ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হজযাত্রায় জটিলতা

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ৪ আগস্ট ২০১৭

হজযাত্রায় জটিলতা

বিশ্ব মুসলমানের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হজ। তীর্থযাত্রায় পৌঁছানোর ব্যাকুলতা পুণ্যার্থীর কাছে হয়ে ওঠে তীব্র। বয়সী মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে উঠলেও সম্ভবত তারা সহ্য করে যান স্রষ্টার সহায়তা প্রাপ্তিকে বুকে রেখে। প্রতিবছর হজ মৌসুম এলেই নানারকম সমস্যা উদ্ভূত হতে থাকে। হজযাত্রীদের আনা-নেয়া, থাকা-খাওয়া পুণ্যব্রত পালনের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় বেশ কিছু অনিয়মের শিকার হতে হয় হজযাত্রীদের। হজযাত্রী হিসেবে নিবন্ধন থেকে শুরু করে হজক্যাম্পে অবস্থান, বিমানের ফ্লাইট নিশ্চিত হওয়া, ভিসা প্রাপ্তি- সব মিলিয়ে কোন কর্মই সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয় যে তা নয়। হজ এজেন্সিগুলোর জালিয়াতি, প্রতারণা, অর্থ লোপাট, যথাসময়ে টিকেট প্রদান না করার এন্তার ঘটনা ফি বছরই চাউর হয়ে ওঠে। অনেক এজেন্সির তালিকা বাতিল হয়েছে অতীতে নানাবিধ অনিয়মের কারণেও। আবার হজে যাওয়ার পর এজেন্সি নিযুক্ত মোয়াল্লেমদের হাতে সুব্যবহারপ্রাপ্তি নিশ্চিত নয় অনেক সময়। তাদের কর্মকা- পুণ্যার্থীদের জন্য ধকল বয়ে আনার ঘটনাও অত্যধিক। সেখানে বাসা ভাড়া নিয়ে যথেচ্ছ কেলেঙ্কারির ঘটনা ফি বছরই শোনা যায়। ধর্মপ্রাণ মানুষের সারা জীবনের স্বপ্ন হজযাত্রা পূরণে কোন স্বাচ্ছন্দ্যকর ব্যবস্থা কেন গড়ে ওঠেনি- সে প্রশ্নের জবাবও জানা নেই ধর্ম মন্ত্রণালয়ের। বরং কর্মকর্তারা সব সময় সজাগ থাকেন তারা নিজেরা নির্বিঘেœ যাতে হজে যেতে পারেন সেই পথ ও পন্থা নিয়ে। সরকারী অর্থে যারা হজে যান তারা ভিআইপির মর্যাদা পেলেও সাধারণ হজযাত্রীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। তবু ধর্মপ্রাণ মানুষ এসব নাকাল সয়ে ছুটে যান তীর্থস্থানে, মক্কায়। চলতি বছরও হজযাত্রা নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। একানব্বইটি হজ এজেন্সির মোয়াল্লেম ফি বৃদ্ধি ও ভিসা জটিলতার কারণে হজযাত্রীরা আটকা পড়ে আছেন। ফলে হজযাত্রী পরিবহনকারী বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সৌদি এয়ারলাইন্স যাত্রী না পাওয়ায় পনরোটির অধিক ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। এই দুটি বিমান সংস্থার হজযাত্রী পরিবহন ক্ষমতা কমেছে প্রায় পাঁচ হাজার। এভাবে আরও কিছুদিন ফ্লাইট বাতিল অব্যাহত থাকলে হজযাত্রী পরিবহন নিয়ে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশ বিমানের ১৭৭টি হজফ্লাইটের মধ্যে ইতোমধ্যে নয়টি বাতিল হয়েছে। পঁচাশি হাজার যাত্রীর পাসপোর্ট হাতে পায়নি হজ অফিস। টিকেট পেয়েও ভিসা জটিলতায় জেদ্দা যেতে পারেননি সাত হাজারের বেশি যাত্রী ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হজ এজেন্সিগুলোর জটিলতার কারণে। হজ এজেন্সিগুলোর অভিযোগ, মোয়াল্লেম সঙ্কট হওয়ার ফলে মোয়াল্লেমরা তাদের ফি বাড়িয়ে দিয়েছেন। যে ফি ছিল ৭২০ সৌদি রিয়াল, এখন দাবি করা হচ্ছে দেড় হাজার রিয়াল। ফলে যাত্রীপ্রতি খরচ বেড়েছে। কিন্তু এই বাড়তি টাকা হজযাত্রীরা দিতে রাজি হচ্ছেন না। আবার হজ এজেন্সিগুলোও লোকসান দিতে রাজি নয়। এই অতিরিক্ত অর্থ দাবির বিষয়টির কোন সুরাহা হচ্ছে না। ধর্ম মন্ত্রণালয় জটিলতা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। এমনকি সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসেরও তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এবার বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৮ হাজার হজযাত্রী তালিকাভুক্ত রয়েছেন। এদের মধ্য থেকে প্রায় ২০ হাজার পুনরায় হজে যাওয়ায় তাদের প্রতিজনকে ২ হাজার রিয়াল দিতে হবে। ফলে এ নিয়ে জটিলতা বেড়েছে। কিন্তু এই অর্থ প্রদানের কথা আগে বলা হয়নি। হজ এজেন্সিগুলোও এই অর্থ পরিশোধ করতে অনাগ্রহী। যাত্রীরা আগেই হজ প্যাকেজ অনুযায়ী টাকা পরিশোধ করেছে। এখন আবার অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে বাধ্য করার বিষয়টিতে তারা ক্ষুব্ধ। এমন অচলাবস্থা নিরসনের দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের হলেও তাদের তৎপরতা দৃশ্যমান নয়। প্রতিবছর হজ মৌসুম এলেই এসব অব্যবস্থা ফুটে ওঠে। এসব যাতে না হয় সে জন্য যথাযথ পদক্ষেপ আগেই নেয়া বাঞ্ছনীয়। ধর্ম পালনের এই মহালগ্নে মহাবিড়ম্বনা কোনভাবেই গ্রহণীয় নয়। অব্যবস্থা দূরীভূত হোক- এটা সবারই চাওয়া। লবণসহিষ্ণু স্বর্ণসূত্র সোনালি আঁশের গৌরব ছিল কী বিশাল। এই বঙ্গ ভূখ-জুড়ে তার চাষাবাদ কৃষকের জন্য ছিল মহার্ঘ। অর্থকড়ির ভাল যোগান আসত এই খাত থেকে। চাষাবাদে প্রচুর শ্রম ব্যবহৃত হলেও উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যেত। তাই কৃষক এর ফলন বাড়াতে থাকত সচেষ্ট। সোনালি আঁশকে কেন্দ্র করে এই বাংলায় গড়ে উঠেছিল বহু কলকারখানা। এশিয়ার সর্ববৃহৎ কারখানাটি গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে। শুধু এটি নয়, এর সঙ্গে আরও কারখানা স্থাপিত হয়েছিল শীতলক্ষ্যার তীরে। যে কারণে নারায়ণগঞ্জ ‘প্রাচ্যের ডান্ডি’ নামে খ্যাতি পেয়েছিল। ব্রিটেনের ডান্ডি অঞ্চলটি শিল্প-কারখানার জন্য খ্যাতি পেয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলায় পাট চাষ সহজ ছিল না। তারা পাটের জমিতে নীল চাষে বাধ্য করেছিল। নীল চাষের ব্যাপকতায় পাটের উৎপাদন হ্রাস পায়। ইংরেজ শাসকরা সেই নীল বিক্রি করে লাভবান হলেও চাষীরা হতদরিদ্রে পরিণত হতে থাকে ক্রমাগত। নীল চাষের দিনগুলো নির্মম, ভয়াবহ এবং দুঃসহ। সাতচল্লিশ সালে দেশ বিভাগের আগে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে পাটকল গড়ে ওঠে অনেক। সোনালি আঁশখ্যাত পাটের চাহিদা বিশ্ববাজারে ক্রমাগত বাড়তে থাকে। পাটের তৈরি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা গড়ে ওঠে। বিশাল কারখানা আদমজী জুট মিলকে কেন্দ্র করে পাট চাষ বাড়তে থাকে। দেশের প্রধান রফতানি আয়ের তালিকায় শীর্ষে ঠাঁই পায় পাট। কিন্তু পাটের অর্থ পাকিস্তানী শাসকরা পূর্ব বাংলার উন্নয়নে ব্যয় না করে তাদের অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে কাজে লাগায়। বাঙালী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। পূর্ববঙ্গ যে শোষিত হচ্ছে তা দেশবাসী উপলব্ধি করতে পারে পাট তথা সোনালি আঁশের মাধ্যমেই। একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের পাটকলগুলোর যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে যায়। ফলে স্বাধীনতার পর রুগ্নপ্রায় পাটকলগুলো চালু করা ব্যয়সাধ্য হয়ে পড়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কলকারখানাগুলো সচল করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও চরমপন্থী এবং উগ্রপন্থীরা পাটের গুদামে, কারখানায় আগুন লাগিয়ে পাট খাতকে ধ্বংসের অভিপ্রায়ে মেতে ওঠে। পাটপণ্য উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় রফতানি খাতটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা হ্রাস পেতে থাকে। পাটের স্থলে পলিথিন এসে বাজার দখল করে নেয়। দেশে চাষীদের কাছে সোনালি আঁশ হয়ে ওঠে গলায় ফাঁস যেন। রফতানি পণ্যের তালিকায় পাটের অবস্থান ক্রমশ নিচে নেমে আসে। চাষীরা পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পাটের দাম এমন নিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে যে, চাষীদের উৎপাদন খরচই উঠে আসে না। দেশেও পাটের ব্যাগের স্থান দখল করে নেয় পলিথিন শিল্প। এই করুণ অবস্থায় কলকারখানাগুলোও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত সরকার মিলে আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেয়। ফলে পাট সেক্টর বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় উপনীত হয়। পাটের যে সুদিন ফিরে আসতে পারে তা কারও কল্পনাতেও ঠাঁই পায়নি। ধরেই নেয়া হয়েছিল পাটের আর জাগরণ হবে না। কিন্তু বিশ্বজুড়ে পলিথিন নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর পাটের চাহিদা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের চাষীরা আবার পাটের আবাদে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ন্যায্য দাম পাওয়ার সুযোগও তৈরি হয়। পাটের তৈরি নানাবিধ পণ্য দেশে-বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। প্ল্যাস্টিকের ব্যাগের পরিবর্তে চাল, ডালসহ অন্যান্য পণ্য প্যাকেজিংয়ে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় এর ব্যবহার বেড়েছে। কারখানাগুলো সচল হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। রফতানি খাতে পাট আবার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। তাই দেশে ব্যাপক পাটের আবাদ জরুরী হয়ে পড়েছে। পাট চাষে সরকার চাষীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। উপকূলীয় অঞ্চলের আঠারোটি জেলায় পাট চাষে বিপ্লব সাধন করতে যাচ্ছে। এসব অঞ্চলের জমি লবণাক্ত বলে পাট চাষ করা হতো না। কিন্তু পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণার ফসল কার্যকর হওয়ার পর লবণাক্ততাকে জয় করেছে পাট। গবেষণালব্ধ দেশী পাট-৮ জাতের পাটের এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। পরিত্যক্ত লবণাক্ত জমিতে পাটগাছ কৃষকের মুখে হাসি এনেছে। এর আগে লবণসহিষ্ণু আমন ধানে সাফল্যের পর এবার পাটে যে সাফল্য এসেছে তাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হলে সোনালি আঁশ আবার রফতানির শীর্ষে স্থান নিতে পারবে।
×