ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাবুল হোসেন

গৌরীপুর শালিহর গণহত্যা দিবস

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২১ আগস্ট ২০১৭

গৌরীপুর শালিহর গণহত্যা দিবস

আজ একুশ আগস্ট, ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার শালিহর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে স্থানীয় আলবদরদের সহায়তায় পাক সেনারা হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম শালিহর গ্রামে হানা দিয়ে একজন মুসলমান ও ১৩ জন হিন্দুকে হত্যা করে। গুলির মুখ থেকে কলেমা পাঠ করে সেদিন প্রাণ বাঁচান নগেন্দ্র চৌকিদার। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪০ বছর পর গত ২০১১ সালে শালিহর গ্রামে শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও তাতে নেই শহীদদের নাম ফলক। অযত্ম অবহেলায় স্মৃতিস্তম্ভটির বেহাল দশা দেখে হতাশ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ নতুন প্রজন্ম। তবে গত দুই বছর ধরে স্মৃতিস্তম্ভ প্রাঙ্গণে স্থানীয় প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে মোমবাতি প্রজ্বলন ও আলোচনাসভাসহ নানা আয়োজনে দিবসটি স্মরণ করা হচ্ছে। সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের একুশ আগস্ট। বাংলা ৫ ভাদ্র, রবিবার। স্থানীয় বিসকা রেলওয়ে স্টেশনের অবাঙালী মাস্টার ছলিম উদ্দিন ও আলবদর কমান্ডার আব্দুল মান্নান ফকিরের সহায়তায় পাকসেনারা পশ্চিম শালিহর গ্রামে হানা দেয়। বিসকা রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম প্রান্তের আইরা বিলের ব্রিজের কাছেই ছিল আলবদর ও পাকসেনাদের ক্যাম্প। ট্রেনে করে পাকসেনারা বিসকা রেলস্টেশনে নেমে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শালিহর গ্রামে বর্বরতা চালায়। শালিহর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করছে এমন ভুল খবর পেয়েই মূলত পাকবাহিনী গ্রামটিতে হানা দেয়। পাকবাহিনী আসছে খবর ছড়িয়ে পড়লে শালিহর গ্রামের নারী পুরুষ যার যার মতো দৌড়ে পালাতে থাকে। সেদিন পাক সেনাদের প্রথমেই সামনে পড়ে যান কৃষক নবর আলী। পাকবাহিনী নিরীহ নবর আলীকে গুলি চালিয়ে হত্যার পর পুরো শালিহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে আশ্রয় নেয় মুসলিম লীগ নেতা, সমর্থক কিংবা মুসলমানদের বাড়িতে। বাড়ি থেকে দৌড়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের মুসলমান বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন শচীন্দ্র চন্দ্র দাস। পাক সেনারা সেখান থেকে ধরে আনে শচীন্দ্রকে। পরে দুই হাত বেঁধে রেখে রাস্তার ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় কৃষক শচীন্দ্রকে। এভাবে এই দিনে শালিহর গ্রামের নানা স্থান থেকে নিরীহ বাঙালীদের ধরে এনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ১৪ জনকে। এদের মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন হিন্দু। গৌরীপুর উপজেলার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রহিম জানান, সেদিন নবর আলী ও শচীন্দ্র ছাড়া আরও যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন, মোহিনী কর, জ্ঞানেন্দ্র মোহন কর, যুগেশ চন্দ্র প-িত, ক্ষীরুদা সুন্দরী, তারিনী মোহন দাস, কৈলাস চন্দ্র দাস, শত্রুঘœ দাস, রামেন্দ্র চন্দ্র দাস, দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস, কামিনী মোহন দাস, কর মোহন সরকার ও রায় চরণ বিশ্বাস। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী মতিউর রহমান বলেন, সেদিন পাকসেনারা বিসকা রেলস্টেশন থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের পশ্চিম শালিহর গ্রামে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর ১০/১২টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এর আগে আলবদর কমান্ডারের নেতৃত্বে এসব বাড়িতে লুটতরাজ চালানো হয়। প্রতিটি হত্যাকা- ছিল প্রকাশ্য গুলি চালিয়ে। স্ত্রী পুত্রের সামনে সেদিন প্রকাশ্য এই নির্মমতা চললেও প্রতিবাদ কিংবা রুখে দাঁড়ানোর সাহস পায়নি কোন নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালী। ফলে নির্বিচারে গুলি আর অগ্নিসংযোগসহ লুটপাটের মাধ্যমে পাকসেনারা শালিহর গ্রামের ঘরবাড়ি ও জনজীবন তছনছ করে দেয়। শহীদ শচীন চন্দ্র বিশ্বাসের স্ত্রী শোভা রানী জানান, মুসলমান বাড়িতে আশ্রয় নিয়েও রেহাই পাননি তার স্বামী। কাছে থেকে লুকিয়ে এই হত্যাকা- দেখেছিলেন সেদিন পুত্র রুহিনী চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি জানান, সেদিন বেশ কয়েকজনকে ধরে আনার পর বিসকা তালি হোসেনের বাড়ির সামনে পাকসেনারা কে কে হিন্দু প্রশ্ন করে হাত ওপরে তুলতে বলে। রুহিনী জানান, ৩ জন হাত তোলামাত্রই গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় তাদের। এরপর শচীন, রাজ মোহন, জীবন নমদাস, অমূল্য বিশ্বাস, রবীন্দ্র ও যতীন্দ্রসহ ১০/১২ জনের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় পাকসেনারা। পাকসেনাদের সহায়তায় ছিল ময়মনসিংহ শহরের বাঘমারা এলাকা থেকে আসা বদর বাহিনীর সদস্যরা। আব্দুল মান্নান ফকির ছিল বদর বাহিনীর কমান্ডার। লুটপাটের মালামাল বহনে কাউকে না পেয়ে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায় নগেন্দ্র চৌকিদারকে। অশীতিপর নগেন্দ্র জানান, সেদিন পাক সেনাদের কথামতো চলার পরও তার ওপর অকথ্য নির্যাতন ও মারধর করা হয়। নগেন্দ্র চৌকিদারকে ধরে নেয়ার পর সেখানে আরও ৩ জন ছিল। তার চোখের সামনেই ৩ জনকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। কলেমা জানে কিনা প্রশ্ন করতেই নগেন্দ্র এক নিশ্বাসে কলেমা পাঠ করে প্রাণ বাঁচান। শালিহর গ্রামের গীরিবালা জানান, বিয়ের ৩ বছরের মাথায় এই গণহত্যার ঘটনা ঘটে। সকালে গ্রামের অনেকেই নাস্তা তৈরির জন্য রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল। পাঞ্জাবিরা আসছে খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্রই বাড়ির বৌ ঝিরা রান্নাবান্নার কাজ ফেলে দৌড়ে পালাতে থাকে। প্রায় এক কিলোমিটার দূরের ‘এ বাড়ি, ও বাড়ি যাই’ জানায় গীরিবালা। অনেকে আশ্রয় দিতে সাহস পায়নি। শেষতক একজন আশ্রয় দিয়ে চাটাই দিয়ে গীরিবালা ও তার স্বামীর বড় বোনকে ঢেকে দেয়। চাটাইয়ের নিচে ভয়ে ও দৌড়ানোর কারণে হাফাচ্ছিল তারা। হাফানোর শব্দ টের পেয়ে পাকসেনারা তাদের বের করে এক বাড়িতে আটকে রাখে। এ সময় তার পরিবার থেকে ধরে আনা ৩ জনকে গুলি চালিয়ে হত্যার শব্দ শুনতে পায় গীরিবালা। গীরিবালা অনুযোগ, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৬ বছরেও মেলেনি তাদের স্বীকৃতি। কোন সরকারই গণহত্যায় শহীদ পরিবারের খোঁজ নেয়নি। শহীদ মধু সুদন ধরের পুত্র সুপ্রিয় ধর বাচ্চু জানান, পশ্চিম শালিহর গ্রামের কয়েকটি জায়গায় হত্যাযজ্ঞ হলেও জ্ঞানেন্দ্র করকে যেখানে পাক সেনারা হত্যা করেছিল সেই জায়গাটি শনাক্ত করে বদ্ধভূমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ। তবে এতে গণহত্যায় শহীদদের কোন নাম পরিচয়ের তালিকা রাখা হয়নি। গত ২০১০ সালে শালিহর বদ্ধভূমির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রয়াত স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সাংসদ ক্যাপ্টেন ডাঃ মুজিবুর রহমান ফকির। ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের সহায়তায় নির্মিত বদ্ধভূমির ওপর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভটির কাজ শেষে গত ২০১১ সালে এর উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার কাজ না করায় স্মৃতি স্তম্ভটির এখন বেহাল দশা। দিনের বেলায় স্মৃতিস্তম্ভ প্রাঙ্গণে গরু চড়ে। চারপাশে জন্মেছে নানা আগাছা। এমন বেহাল দশার কথা অকপটে স্বীকার করেন সরকার দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন আহমদ। স্মৃতি স্তম্ভের সংস্কার ও মেরামত কাজসহ এর সৌন্দর্য বর্ধনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেন তিনি। একই সঙ্গে সেদিনের গণহত্যায় শহীদ ১৪ জনের নাম পরিচয়ের ফলকও রাখা হবে এতে জানান স্থানীয় এই সংসদ সদস্য।
×