হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাজধানীতে সারাবছর ডেঙ্গুর প্রকোপ। এখন আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার নির্ধারিত মৌসুম নেই। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক এডিস মশা হওয়ায় বিষয়টি রাজধানীর মশক নিধনকারী কর্তৃপক্ষসহ বিশেষজ্ঞদের বেশিমাত্রায় ভাবিয়ে তুলেছে। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে ইতোমধ্যে বিশেষ সভা আহ্বান করে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রাজধানীর ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই এবং এ রোগে আক্রান্তের চিকিৎসার সুব্যবস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তবে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় চিন্তামুক্ত থাকতে পারছে না নগরবাসী।
আইইডিসিআর জানায়, ২০১৬ সালে প্রায় তিন হাজার ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। ২০১৫ সালের মার্চে দুজন, এপ্রিলে দুজন, মে মাসে একজন, জুনে ১৫ জন, জুলাইয়ে ১৫৬ জন, আগস্টে ৭২৭ জন, সেপ্টেম্বরে ৯৬৫ জন, অক্টোবরে ৮৮০ জন, নবেম্বরে ২৬০ জন ও ডিসেম্বরে ৯০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। সূত্রটি আরও জানায়, রাজধানীতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে সাতজন, মার্চে তিনজন, এপ্রিলে তিনজন, মে মাসে ১২ জন, জুনে ৫০ জন, জুলাইয়ে ১৭২ জন, আগস্টে ৩৩৯ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৮৫ জন এবং অক্টোবরে আক্রান্ত হয় ৫০১ জন। ২০১২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ১২শ’ ৮৬ জন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা। এ মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এটি সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমরা প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাচ্ছি। তবে বর্তমানে এ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা উপযুক্ত চিকিৎসায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গু জীবাণুর উৎস এখনও বন্ধ হয়নি। এ কারণে মৃত্যুর হার কমে গেলেও আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ কমছে না। ডেঙ্গুর উৎস বন্ধ না হলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো ডেঙ্গু রোগের সরাসরি কোন প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ আরও জানান, নগরীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের মতো এ বছরও হিমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা নাক ও দাঁত দিয়ে এবং কাশির সময় রক্তক্ষরণে ভুগে থাকেন। আর আক্রান্তরা পিঠ, ঘাড়, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা অনুভূত হওয়ার কথা বলে থাকেন। তিনি বলেন, চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে জ্বর না কমলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া কোন ওষুধ দেয়া ঠিক হবে না। রোগীকে বেশিমাত্রায় পানি বিশেষ করে শরবত খাওয়ানো যেতে যারে। দিনের বেলায় ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করা উচিত। বাসায় খোলা পাত্রে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। এতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। বাসার সর্বত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পরামর্শ দেন ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। তবে আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে। নগরীর সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে অনেক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যা জানে না সরকার। কিন্তু হাসপাতাল-ক্লিনিক ছাড়াও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ডেঙ্গু রোগীর আগমন বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রম চালু নেই। পানি মেশানো ওষুধ ছিটানোর মাধ্যমেই নিজেদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখছে ডিসিসি। মশক নিধন কার্যক্রমের বরাদ্দ নিয়ে লুটপাটের খেলা চলে। বাড়তি টাকা না দিলে কোন বাসা বা এলাকায় ওষুধ ছিটান না ডিসিসির কর্মীরা। ডিসিসির এ বিভাগের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোন যোগাযোগ থাকে না। ডিসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। স্বাভাবিক মশক নিধন কার্যক্রম ও ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমের মধ্যে তারা কোন পার্থক্য দেখেন না। ফলে এডিস মশা নিধনে তারা বিশেষ সফলতা পান না। আর ডিসিসির অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার দায়ভার গিয়ে পড়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওপর বলে অভিযোগ করেছেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডাঃ তাহমিনা শিরিন বলেন, এ বছর মৌসুমের আগেই প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তাই ডেঙ্গুর আশঙ্কা থাকে বেশি। এজন্য প্রত্যেককে তার আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। কোথাও যেন বৃষ্টির পানি দীর্ঘ সময়ের জন্য জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায় এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকেও ব্যবস্থা নেয়ার কথা রয়েছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: