ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

কমবাস্টন ইঞ্জিনের যুগ শেষ!

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৩ আগস্ট ২০১৭

কমবাস্টন ইঞ্জিনের যুগ শেষ!

১৮৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ফ্রান্সের ‘লা পেতি জার্নালে’ বিলাপের সুরে বলা হয়েছিল, ‘মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি যানবাহনের চালিকাশক্তি হিসেবে অশ্বের স্থান দখল করে নেয়ার মতো কোন যান্ত্রিক প্রক্রিয়া এখনও বের করতে পারেনি।’ কথাটার জবাব দেয়ার জন্যই যেন পরের বছরের জুলাই মাসে প্যারিস থেকে রুয়ে পর্যন্ত অশ্বহীন যাদের এক ধাবন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় ১০২টি বাহন অংশ নেয় যার মধ্যে বাষ্প, পেট্রোল, বিদ্যুত, কমপ্রেশড এয়ার ও হাইড্রোলিকস চালিত বাহনও ছিল। ১২৬ কিলোমিটারের এই প্রতিযোগিতায় মাত্র ২১টি বাহন উত্তীর্ণ হয়। বিপুল দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় স্পষ্টতই বিজয়ী ছিল ইন্টারনাল কমবাস্টন ইঞ্জিন। পরবর্তী এক শতাব্দী জুড়ে এটাই শিল্পে শক্তি যুগিয়েছিল এবং বদলে দিয়েছিল বিশ্বকে। ইন্টারনাল কমবাস্টন ইঞ্জিন প্রায় এক শতাব্দী ধরে জল ও স্থলের যানবাহনের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করলেও এর দিন ফুরিয়ে আসছে। ব্যাটারি প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে এখন ইলেকট্রিক মোটরের দিন আসছে। ১৮৯৪ সালের প্যারিস প্রতিযোগিতায় একটি ইলেকট্রিক গাড়িও অংশ নিতে পারেনি। কারণ, তখন ব্যাটারির সেই শক্তিও ছিল না। আজ জ্বালানি ও পিস্টন থেকে ব্যাটারি ও ইলেকট্রিক মোটরে উত্তরণ অনেক অল্প সময়ের মধ্যে ঘটছে। ইন্টারনাল কমবাস্টন ইঞ্জিন আধুনিক জীবন গড়ে দিয়েছে। ধনী বিশ্ব মোটর গাড়ির জন্য নতুন করে নির্মিত হয়। সড়ক নেটওয়ার্ক, শহরতলি, শপিং মল, রেস্তরাঁর পেছনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়। যুদ্ধোত্তর আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে মোটরগাড়ি শিল্প অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রসারে চালিকাশক্তি হিসেবেও কাজ করেছে। বিশ্বের রাস্তায় এখন প্রায় একশ’ কোটি গাড়ি চলছে। এর প্রায় সবই জীবাষ্ম জ্বালানি চালিত। আমেরিকার গাড়ি ও লরি ইঞ্জিনগুলো সে দেশের বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর তুলনায় ১০ গুণ বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারে। ইন্টারনাল কমবাস্টন ইঞ্জিন হচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী মোটর। কিন্তু ব্যাটারির মাধ্যমে মোটরে বিদ্যুতায়ন মোটর শিল্পকে টালমাটাল অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। মোটর গাড়ির সেরা সেরা ব্র্যান্ডগুলো তাদের প্রকৌশলগত উৎকর্ষতা ও ঐতিহ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিতÑ বিশেষ করে জার্মানিতে। বর্তমান মোটর গাড়িগুলোর তুলনায় ইলেকট্রিক কারগুলো অনেক সহজ এবং এর খুচরো অংশও কম। বরং বলা যায় এগুলো হচ্ছে চাকার ওপর কম্পিউটার, তার অর্থ ইলেকট্রিক কার সংযোজনে লোক লাগে কম। স্পেশালিস্ট সাপ্লায়ারদের তরফ থেকে সাবসিডিয়ারি ব্যবস্থাও লাগে কম। প্রচলিত মোটর গাড়ি কারখানার শ্রমিকরা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে, ইলেকট্রিক কারের জন্য তাদের বলির পাঁঠা হতে হবে। গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রাংশের বাজারও সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। গত বছর বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছিল সাড়ে ৭ লাখ। অর্থাৎ নতুন গাড়ির বাজারের ১ শতাংশের কম। সেদিক চিন্তা করলে প্রচলিত গাড়ি কোম্পানিগুলোর এ মুহূর্তে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। তবে ইলেকট্রিক গাড়ি শীঘ্রই বড় ব্যবসায় ফেঁদে বসতে যাচ্ছে এমন ধারণা অবশ্য অনেকেই পোষণ করেন এবং আগের চেয়ে বেশিই করেন। পুরো এক ট্যাঙ্ক পেট্রোলে যতদূর যাওয়া যায় তার কাছাকাছি পাল্লার ইলেকট্রিক গাড়ি যেগুলো ব্যাপক হারে খদ্দের পাচ্ছে যেমন টেলসা ৩ এবং জিএম শেভ্রলেট বোল্ট হার্শ্বে বাজারে সাড়া জাগিয়েছে। লিফ কোম্পানির ইলেকট্রিক গাড়িও নতুন আঙ্গিকে বাজারে আসছে। এই গাড়িগুলো পেট্রোল-ডিজেলের গাড়ির মতো একই প্রোডাকশন লাইনে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। তার অর্থ এই গাড়িগুলোর প্রসার আরও সহজে ঘটতে পারে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন যে, একটি ইলেকট্রিক গাড়ি কেনা ও চালানোর জীবনকালীন খরচ কয়েক বছরের মধ্যে তেলচালিত গাড়ির সঙ্গে তুলনীয় হবে। তার ফলে ইলেকট্রিক গাড়ির বিক্রি ২০২০-এর দশকে যথেষ্ট বেড়ে যাবে এবং ২০৩০-এর দশকের কোন এক সময় বিশ্বের বেশিরভাগ গাড়িই হবে ইলেকট্রিক গাড়ি। গত বছর যত ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে তার মোটামুটি অর্ধেকই বিক্রি হয়েছে চীনে। চীন ২০২০ সালের মধ্যে তার রাস্তায় ২০ লাখ এবং এক দশকের মধ্যে ৭০ লাখ ইলেকট্রিক ও প্লাগ-ইন হাইব্রিড গাড়ি দেখতে চায়। তেল কোম্পানিগুলোর পূর্বাভাস হচ্ছে ইলেকট্রিক গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। ওপেক মনে করে ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বের রাস্তায় এমন গাড়ির সংখ্যা দাঁড়াবে ২৬ কোটি ৩০ লাখ। ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয়েই বলেছে যে ওই সময় নাগাদ সম্পূর্ণরূপে ইন্টারনাল কামবাস্টন ইঞ্জিননির্ভর নতুন গাড়ির নির্মাণ নিষিদ্ধ হবে। এমনটা চিন্তা করাও যে সম্ভব হয়েছে সেটা হয়েছে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবসার অবিস্মরণীয় সম্প্রসারণের কারণে। সেই ব্যবসা আরও বিশাল আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। এই ব্যাটারির বদৌলতে আজ ইন্টারনাল কমবাস্টন ইঞ্জিনের জায়গায় আসছে ইলেকট্রিক প্রপালশন। আর সে কারণেই ইলেকট্রিক গাড়ির বিস্তার সম্ভব হয়ে উঠছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে আগামীতে ইন্টারনাল কমবাস্টন ইঞ্জিননির্ভর মোটর গাড়ি শিল্প ৯০ শতাংশ সঙ্কুুচিত হয়ে আসতে পারে। ইলেকট্রিক কার এবং সেই সঙ্গে বাইড-হেইলিং ও স্বয়ংচালিত প্রযুক্তির বদৌলতে নগরীগুলো কার পার্কিংয়ের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে পারবে। সেখানে গড়ে উঠতে পারবে নতুন আবাসন। কোন কোন নগরীর ২৪ শতাংশ এলাকাই কার পার্কিং খেয়ে শেষ। ইলেকট্রিক গাড়ি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যেরও বিশাল উপকার বয়ে আনবে। ইলেকট্রিক গাড়ি পেট্রোল চালিত গাড়ির তুলনায় কার্বন নির্গমন ৫৪ শতাংশ কমিয়ে দেয়। ইলেকট্রিক গাড়ির প্রযুক্তি যতই বেশি দক্ষ হয়ে উঠবে এবং বিদ্যুত উৎপাদন যত বেশি পরিবেশবান্ধব হবে কার্বন নির্গমন তত বেশি হ্রাস পাবে। স্থানীয় বায়ু দূষণও কমে আসবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ঘরের বাইরের পরিবেশ দূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী বছরে ৩৭ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। সমীক্ষায় দেখা গেছে আমরিকায় প্রতি বছর মোটর দুর্ঘটনায় ৩৪ হাজার লোক মারা যায় এবং অন্যদিকে গাড়ির ধোঁয়ার কারণে মারা যায় ৫৩ হাজার আমেরিকান। ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাপক বিস্তার ঘটলে তেলের চাহিদাও কমে যাবে। আমেরিকায় যত তেল খরচ হয় তার দুই-তৃতীয়াংশই ব্যয় হয় রাস্তায় অর্থাৎ যানবাহনে সেই তেলের সিংহভাগ বেঁচে যাবে। চাহিদা কমে আসায় তেলের দামও কমবে। তেল শিল্পে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টান ধরবে। সৌদি আরবের মতো তেল উৎপাদক দেশগুলো তেলের বিশাল আধার নিয়ে চাপের মুখে পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক কমে আসবে। হাইড্রো কার্বনের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর আয় কমে যাওয়ায় সেগুলো গভীর সঙ্কটে পড়বে। দেশগুলোতে দেখা দেবে অস্থিরতা। ইলেকট্রিক গাড়ি বাজার দখল করবে ঠিকই। তাই বলে ইন্টারনাল কমবাস্টন ইঞ্জিনের দিন একেবারে ফুরিয়ে যাবে না। আগামী আরও কয়েক দশক শিপিং ও এভিয়েশনের ক্ষেত্রে এর আধিপত্য থাকবে।
×