ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গৃহকর্মী নির্যাতন কেন?

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ৭ আগস্ট ২০১৭

গৃহকর্মী নির্যাতন কেন?

গৃহকর্মী নির্যাতনের হার যেন বেড়েই চলেছে। শিশু-কিশোর গৃহকর্মীরাও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অনেকক্ষেত্রে অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা যে শুধু শারীরিক-মানসিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকছে তা নয়, ধর্ষণ ও হত্যা পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে। ছুড়ে ফেলা হচ্ছে বহুতল ভবনের ছাদ থেকে। এমনকি হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। শুক্রবার রাজধানীর বনশ্রীর একটি বাড়িতে লাইলী আক্তার নামে এক গৃহকর্মীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে তা যেমন অনাকাক্সিক্ষত তেমনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। দু’সন্তানের জননী লাইলী ঠিকা কাজ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করত। ঘটনার দিন পাওনা টাকা আদায়ে তিনি স্থানীয় একটি বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ির গৃহস্বামীর বাড়িতে গেলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, লাইলীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর এতেই ক্ষিপ্ত ও সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এলাকাবাসী। তারা বাড়িটিকে ঘিরে উত্তপ্ত সেøাগান দিতে থাকে এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ পর্যায়ে গৃহস্বামী পুলিশের শরণাপন্ন হন। শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হলে উত্তেজিত জনতা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। জনতার হামলায় কয়েক পুলিশসহ পথচারী আহত হন। শেষ পর্যন্ত গৃহস্বামীকে গ্রেফতার করে সুষ্ঠু ও যথার্থ তদন্তের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। ধৃত গৃহস্বামীর কাছে জানা যায় লাইলী ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তবে নিকটবর্তী বস্তিতে দুই মাছুম সন্তানকে রেখে লাইলী আক্তার এই বাড়িতে আত্মহত্যা করবেন কেন, তা পরিষ্কার নয়। এলাকার কয়েক গৃহকর্মী ওই বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে পাওনা টাকা না দেয়াসহ অত্যাচার-নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন গণমাধ্যমে। বনশ্রীর ঘটনাটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এ জাতীয় হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। গণমাধ্যমে যে সব খবর ছাপা হয় তাও নয়। শিশু-কিশোর-কিশোরী হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের হারও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। কেন বাড়ছে তা নির্ণয় করা এবং সমস্যার সমাধান সমাজতত্ত্ববিদদের গবেষণার বিষয়। গৃহস্বামী, তার পরিবারের লালসাও কম দায়ী নয় কোন অংশে। আরও যা দুঃখজনক তা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে গৃহকর্ত্রীরাও নেমে পড়েন নির্যাতন ও হত্যাকারীর ভূমিকায়। ২০১৬ সালে দেশে গৃহকর্মী সুরক্ষা আইনের খসড়া অনুমোদিত হলেও তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। অনেক ক্ষেত্রে টাকা দিয়ে হত্যা মামলা মিটিয়ে ফেলার খবরও আছে। সিলেটের শিশু রাজন হত্যা এবং খুলনায় রাকিব হত্যা বহুল আলোচিত ঘটনা, যা দেশব্যাপী রীতিমতো আলোড়ন তোলে। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে প্রবল ক্ষোভ ও ঘৃণা। গণমাধ্যমের চাপে পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ দুটো ঘটনায় দ্রুত আসামিদের গ্রেফতার করে চার্জশীট দিতে সক্ষম হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্পন্ন হওয়ায় এ দুটো ক্ষেত্রেই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়। আশা করা গিয়েছিল যে, এর ফলে জনমনে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে এবং গৃহকর্মী ও শিশু নির্যাতনকারীরা আইনের শাসনের ভয়ে তটস্থ থাকবে। বাস্তবে আদৌ এর কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না, এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। দেশে গত কয়েক বছরে শিক্ষার হার বেড়েছে আশাব্যঞ্জক হারে। সরকারের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে দেশের সব শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়মুখী করার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবৈতনিক ও বিনামূল্যের বইয়ের আওতায় পরিচালিত। অনগ্রসর অঞ্চলে স্কুলে ধরে রাখার লক্ষ্যে শিশুদের জন্য মিড-ডে মিলেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশুশিক্ষা ও কল্যাণের জন্য এসব নিঃসন্দেহে ভাল উদ্যোগ। তবে সব ভাল উদ্যোগই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে যদি না সর্বস্তরে সচেতনতা আসে। সমাজে ভাল মানুষের পাশাপাশি দুর্বৃত্ত ও দুরাচার থাকবেই। তবুও নানা অবক্ষয়ের মধ্যে অমানবিকতা ও পাশবিকতার বিষয়টি লক্ষণীয়। সে অবস্থায় গৃহকর্মী ও শিশু সুরক্ষা আইনটির দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া জরুরী ও অত্যাবশ্যক।
×