ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

খামারিরা বলছেন, গরুর মজুদ পর্যাপ্ত

ভারতের গরু আসছে তো? প্রাপ্যতা ও দাম নিয়ে উৎকণ্ঠা

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৮ আগস্ট ২০১৭

ভারতের গরু আসছে তো? প্রাপ্যতা ও দাম নিয়ে উৎকণ্ঠা

হাসান নাসির ॥ কোরবানির ঈদে বরাবরই কাম্য ভারতীয় গরু। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে গরুর প্রাপ্যতা এবং দাম নিয়ে উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। সর্বত্র একই প্রশ্ন, ভারতীয় গরু আসছে তো? প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং দেশের খামারিরা বলছেন, গরুর মজুদ পর্যাপ্ত। সঙ্কটের আশঙ্কা নেই। কিন্তু এমন আশ্বাসেও উদ্বেগ কাটছে না। দেশের বাজারে কোথা হতে যোগান আসবে ৫০ থেকে ৬০ লাখ গরুর? কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে এ সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত সরকার, খামারি, গরু ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা সাধারণ। আবার এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের চামড়া শিল্পও। কেননা, কোরবানিতেই সংগৃহীত হয় সারা বছরে মোট চাহিদার অর্ধেক চামড়া। গো-হত্যা বন্ধে অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গো-মাংস রফতানিকারক দেশ ভারত। বিশেষ করে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বেশ কঠোরতা দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে। গত বছরের মার্চ মাসে সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনকালে অবৈধভাবে গরু পাচার বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। এরপর থেকে সীমান্ত দিয়ে গরু আসা কমতে থাকে। গত কোরবানিতে ভারত থেকে গরু সরবরাহ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তবে এত কিছুর পরও বৈধ-অবৈধ পথে গরু এসেছে এবং এখনও আসছে। এবারের কোরবানির ঈদেও ভারত থেকে গরু আসবে, এমনই আভাস দিচ্ছে বিভিন্ন সূত্র। কারণ, এর সঙ্গে ভারতের খামারিদের স্বার্থও জড়িত। বিজিবির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভারতীয় কড়াকড়ির মধ্যেও চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে বৈধভাবে গরু এসেছে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৯৭৫টি। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৭৭ হাজার ৪৪১টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৯ হাজার ২৭৫টি, মার্চ মাসে ৫০ হাজার ৭০০টি, এপ্রিল মাসে ২৯ হাজার ৩৫৬টি, মে মাসে ৫১ হাজার ২২৬টি এবং জুন মাসে ৯৬ হাজার ৯৭৭টি গরু এসেছে। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে জুলাই থেকে গরু আসা বাড়তে শুরু করেছে। আগস্ট মাসে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই থাকবে তুঙ্গাবস্থা। কারণ সেপ্টেম্বরের শুরুতেই কোরবানির ঈদ। সূত্রমতে, রাজশাহী, যশোর, খুলনা, সিলেট এবং চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী ৩১টি করিডোর দিয়ে প্রতিদিনই আসছে ভারতীয় গরু। এ গরুগুলো আমদানি হচ্ছেÑ বৈধপথে সরকারকে শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে। তবে অবৈধপথে গরু আসাও থেমে নেই। কোরবানির সময় নির্ধারিত ৩১ পয়েন্টের বাইরে সীমান্তের বিভিন্ন পথে প্রচুর গরু এসে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে মনে করছেন গরু ব্যবসায়ীরা। বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন সম্প্রতি রাজশাহীর পবা উপজেলায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভারত থেকে গরু আসবে। তবে অবৈধপথে আসতে দেয়া হবে না। কিন্তু বিজিবি প্রধান অবৈধপথে গরু আসার বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিলেও গরু ব্যবসায়ীরা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত ভারত থেকে নানা পথে গরু আসবেই। কোরবানির ঈদকে টার্গেট রেখে সীমান্তে শিথিলতা থাকবে বলেও ধারণা তাদের। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে গরুর খামার রয়েছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে এ খামার সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। বারোমাসী খামার না হলেও অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে কিছু বাড়তি আয়ের আশায় কোরবানির কয়েক মাস আগে থেকে গরু কিনে পুষতে শুরু করেন। গরুকে মোটা তাজা করা হয় কোরবানির বাজারে বিক্রির লক্ষ্যে। দেশীয় উৎস থেকেই অন্তত ৮৫ ভাগ গরুর যোগান দেয়া সম্ভব হবে বলে ধারণা দিচ্ছেন কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে গবাদিপশু উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে বংশবৃদ্ধির হারে ছাগল ও ভেড়াই বেশি। সংখ্যার দিক দিয়ে গরুর বংশবৃদ্ধি কম হয়। ভবিষ্যত চাহিদা বিবেচনায় রেখে আগামী ২০২১ সাল নাগাদ উৎপাদন ৬ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির টার্গেট নেয়া হয়েছে। বাজার বিশ্লেষকদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর কোরবানির গরুর চাহিদা তৈরি হয় অন্তত ৪০ লাখ। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় ভারতীয় গরু দিয়ে। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে মিয়ানমার থেকেও গরু আসছে। তবে চাহিদার এ ধারণাটি অনেকটাই অনুমাননির্ভর। কারণ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া যায় বিভিন্ন রকম তথ্য। তাছাড়া মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিবছর কোরবানিদাতার সংখ্যাও বাড়ছে। এ বৃদ্ধির হারও ১০ শতাংশের কম নয়। কোরবানিতে বাংলাদেশে ঠিক কী পরিমাণ গরুর প্রয়োজন হয়, সেই সঠিক হিসাব বের করা অতটা সহজ কাজ নয়। তবে এমন কিছু সংস্থা রয়েছে, যাদের কাছ থেকে বেশ কাছাকাছি ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ট্যানারি এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, ২০১৬ সালের কোরবানির ঈদে দেশের ট্যানারিগুলো কিনেছে প্রায় ৫৫ লাখ পিস গরুর চামড়া। দেশের চামড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সারাবছরের চাহিদার কমপক্ষে ৫০ শতাংশ চামড়া এ ঈদে সংগ্রহ করে থাকে। বিটিএর কাছ থেকে পাওয়া এ তথ্যে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কোরবানিতে দেশে গরুর চাহিদা এখন ৫৫ থেকে ৬০ লাখ। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এ্যাসোসিয়েশন বরবারই ভারতীয় গরু আমদানির বিরুদ্ধে। তারা বলছেন, ভারত থেকে গরু এলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন দেশের খামারিরা। খামার ছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেক কৃষক বড় আশা করে গরু লালন-পালন করে থাকেন। গো-খাদ্যের মূল্য অনেক বেশি। কোরবানির সময় হঠাৎ করে সীমান্তপথে অবৈধভাবে গরু এসে পড়লে খামারিদের মাথায় হাত পড়ে। দেশীয় খামার রক্ষা এবং গরু লালন-পালন উৎসাহিত করতে আমদানির ওপর কঠোরতা আরোপ করা উচিত বলে মনে করেন তারা। খামারিরা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত গরুর মজুদ রয়েছে। তাই সঙ্কট হবে না। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদফতরও বলছে, চাহিদার সিংহভাগই পূরণ হবে দেশীয় উৎস থেকে। তাই উৎকণ্ঠার কারণ নেই। গরুর প্রাপ্যতা নিয়ে অনিশ্চয়তা নেই। কিন্তু গরু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে গরু না এলে শেষ পর্যন্ত চাহিদা সামাল দেয়া কঠিন হতে পারে। তবে তারা এও বিশ্বাস করেন যে, সীমান্তের ওপার থেকে গরু আসবেই। কারণ, ভারতকেও তাদের খামারিদের দিকটি ভাবতে হবে। এদিকে, গো-হত্যার বিরুদ্ধে ভারতে সোচ্চারতা থাকলেও দেশটি বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ গো-মাংস রফতানিকারক দেশ। বর্তমানে ওই দেশের ১৮টি রাজ্যে গো-হত্যা নিষিদ্ধ। কিন্তু তাই বলে রফতানি থামছে না। গ্লোবাল বিফ মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, গো-মাংস রফতানিতে যুগ্মভাবে শীর্ষে ব্রাজিল ও ভারত। বিশ্বের মোট গো-মাংস রফতানির ৭৩ শতাংশই ৪টি দেশের। তন্মধ্যে ২০১৬ সালে ভারত ১ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন বিফ রফতানি করেছে। সমপরিমাণ রফতানি ব্রাজিলের। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া ১ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১ দশমিক ১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন গো-মাংস রফতানি করেছে। গো-মাংস রফতানিতে শীর্ষে থাকা দেশটির গো-হত্যা বন্ধে এমন কঠোরতার সমালোচনা ভারতের পত্র-পত্রিকায়ও। তবে সীমান্তপথে সরাসরি গরু রফতানি বা বিক্রি বন্ধের বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থানের নেপথ্যে শুধু ধর্মীয় অনুভূতিই নয়। বরং পাশাপাশি ভারতের চামড়া শিল্পকে রক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ, এমনই মনে করেন বাংলাদেশের চামড়া শিল্প মালিকরা। কেননা, মাংস রফতানি করলে চামড়াটা দেশেই থেকে যায়। কিন্তু আস্ত গরু বিক্রি করে দিলে দেশের বাইরে চলে যায় মূল্যবান চামড়া।
×