ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

সংবিধান অনুযায়ী জনগণই কি সর্বক্ষমতার মালিক নয়?

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ১৬ আগস্ট ২০১৭

সংবিধান অনুযায়ী জনগণই কি সর্বক্ষমতার মালিক নয়?

ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সঠিক বললে বলতে হয়, দুই রাজনৈতিক দল-আওয়ামী লীগ যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে যাদের দ্বারা, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকার দ্বারা প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। কেননা যে কোন জাতির সব শ্রেণী-পেশার মানুষ, নারী-পুরুষই স্বদেশের প্রধান ভাগ্য নিয়ন্তা কারণ সব দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতির সব শ্রেণী-পেশার মানুষই সে যুদ্ধে যোগ দেয়, সবাই যুদ্ধে চরম আত্মত্যাগ করে, সে কারণেই সার্বিকভাবেই জনগণকেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী গণ্য করা হয়েছে। নিশ্চয় কোন জাতির কোন সংবিধানে কোন বিশেষ পেশাকে, সে সেনাবাহিনী হোক বা বিচারক হোক বা আমলা হোক বা কৃষক হোক- কাউকে এককভাবে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়নি। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্রের যে কোন কাজের ভাল, সঠিক, বেঠিক, নির্ধারণ করতে জনগণ তো সেই উচ্চতম আদালতের সাহায্য গ্রহণ করে, তাহলে সর্বময় ক্ষমতার মালিক জনগণকে ন্যায়বিচার প্রদান করে যে উচ্চ আদালত, সেই আদালতের সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে না কেন? এখানে বলে রাখা ভাল, ভাল সৎ ব্যক্তি বিচারকদের মধ্যে যেমন আছেন, তেমনি তাদের মধ্যে চরম মন্দ ব্যক্তিও ছিলেন এবং আছেন, তেমনি ভাল ও মন্দ, উভয় প্রকার ব্যক্তি সব পেশায়, রাজনীতিক, প্রশাসক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক- সবার মধ্যেই আছে, ছিল। তাই নয় কি? এখন কথা হচ্ছে জনগণের প্রতিনিধিরাই সংসদ গঠন করেন, অন্য পেশাজীবীরা নয়। রাজনীতিকদের সম্বন্ধে বলা ভাল, রাজনীতি সমন্ধে মানুষের ধারণা সবচেয়ে মন্দ। এই মন্দ ধারণার কারণেই কিন্তু বার বার বিভিন্ন দেশে সেনা শাসন আসে, জনগণের মধ্যে এমন একটা বিভ্রান্তি সিআইএ, আইএসআই ইত্যাদি গোয়েন্দা সংস্থা প্রচার করেছে যার ফলে মানুষ রাজনীতি ও রাজনীতিককে সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট পেশাজীবী মনে করে এবং সেনাবাহিনী ও সেনা শাসনকে উৎকৃষ্ট, সৎ, দক্ষ পেশাজীবীগণও করে এসেছে, যা পুরোপুরি ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পিত উদ্দেশ্যে গড়ে তুলেছে ওদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে ওই গোয়েন্দা বাহিনীগুলো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- অস্ত্র ব্যবসা সবচেয়ে বেশি করবে সেনা শাসকরা, রাজনীতিক শাসকের চাইতে বেশি, কেননা, সেনাদের জনগণের কাছে কোন কাজেই কোন কৈফিয়ত বা জবাবদিহি করতে হয় না, অপরদিকে রাজনীতিককে তার নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার রাস্তাঘাট, খাল-বিল, নদী, সেতু, স্কুল, হাসপাতাল, পরিবহন ইত্যাদি জনগণের সব প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করার জন্য দায়ী থাকতে হয়। সংসদে তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয় বলে তাদের কাছে দেয়া দাবিগুলোর কতটা পূরণ হয়েছে, তার সার্বিক হিসাব দিতে বাধ্য থাকে। সেনা শাসক, বিচারক, প্রশাসক এরা কেউই খুনীকে জামিন দিয়ে, অপরাধীদের পক্ষে রায় দিয়ে কোটি টাকা গ্রহণ করলেও তাদের মামলা না হলে কারও কাছে চাকরিগত নিয়মে জবাবদিহি করতে হয় না। এখন, কেউ যদি সেনা শাসকের আর রাজনৈতিক সরকারের জনকল্যাণমুখী কাজের তুলনা করে তাহলে, দেখতে পাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছরের রাজনৈতিক জনকল্যাণমুখী কাজ পরবর্তী বিশ বছরেও করা হয়নি! এর মধ্যে জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা-তারেকের রাজনৈতিক সরকারের পরিচয়ে আসলে স্বৈরাচারী আইএসআই নির্দেশিত রাজনৈতিক সরকারের সময়ও জনকল্যাণমূলক কাজ হয়নি। সেজন্য, রাজনীতিতে রাজনৈতিক আদর্শ ও ধারা একটি বিশেষ শর্ত হয়ে উঠেছে এর অর্থ এই যে, দেশে কোন্ আদর্শের অনুসারী রাজনৈতিক দলের সরকার দেশ শাসন করছে- সেটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কোন ভিনদেশী গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশে ভিন দেশের আদর্শ বাস্তবায়নে কোন দল সরকারে হলে, সে দলের দ্বারা দেশের কখনও উন্নতি হয় না, কারণ তারা ভিন্ন দেশের লক্ষ্য পূরণে ব্যস্ত থাকে, স্বদেশের স্বজাতির উন্নয়ন কখনও তাদের লক্ষ্য হয় না। এবার আসা যাক, বর্তমান বিতর্কে। বিচারকদের দক্ষতা, অযোগ্যতা বিচারের ভার জনগণের প্রতিনিধি সংসদের কাছে থাকবে, নাকি বিচারকরা নিজেদের অদক্ষতা, অযোগ্যতার বিচার নিজেরা করবেন? সেনা শাসক জিয়াউর রহমান জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ কখনও গড়ে তোলেননি। তিনি বিচারকদের বিচারের ভার দিতে তৈরি করেছিলেন সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল নামের সংস্থা। এরপর এরশাদের সেনা শাসনের এক দশক, তারপর স্বৈরাচার বিতাড়ন আন্দোলন, তারপর ’৯১-এর নির্বাচনে খালেদা জিয়ার উত্থান যদিও ডাঃ বদরুদ্দোজা, মান্নান ভূইয়া, প্রেসিডেন্ট সাত্তারসহ এক দল অভিক্ত রাজনীতিকদের বাদ দিয়ে খুবই স্বল্প শিক্ষিত গৃহিণী খালেদা জিয়ার দলনেত্রী হওয়ার নেপথ্যে রহস্য আছে বলে অনেকেই মনে করেন, কারণ ’৭১-এ খালেদা জিয়ার পাকিস্তানী সেনা অধ্যুষিত ঢাকা সেনানিবাসের বাসায় দুই পুত্রকে মা- বোনের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে একাকী বাস করা, মেজর জিয়ার কর্মস্থল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে হলেও ঢাকা সেনানিবাসে বাসা পাওয়া, জিয়ার চিঠির তথ্য যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হতো তবে সে সব চিঠি নিয়ে পাঞ্জাবি সেনাদের সুরক্ষিত সেনা আবাসে কোন মুক্তিযোদ্ধার প্রবেশ অসম্ভব হতো এবং সে জন্য খালেদার অবশ্যই সেনানিবাসের বাইরে থাকাটাই হতো স্বাভাবিক- এসব প্রশ্ন রয়েছে। কোন মুক্তিযোদ্ধা যদি তার স্ত্রীকে ওই পারে চলে যাবার জন্য চিরকুট পাঠায় সেটি কি শত্রুর সেনানিবাসে পাঠানো সম্ভব? যে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হলে সে কি পাঞ্জাবি অধ্যুষিত সেনানিবাসে বাস করত? অন্যরা কেউই তো সেখানে বাস করেনি। কেননা সেখানে বাস করাটা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে ভীতিকর বিষয় হতো, নয় কি? যাই হোক এখানে রহস্য লুকিয়ে তো আছেই, সে জন্য ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে তার সরকারের সময় গণআদালত সংগঠিত হওয়ার সময় গোলাম আযমকে সব রকম আঘাত থেকে সুরক্ষা দিতে ক’দিন জেলখানায় রেখে ছেড়ে দেন, অপর দিকে গণআদালতের নেত্রী-নেতা, বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা তাদের সন্তান, জনগণ, বিচারক, সাক্ষী, বিচার প্রার্থী সবার ওপর দমন, নির্যাতন চালানো হয় পুলিশী হামলা! কোন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর এ রূপ ধারণ করা কি সম্ভব? তিনি তো তার স্বরূপ সে সময়েই প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পদক্ষেপের মাধ্যমে! যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। সংসদে যেহেতু জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন তাহলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ- প্রশাসন, বিচার ও আইন অর্থাৎ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা এবং আইনপ্রণেতাদের অদক্ষতা ও অযোগ্যতার বিচার ও সংসদীয় একটি বিশেষ কমিটির করার কথা। কারণ প্রশ্ন উঠেছে, প্রশাসকরা যদি নিজেদের বিচার নিজেরা করেন, নিরাপত্তা বাহিনী যদি নিজেদের বিচার সব ক্ষেত্রে নয়, নিজেরা করে তাহলে বিচারকদের বিচার বিচারকরা করতে পারবেন না কেন? প্রশ্ন ও উত্তর দুটিই জটিল। এক হতে পারে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ কর্মকর্তাদের বিভাগীয় বিচার করতে পারবে অথবা সংসদেও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এমন একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি থাকবে, সেটি সংসদীয় কমিটিও হতে পারে, যেটি উক্ত তিন শাখার সব কর্মকর্তার অদক্ষতা ও অযোগ্যতার বিচার করতে পারবে। যতভাবেই আমরা চিন্তা করি না কেন, সব রকম কমিটিতে কিছুটা পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করার মতো মানুষ থাকবে। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলেও থাকবে, সংসদীয় কমিটিতেও থাকবে, এর মধ্যেই যেটি উত্তম এবং তিন বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য, প্রাসঙ্গিক, নিরপেক্ষ হবে- সেটিই গ্রহণ করা উচিত। এসব কমিটিতে প্রশাসক, বিচারক, সাংসদÑ সবার বিচার হলে ক্ষতি কি? অন্যান্য দুর্নীতি, ঘুষ, খুন সাংসদ দখল, প্রতারণা এসবের বিচারের জন্য দুর্নীতি কমিশন ও আদালতই ভূমিকা পালন করবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×