ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলেই রহস্য উন্মোচন হবে ॥ খিলগাঁও থানার ওসি

গৃহকর্মী লাইলীর মৃত্যুরহস্যের জট খোলেনি

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৮ আগস্ট ২০১৭

গৃহকর্মী লাইলীর মৃত্যুরহস্যের জট খোলেনি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীর খিলগাঁওয়ে গৃহকর্মী লাইলীর মৃত্যু রহস্যের জট খোলেনি। গৃহকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে বলে নিহতের পরিবারের দাবি। আর রিমান্ডে থাকা বাড়ির মালিক ও দারোয়ান দাবি করছে, গৃহকর্মী লাইলী আত্মহত্যা করেছেন। লাইলীর মৃত্যুর সঙ্গে তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। যদিও চিকিৎসক ও তদন্ত সংস্থাগুলো বলছে, আত্মহত্যার অনেক আলামত লাইলীর মধ্যে অনুপস্থিত, যা লাইলীকে হত্যার ইঙ্গিত দেয়। লাইলীর পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পাওয়ার পরই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বাড়ির মালিক ও দারোয়ানকে প্রয়োজনে আবারও রিমান্ডে নেয়া হবে। ওই বাড়ির ভাড়াটিয়ারা বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। বাড়ির সামনে থেকে পুলিশ পাহারা তুলে নেয়া হয়েছে। নিহতের দুই অবুঝ শিশু তাদের পরিবারের কাছে রয়েছে। তারা মা মা ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। আবার ঘুম থেকে জেগেই একইভাবে মা মা ডাকছে। অবুঝ দুই শিশুর এমন আর্তনাদ সেখানকার মানুষজন সহ্য করতে পারছেন না। গত ৪ আগস্ট রাজধানীর বনশ্রীতে গৃহকর্মী লাইলী বেগমের (২৫) রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বাড়ির সাবেক কাস্টমস এ্যান্ড ভ্যাট এক্সাইজ বিভাগের কর্মকর্তা মুন্সী মইনুদ্দিন (৬৯) ও দারোয়ান তোফাজ্জল হোসেন টিপুকে (৩৪) ৩ দিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। অপর আসামি বাড়ির মালিকের স্ত্রী শাহনাজ বেগমকে আদালতের নির্দেশে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। খিলগাঁও থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যেই লাইলীর মৃত্যু রহস্য প্রকাশ করা হবে। আর মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যেই মামলার রহস্য উদঘাটিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। রিমান্ডে থাকা আসামিরা লাইলী আত্মহত্যা করেছে বলে দাবি করেছে। লাইলীর মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য জানতে প্রয়োজনে আসামিদের আবার রিমান্ডে নেয়া হবে। সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, বনশ্রীর জি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর ছয়তলা বাড়ির সামনে কোন পুলিশের পাহারা নেই। ভাড়াটিয়াদের অনেকেই বাড়িতে ফিরেছেন। তারা বলছিলেন, তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। বাড়িটির সামনে বিশাল লোহার গেট। গ্যারেজ লাগোয়া আরেকটি ছোট গেট রয়েছে। সেই গেটের সঙ্গে সিঁড়ি। দোতলায় পরিবার নিয়ে বাড়ির মালিক বসবাস করেন। দোতলা থেকে নিচতলায় নামার ভেতর দিয়ে ডুপ্লেক্স টাইপের বাড়ির মতো সিঁড়ি রয়েছে। সেখানে বসার, খাওয়া দাওয়া ও থাকার জন্য একটি বিশেষ রুম রয়েছে। তবে সেখানে কেউ সাধারণত থাকে না। আর গ্যারেজের দুই দিকে দারোয়ান থাকার ও অন্যান্য মালামাল রাখার রুম রয়েছে। বাড়িটির একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, তারা এমন বাড়িওয়ালার বাড়িতে আর থাকতে চান না। মাসের এমন সময়ে ঘটনাটি ঘটেছে, যখন আর বাড়ি ছাড়া যাচ্ছে না। আর সামনে ঈদ। তাই কষ্ট করে কিছুদিন থাকার পর বাড়ি ছেড়ে দেবেন। তারা আরও জানান, নিচতলায় অবস্থিত বিশেষ থাকার রুম থেকে লাইলীকে উদ্ধার করা হয়। লাইলী যদি সত্যিই আত্মহত্যা করে থাকে, তাহলে বাড়িওয়ালা ও দারোয়ান পুলিশ ডেকে লাইলীকে উদ্ধার করতে পারত। তা না করে তারা নিজেরাই উদ্ধার করে। দ্রুত স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। লাইলীকে হত্যা করাও অসম্ভব নয়। বাড়িটির গ্যারেজের পশ্চিম দিকের কোণায় একটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করে তার পর্যালোচনা করছে। তবে সিসি ক্যামেরাটি যেখানে লাগালো সেখান থেকে বাড়ির ভেতরের কোন দৃশ্য ধারণ সম্ভব নয়। মূলত গ্যারেজের গাড়ি, নিচতলার অন্যান্য মালামাল, দারোয়ানদের গতিবিধি ও বাড়িতে যাতায়াতকারীদের বিষয়ে নজর রাখতেই সিসি ক্যামেরা লাগানো। বাড়ির ভেতরের কোন রুমে বা যেখান থেকে লাইলীকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেখানে কোন সিসি ক্যামেরা নেই বলে বাড়ির একাধিক বাসিন্দা জানান। এজন্য সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে লাইলীর মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব নয়। সূত্র বলছে, সিসি ক্যামেরায় লাইলীর বাড়ি ঢুকার ও তাকে বের করার ফুটেজ রয়েছে। সেসব ফুটেজের পর্যালোচনা চলছে। ফুটেজ পর্যালোচনায় লাইলীর মৃত্যু অস্বাভাবিক বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ ব্যাপারে নিহতের ভাসুর শহীদুল ইসলাম বাদী হয়ে লাইলীকে হত্যার অভিযোগ এনে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার বাদী জনকণ্ঠকে বলেন, লাইলীকে হত্যা করা হয়েছে বলেই তার বিশ্বাস। এমনটাই দাবি করেছেন লাইলীর সঙ্গে এক বাসায় বসবাসকারী তারই দেবর জামাল। তিনি বলছেন, সকালে কাজের জন্য লাইলী ওই বাসায় যায়। এরপর খানিক পরই তার মৃত্যুর খবর আসে। যা অস্বাভাবিক। ধারণা করা হচ্ছে, লাইলীকে বাড়ির মালিক, তার স্ত্রী ও দারোয়ান মিলে হত্যা করে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে, তারাও এমনটাই দাবি করেছেন। তবে খিলগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাহাঙ্গীর কবির খান জনকণ্ঠকে বলেন, গৃহকর্মী মৃত্যুর ঘটনায় পুরো রামপুরা এলাকা একপ্রকার রণক্ষেত্রে পরিণত করার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র থাকার বিষয়টি একেবারে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এর নেপথ্যে অনেক কারসাজি রয়েছে। নিহতের দেবর আরও জানান, লাইলীর দুই সন্তান মরিয়ম (৫) ও আতিকুর (৩) মা মা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যায়। আবার জেগেই মা মা বলে ডাকতে থাকে। তাদের ডাক শুনে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। এমন দুই অবুঝ সন্তানকে রেখে লাইলীর আত্মহত্যা করা অসম্ভব ব্যাপার। দুই সন্তান লাইলীর গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার কালিরহাট বাজার সংলগ্ন সমন্বয়টারী গ্রামে তাদের কাছে রয়েছে। লাইলীর স্বামী নজরুল ইসলাম দেড় বছর আগে কাজের সন্ধানে ভারতে গিয়ে ধরা পড়ে। বর্তমানে তিন বছরের সাজা খাটছেন কোচবিহার জেলা কারাগারে। আর নয় মাস পর তার সাজার মেয়াদ শেষ হবে।
×