ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

আশিয়ান সিটির রিভিউ রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের অনুমতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৮ আগস্ট ২০১৭

আশিয়ান সিটির রিভিউ রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের অনুমতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আটটি মানবাধিকার এবং পরিবেশবাদী সংগঠনের আবেদনের প্রেক্ষিতে রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখান মৌজায় অবস্থিত আশিয়ান সিটি আবাসিক প্রকল্প অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। একই সঙ্গে উত্তরখান, দক্ষিণখান, বরুয়া ও বাউথার মৌজায় প্রস্তাবিত আশিয়ান সিটি প্রকল্পের সব কার্যক্রমের (বিজ্ঞাপন, মাটি ভরাট, প্লট বিক্রয়, রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি) ওপর পূর্বের প্রদত্ত নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। সেই সঙ্গে ঢাকার দক্ষিণখান মৌজায় আশিয়ান সিটি আবাসন প্রকল্প নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রিভিউ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও রিটকারীদের আপীলের অনুমতি দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। চার সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ (বেলা) রিটকারীদের আপীলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে বলা হয়েছে। সোমবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। সংগঠনগুলোর পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন ড. কামাল হোসেন ও সিনিয়র এ্যাডভোকেট ফিদা এম কামাল। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রাজা। আইনজীবী রিজওয়ানা হাসান পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাইকোর্টের রিভিউ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও আমাদের লিভ টু আপীল গ্রহণ করেছে আপীল বিভাগ। আদালত বলেছে, চার সপ্তাহের মধ্যে লিভ টু আপীলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে। এছাড়া হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ এবং আশিয়ান সিটির প্রকল্পের সব কার্যক্রমের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটি আগের মতোই থাকবে।’ আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এএলআরডি, বেলা, ব্লাস্ট, বাপা, আইএবি, নিজেরা করি এবং পবা- এ আটটি মানবাধিকার এবং পরিবেশবাদী সংগঠন আশিয়ান সিটি প্রকল্পটির স্বপক্ষে প্রদত্ত রাজউক ও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালে একটি জনস্বার্থমূলক মামলা (রিট পিটিশন নং ১৭১৮২/২০১২) দায়ের করলে আদালত ১৬ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে এসব অনুমোদন অবৈধ মর্মে রায় দেয়। সে সময় বিচারপতি সৈয়দ এবিএম মাহমুদুল হক এবং বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেন আবেদনকারীদের পক্ষে রায় দিলেও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ভিন্নমত পোষণ করে রায় দেন। গত ১৬ আগস্ট ২০১৬ তারিখে আশিয়ান সিটির রিভিউ আবেদন গ্রহণ করে বিচারপতি সৈয়দ এ বিএম মাহমুদুল হক, বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ আশিয়ান সিটি প্রকল্প অবৈধ ঘোষণার রায় বাতিল করে। সে প্রেক্ষিতে সংগঠনগুলো অন্তবর্তীকালীন আপীল (সিএমপি) দায়ের করলে গত ২২ আগস্ট ২০১৬ আশিয়ান সিটি প্রকল্পের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আপীল বিভাগ। বাদীগণ আশিয়ান সিটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ২৪০ একরের আশিয়ান সিটি প্রকল্প বাস্তাবায়নে ভূমিদস্যুতা এবং জলাশয় আইন-২০০০, পরিবেশ আইন-১৯৯৫, ল্যান্ড হোল্ডিং লিমিটেশন অর্ডার-১৯৭২, এগ্রিকালচার রিফর্ম অর্ডিনেন্স-১৯৮৩, বেসরকারী আবাসন প্রকল্প (ভূমি উন্নয়ন) বিধিমালা-২০০৪ এবং রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ ভঙ্গের অভিযোগ আনে। একই সঙ্গে প্রকল্প অনুমোদনে পূর্ত মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, রাজউক এবং পরিবেশ অধিদফতরের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতা এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়। রাজউক ২০০৭ সালে জলাশয় ভরাটের অভিযোগে আশিয়ান সিটি প্রকল্পের বিরুদ্ধে জলাশয় আইনে মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে রাজউক শুনানিতে হাজিরা না দেয়ায় মামলাটি আশিয়ান সিটির স্বপক্ষে খারিজ হয়ে যায়, যার বিরুদ্ধে রাজউক কোন আপীল করেনি। বিভিন্ন সময়ে রাজউক এ প্রকল্প অননুমোদিত বিধায় এতে প্লট না কিনতে ক্রেতাসাধারণকে বিজ্ঞপ্তি মারফত অনুরোধ জানায়। পরিবেশ অধিদফতরও জলাশয় ভরাটের অভিযোগে পরিবেশ আইনের অধীনে আশিয়ান সিটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে। আশিয়ান সিটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষের আপীল আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কোনরূপ যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে ওই জরিমানা কমিয়ে পাঁচ লাখ টাকা প্রদানের নির্দেশ দেয়। আশিয়ান সিটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতার অভিযোগ উঠলে ঢাকা জেলা প্রশাসক এক রিপোর্ট প্রদান করেন, যাতে দেখা যায় মাত্র ৪১ একর জমির স্বপক্ষে কিছু কাগজাদি দেখাতে পারলেও আশিয়ান সিটির নামে প্রায় ২৩০ একর ভূমি ভরাট করা হয়েছে যা বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘প্লাবনভূমি’। জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভরাটকৃত জমিতে সরকারী এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি রয়েছে। ভুক্তভোগী জমির মালিকদের বারবার অভিযোগ সত্ত্বেও আশিয়ান সিটি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জমি দখলের বিষয়ে রাজউক, পুলিশ বা ভ্যমি প্রশাসন কেউ কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। প্রথমে জলাশয় ভরাটের অভিযোগে আশিয়ান সিটি প্রকল্পের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও রাজউক ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ২০টি শর্তসাপেক্ষে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। প্রকল্পের জমির শতভাগ মালিকানা না থাকলেও এবং প্রকল্পের লে-আউট প্ল্যান অনুমোদন ছাড়াই শর্তসাপেক্ষে প্রদত্ত এ অনুমোদন ২০০৪ সালের বেসরকারী আবাসন প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালার লঙ্ঘন দাবি করে তা চ্যালেঞ্জ করেন মামলার বাদীগণ। আশিয়ান সিটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে জলাশয় ভরাটের অভিযোগে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে এবং বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর কর্তৃক আশিয়ান সিটি প্রকল্প এলাকাকে প্লাবনভূমি বর্ণনা করা সত্ত্বেও পরবর্তীতে এ প্রকল্পের স্বপক্ষে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র স্ববিরোধী এবং বেআইনী বলে মামলাটি চ্যালেঞ্জ করা হয়। আশিয়ান ল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট লি. কর্তৃক প্রকল্পের জন্য ল্যান্ড হোল্ডিং লিমিটেশন অর্ডার-১৯৭২ এবং এগ্রিকালচার রিফর্ম অর্ডিনেন্স-১৯৮৩-তে নির্ধারিত ভূমির পরিমাণের সর্বোচ্চ সিলিংয়ের অতিরিক্ত জমি দখলে রাখার অভিযোগ আনা হলে আদালত তা আমলে নেয় এবং জমির এরূপ মালিকানা আইনবহির্ভূত মর্মে রায় দেয়। ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ আশিয়ানের পক্ষের অনুমোদনগুলোকে বেআইনী ঘোষণা করে। রায় ঘোষণার পর আশিয়ান কর্তৃপক্ষ রিভিউ আবেদন দায়ের করে এবং প্রকল্পে ১১৯৭ একর জমি ব্যবহারের স্বপক্ষে ঢাকা জেলা প্রশাসকের একটি অনুমতিপত্র আদালতে দাখিল করে, যা রায় ঘোষণার দিনই আশিয়ান পেয়েছে বলে রিভিউ আবেদনে দাবি করা হয়। আশিয়ান কর্তৃপক্ষকে ভূমিদস্যু বলে আদালতে লিখিত বক্তব্য প্রদান করে মামলা চলাকালীন আদালতকে অবহিত না করে গোপনে মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে ১১৯৭ একর জমি আশিয়ান সিটি প্রকল্পে ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে জেলা প্রশাসক অস্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছেন মর্মে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আদালতে বক্তব্য রাখে।
×