ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ সংশোধনী উপলব্ধির যোগ্যতা থাকতে হবে -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১০ আগস্ট ২০১৭

বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ সংশোধনী উপলব্ধির যোগ্যতা থাকতে হবে -স্বদেশ রায়

কোন দেশের সংবিধান বিচার বিশ্নেষণ করতে হলে ওই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, নেতৃত্বের ইতিহাস, রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হয়। মনে করুন, আমি একজন অর্ধশিক্ষিত সাংবাদিক বা তথাকথিত দু’পয়সার বটতলার উকিল, কারও না কারও বদান্যতায় বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়েছি। টাকা পয়সা ব্যয় করে কিছু ভাড়াটে লোকজনের দ্বারা জ্ঞানী বলে সার্টিফিকেটও নিচ্ছি। তবে তার অর্থ এই দাঁড়ায় না যে, আমি সংবিধান পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন সম্পর্কে বলে দেব, সংবিধানে এটা থাকা উচিত, এটা থাকা উচিত নয়। আজ আমরা আমাদের সংবিধান তৈরির অনেক জনক দেখতে পাই। এগুলো মূলত হাসির খোরাক একটি জাতির জন্য। কারণ, যারা ওই সব জনক সাজতে যান তারা এই সহজ সত্যটুকু বোঝেন না, বাংলাদেশ যার সৃষ্টি, সংবিধানও তাঁর সৃষ্টি। বাংলাদেশ কী? বাংলাদেশ একটি আধুনিক রাষ্ট্র, আধুনিক রাজনীতির মাধ্যমে এর সৃষ্টি হয়েছে। আর তার সৃষ্টিকর্তা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই আমাদের এই সংবিধান বা আধুনিক রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক দলিল, সংবিধানের মূল স্র্রষ্টা। এই সংবিধান লেখা একদিনে শুরু হয়নি বা ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি যেদিন থেকে তৈরি করা হয়েছিল সেদিন থেকেও শুরু হয়নি। এই সংবিধান লেখা শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দেয়া যাক। এই সংবিধানে বলা হয়েছে, এই প্রজাতন্ত্রের ভাষা হবে ‘বাংলা’। এটা কি ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি করার পরে ঠিক হয়েছিল, না ১৯৪৮ সালে ঠিক করা হয়েছিল? ১৯৪৮ সালেই জাতি এটা ঠিক করেছিল। রাজপথে দাঁড়িয়ে এ দেশের তরুণ রাজনীতিকরাই সেদিন এটা ঠিক করেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। এটা করা হয় দেশের ও মানুষের আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিল রেখে। রাজনীতিকরা বা জনপ্রতিনিধিরা যেহেতু ওই আকাক্সক্ষা ধারণ করেন, তাই তারা সে কাজটি করার জন্য রাষ্ট্রে জনগণের দেয়া অধিকারে অধিকারী। সর্বোপরি আমাদের সংবিধানের কী কী মূলনীতি হবে তা বঙ্গবন্ধুর ২২ বছরের সংগ্রামের ভেতর দিয়েই স্থির করা। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি তৈরি হওয়ার পরে এ সিদ্ধান্ত আসেনি। বঙ্গবন্ধু তাঁর জাতিকে নিয়ে যে রাজনৈতিক সংগ্রাম করেছিলেন তার ভেতর দিয়েই এগুলো স্থির হয়ে যায়। আমেরিকার সংবিধান খুবই সংক্ষিপ্ত আকারের। এই দলিল কিন্তু মানব সভ্যতা পরিবর্তনের অন্যতম একটি দলিল। অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তি আমেরিকার সংবিধান পড়েছেন। তারা সকলেই জানেন, এটা কোন আইনের দলিল নয়, একটি রাজনৈতিক দলিল, রাষ্ট্রের গাইডলাইন। সেটা সৃষ্টিও হয়েছে আমেরিকার বিশাল সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। ওই সংবিধানে পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন যা হয়েছে তা সে দেশের রাজনীতিবিদরাই করেছেন। আমাদের এ বছর শোকের মাসের প্রথম দিনে অর্থাৎ ১ আগস্ট একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে গেছে। যদিও দেশের সুপ্রীমকোর্ট বলেনি, তাই এর কোন মূল্য নেই, তবু মি. সিনহা প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার রায়ের অবজারভেশনে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বাতিল বলে উল্লেখ করেছেন। তার এ কথার কোন আইনগত ভিত্তি নেই। তবে চতুর্থ সংশোধনীর ওপর আগস্ট মাসে আঘাত হানা মূলত বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিকভাবে হত্যা করার একটি চেষ্টা হিসেবে মানুষ ধরে নেবে। যদি কেউ রাজনৈতিক বোধের অভাবেও এ কাজ করে থাকেন তা হলেও সেটা রাজনৈতিকভাবে হত্যার চেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত হবে। কারণ, চতুর্থ সংশোধনী সংবিধানের ৫ম বা সপ্তম সংশোধনীর মতো কোন সামরিক শাসনের অবৈধ কাজকে বৈধতা দেয়ার জন্য করা হয়নি। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীকে এ দেশের সামরিক শাসনের অনুগতরা (বাস্তবে পাকিস্তানপন্থী, রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির সদস্য ও তাদের সন্তানরা) এক দলীয় শাসন হিসেবে উল্লেখ করে একটি স্বৈরতন্ত্র হিসেবে প্রচার করেছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রসহ মিডিয়া ব্যবহার করে এই প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধু, শেখ ফজলুল হক মণি, অন্যদিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরে আওয়ামী লীগ এতটাই নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে যে, তারা এই অপপ্রচারের জবাব দেয়ার সুযোগ পায়নি। সুযোগ পাওয়ার উপায়ও ছিল না। সুযোগ পাবার কেন উপায় ছিল না? ছিল না এ কারণে যে, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রথাগত কাঠামোটিই ছিল এর বিপক্ষে। যেহেতু বঙ্গবন্ধু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলোতে যে প্রথাগত পদ্ধতি ছিল তা ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রথায় অভ্যস্ত ও সুবিধাবাদী কাঠামো এর বিপক্ষে যাবেই। কেন তারা বিপক্ষে ছিল, তাদের কোন কায়েমি স্বার্থে আঘাত লেগেছিল? কেন চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের পরিবর্তন ঠেকাতে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল? এই সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পারলেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায়। আমাদের ১৯৭২ এর সংবিধান সেই রাজনৈতিক দলিল, যা ২২ বছরের সংগ্রামের একটি নির্যাস। যে নির্যাসের মাধ্যমে স্থির করা হলো, ২২ বছর ধরে জাতি যে সংগ্রাম করেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য, সেটা এই কাঠামোর ভেতর দিয়ে শুরু হবে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দেয়ার পরে যে মুক্তির সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সংবিধান প্রণীত হলো সেই মুক্তির সংগ্রামের স্বার্থে। এখানে দুটো বিষয় একটু বলা দরকার, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সংগ্রামের ঘোষণা দিলেন। আর ২৬ মার্চ তিনি ঘোষণা দিলেন, আজ থেকে তাঁর দেশ স্বাধীন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণার পর পরই তিনি দিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তী সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রামের ঘোষণা। রাজনৈতিক নেতারা এভাবেই তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচীকে পর্যায়ক্রমে ঘোষণা দেন। স্বাধীনতার পরে তাই ১৯৭২ এর সংবিধান বা যে রাজনৈতিক দলিলটি রাষ্ট্রের গাইডলাইন হিসেবে বঙ্গবন্ধু প্রণয়ন করলেন, সেটা ছিল ওই মুক্তির সংগ্রামের সূচনার জন্য। বঙ্গবন্ধু কোন সাধারণ রাজনৈতিক নেতা নন, এমনকি শুধুমাত্র অসাধারণও নন, তিনি ক্ষণজন্মা শুধু নন, তিনি নিজেকে নিজেই সৃষ্টি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে কারও বদান্যতায় একদিনে হননি। বঙ্গবন্ধু শৈশব থেকে নিজেকে তৈরি করে জীবনের মধ্য প্রহরে পৌঁছানোর আগেই পৃথিবীর চার পাঁচজন নেতার কাতারে পৌঁছে গেছেন। লেনিন, মাও, আব্রাহাম লিঙ্কন, জেফারসন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে আমরা পাহাড়সম উচ্চতায় দেখি, তিনিও শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি। যাকে বঙ্গবন্ধুর মতো আমরা পিতৃসম মনে করি সেই ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, আমার নেতা, আমার বড় ভাইÑ মুজিব ভাই। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোন কাজ বুঝতে হলেও নিজেকে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিতে হয়। যেমন একজন বামনকে কোন উচ্চ মানুষের বুক স্পর্শ করতে হলে পায়ের নিচে একটা কাঠের টুল বা উঁচু একটা সাপোর্ট দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। যেমন কোন বই না পড়ে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ পড়তে বসলে কেউ রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে পৃথিবীর মানব সভ্যতার ইতিহাস জানতে হবে, ভারতীয় সভ্যতার আত্মাকে উপলব্ধি করতে হবে, ভারতীয় ও গ্রীক মহাকাব্য তাকে জানতে হবে, পড়তে হবে ইরেজী সাহিত্যের বড় কবিদের, জানতে হবে উপনিষদ, বেদ থেকে শুরু করে যাবতীয় ভারতীয় দর্শন, অন্যদিকে হেগেল থেকে রাসেল অবধি যাবতীয় পাশ্চাত্য দর্শন। এর পরেই না রবীন্দ্রনাথকে কিছুটা উপলব্ধি করা যাবে। রবীন্দ্রনাথের লেখাই যেমন প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ কে? ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের কাজই প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু কে? বঙ্গবন্ধু তার সময়ের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতা। বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করতে শুরু করেছেন তখন তিনি দেখতে পাচ্ছেন, সোভিয়েত ক্ষয়িষ্ণু। আমেরিকার গণতন্ত্র, ব্রিটেনের গণতন্ত্র প্রথাগত হয়ে উঠেছে। যখন কোন কিছু প্রথায় রূপ নেয়, তখন তার পরিবর্তনশীলতার ক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ ওই গণতন্ত্র সব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের শক্তি হারিয়ে প্রথার ভেতর ঢুকে গেছে। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু দেখতে পাচ্ছেন চীনে মাও ব্যর্থ হয়ে গেছেন। সেখানে মাওকে বাদ দিয়ে একটি নতুন আয়োজনের উন্মেষ ঘটছে। ওই পৃথিবীতে বসে বঙ্গবন্ধু ৭২ থেকে ৭৫ অবধি এসে বুঝতে পারেন, সীমিত সম্পদের, ক্ষুদ্র আয়তনের অথচ অধিক জনগোষ্ঠীর একটি দেশকে প্রথাগত গণতন্ত্রের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক মুক্তি দেয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুর মাপের নেতা যখন বুঝতে পারেন তার জন্য নতুন যুদ্ধের দরকার, তখন তো ওই রাজনীতিক বসে থাকতে পারেন না। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ মুক্তির সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। মানুষের সেই আর্থ-সামাজিক মুক্তির জন্য তিনি তাই আবার নতুন করে সংগ্রাম শুরু করেন ১৯৭৫-এ। যে সংগ্রামের একটি অংশ চতুর্থ সংশোধনী। আমাদের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী শুধুমাত্র সংবিধানে একটি সংশোধনী আনার জন্য সংসদের মাধ্যমে একটি সংশোধনী মাত্র নয়। এ সংশোধনীটি এসেছে একটি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত এবং নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচী শুরু করার জন্য। যে কারণে বদলানো হয় দেশের রাজনৈতিক দলের কাঠামো, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পদ্ধতি, রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনিক পদ্ধতি- সর্বোপরি নেয়া হয় একটি সম্পূর্ণ নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচী। এগুলো নিয়ে এগোনোর জন্য, বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সংসদের মাধ্যমে সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী আনেন। কারণ, তাঁর যে সারা জীবনের রাজনীতি, অর্থাৎ মানুষের সার্বিক মুক্তি, ওই মুক্তির জন্যই তিনি প্রথা ভাঙ্গেন। পৃথিবীতে, এই উপমহাদেশে সৃষ্টি করেন নতুন প্রথার। এ ধরনের সার্বিক ও নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি রাষ্ট্রে পরিবর্তন তখনই সম্ভব হয় যখন বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা থাকেন। তাই এসব ক্ষেত্রে সত্য বুঝতে হলে সকলের নিজের উচ্চতা জানা উচিত। নিজেকে না জানলে পৃথিবীতে কখনই বৃহতকে বোঝা যায় না। কারণ প্রথমেই বুঝতে হয় আমি কতটুকু বুঝতে পারব? ... হয়ে চাঁদ ধরতে না যাওয়াই ভাল। বঙ্গবন্ধুর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীকে তাই কোনরূপ ক্ষুদ্র, খ-তার দ্বারা সামরিক শাসন বৈধ করার কোন সংশোধনী মনে করে তাকে বাতিল করার মতো কাজ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে করা যায় না। সকলেরই মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ আর কোনদিন পাকিস্তান হবে না। এখানে বাস করতে হলে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। [email protected]
×