ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোতাহার হোসেন সুফী

বঙ্গবন্ধুকে কোন গুপ্তঘাতক হত্যা করেনি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৩ আগস্ট ২০১৭

বঙ্গবন্ধুকে কোন গুপ্তঘাতক হত্যা করেনি

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ জাতির ইতিহাসের এক কলঙ্কময় দিন, পরম শোকের দিন। এদিন ভোরে চূড়ান্ত এ্যাকশনের সিদ্ধান্ত হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার। ঘটনার রাতে অপারেশন প্ল্যান ব্রিফ করে মেজর ফারুক। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনের চারপাশে আক্রমণকারী ঘাতকচক্র সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে গভীর রাতে। এ সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেছেন প্রসিকিউশনের ১নং সাক্ষী এজাহারকারী আ. ফ. ম. মুহিতুল ইসলাম। ঘাতকদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পদস্থ বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন সে সম্পর্কে ১নং সাক্ষী মুহিতুল ইসলাম প্রদত্ত বিবরণী : ‘১৯৭২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে সহকারী হিসেবে তিনি যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেসিডেন্ট পিএ কাম রিসেপশনিস্ট ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত তার ডিউটি ছিল। যথাসময়ে ডিউটি দিতে এসে পুলিশের ডিএসপি নুরুল ইসলাম খান, ইন্সপেক্টর খোরশেদ আলম, স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন পুলিশ অফিসার, পুলিশের অন্যান্য পদের লোক ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন গার্ডকে ডিউটি দিতে দেখা যায়। রাতে টেলিফোন মিস্ত্রি আবদুল মতিন তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে বলেÑ ‘রাষ্ট্রপতি আপনাকে টেলিফোনে ডাকছেন’। তখন ভোর ৪টা ও ৫টা হবে। চারদিকে ফর্সা হয়ে গেছে। বাড়ির চারদিকে বৈদ্যুতিক আলোও জ্বলছিল। তাড়াতাড়ি গিয়ে টেলিফোন ধরলে রাষ্ট্রপতি দোতলা থেকে বললেনÑ ‘সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছেÑ জলদি পুলিশ কট্রোলরুমে টেলিফোন লাগাও।’ নির্দেশমতো টেলিফোন লাগিয়েও লাইন পাওয়া যাচ্ছিল না। ঠিক তখন রাষ্ট্রপতি দোতলা থেকে নেমে এসে বললেনÑ ‘পুলিশ কন্ট্রোলরুমে লাগাতে বললাম লাগালি না।’ জবাবে মুহিতুল বলেন, ‘চেষ্টা করছি লাইন পাচ্ছি না।’ এই সময় গণভবন এক্সচেঞ্জের লাইন পাওয়া গেলেও কেউ উত্তর দেয় না। রাষ্ট্রপতি তাঁর হাত থেকে টেলিফোন নিয়ে বললেনÑ ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’ ঠিক ঐ সময় এক ঝাঁক গুলি দক্ষিণ দিকের জানালার কাচ ভেঙে অফিস ঘরের দেয়ালে লাগে। অন্য ফোনে চীফ সিকিউরিটি অফিসার মহিউদ্দিনের ফোন ধরলে ঐ জানালা দিয়ে অনর্গল গুলি আসে এবং ভাঙা কাচ লেগে তার ডান হাতের কনুই কেটে গেলে রক্ত ঝরতে থাকে। কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হলে কাজের ছেলে আবদুল ওরফে সেলিম ওপর থেকে পাঞ্জাবি, চশমা এনে দিলে বঙ্গবন্ধু ঐ পাঞ্জাবি, চশমা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে, ‘আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি হচ্ছেÑ তোমরা কি কর।’ এই কথা বলে তিনি উপরে চলে যান। এরপর শেখ কামাল উপর থেকে এসে বলেন, ‘আর্মি ও পুলিশ ভাই, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন। তখন ৩/৪ জন কালো ও খাঁকি পোশাকধারী সশস্ত্র আর্মিকে নিয়ে খাঁকি পোশাকধারী মেজর হুদা গুলি করে শেখ কামালের পায়ে। শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল নিজের পরিচয় দিলে সঙ্গে সঙ্গে ব্রাশফায়ারে তাকে হত্যা করা হয়। ঐ ফায়ারের গুলি তার (মুহিতুলের) হাঁটুতে ও ডিএসপি নুরুল ইসলামের পায়ে লাগে। তারা দু’জন ও আরেকজন অফিসার পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে যাবার চেষ্টা করলে মেজর হুদা তাদের চুল ধরে টেনে তোলে এবং গেটের সামনে লাইনে দাঁড় করায়। ঐ লাইনে পুলিশের লোক ও টেলিফোন মিস্ত্রি আবদুল মতিনও ছিল। হঠাৎ একজন অস্ত্রধারী আর্মি এসে স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ অফিসারকে গুলি করে। গুলি খেয়ে তিনি মারা যান। তারপর কয়েকজন আর্মিকে তাদের পাহারায় রেখে বাকিরা ফায়ার করতে করতে দোতলার দিকে উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর উচ্চ কণ্ঠস্বরÑ তারপর অনেক গুলির শব্দ। দোতলায় মহিলাদের আহাজারি ও আর্ত চিৎকার শোনা যায়। পিছনে রান্নাঘর থেকে কাজের বেটি, গোয়ালঘর থেকে রাখাল আজিজ, ওপর থেকে শেখ নাসেরকে এনে লাইনে দাঁড় করানো হয়। শেখ নাসেরের হাতে তখন গুলির রক্তাক্ত জখম ছিল। শেখ নাসের বললেন, ‘স্যার, আমি তো রাজনীতি করি নাÑ কোনরকম ব্যবসা করে খাই।’ তখন পাহারারত একজন আর্মি বলল, ‘শেখ মুজিব ইজ বেটার দ্যান শেখ নাসের।’ যে অস্ত্রধারী আর্মি শেখ নাসেরকে নামিয়ে এনেছিল সে বললÑ ‘ঠিক আছে আপনাকে কিছু বলব নাÑ আপনি ঐ ঘরে গিয়ে বসেন।’ এই বলে অফিস ঘর সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে শেখ নাসেরকে গুলি করে। শেখ নাসের ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করতে থাকলে পাহারারত আর্মিদের একজন অন্যজনকে বলে, ‘যা, পানি দিয়া আয়।’ পানির পরিবর্তে সে আবারও শেখ নাসেরকে গুলি করে। ওপর থেকে কাজের ছেলে আবদুর রহমান ওরফে রাজা ও শেখ রাসেলকে আর্মিরা নিচে নিয়ে আসে। শেখ রাসেল তাকে (মুহিতুলকে) জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভাইয়া, আমাকে (আর্মিরা) মারবে না তো।’ শিশু রাসেলকে আর্মিরা মারবে নাÑ সেই ধারণাতেই তিনি (মুহিতুল) বললেনÑ ‘না, ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।’ তারপর একজন আর্মি তার (মুহিতুলের) কাছ থেকে রাসেলকে জোর করে ছাড়িয়ে নেয়। তখন রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চায়। রাসেলকে তাঁর মায়ের কাছে দোতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর শোনা যায় গুলির শব্দ। গেটে অবস্থানরত মেজর হুদাকে কী যেন জিজ্ঞাসা করে মেজর ফারুক। মেজর হুদা বলেন, ‘অষষ ধৎব ভরহরংযবফ’, তখন তিনি (মুহিতুল) বুঝতে পারেন রাষ্ট্রপতিসহ তাঁর পরিবারবর্গ ও আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে। ঐ সময় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে দিয়ে কালো পোশাকধারী আর্মির লোক ট্যাংকে যাতায়াত করে। সকাল আনুমানিক ৮টার দিকে কর্নেল জামিলের মৃতদেহ তারই গাড়িতে করে আর্মির লোকেরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসে। তখন মেজর ডালিমকে খাঁকি পোশাকে গেটে অবস্থানরত আর্মিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে দেখা যায়। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ধানম-ি ৩২নং রোডের ৬৭৭ নং বাসভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল এবং শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন অফিসারকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মেজর ফারুক, মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদাকে ঘটনার সময় ও ঘটনার পরে ধানম-ির ৩২নং রোডের ৬৭৭নং বাসভবনে মুহিতুল ইসলাম দেখেছেন। মেজর নূর এডিসি ছিলেন জেনারেল ওসমানীর। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি কলকাতায় ১২নং থিয়েটার রোডে ওসমানী সাহেবের অফিসে যেতেন। সেখানে মেজর নূরের সঙ্গে তার (মুহিতুলের) পরিচয় হয়। শেখ কামালের বন্ধু হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আসত মেজর নূর। হত্যাকা-ের আগে মেজর ডালিম অনেকবার বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসেছেন। মেজর ফারুক হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতÑ এ কথা বহু লোকের কাছে তিনি (মুহিতুল) শুনেছেন। ৪৭০. বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের নৃশংস হত্যাকা-ের মর্মস্পর্শী বিবরণ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষীদের অনেকেই দিয়েছেন। প্রসিকিউশনের ৪নং সাক্ষী হাবিলদার কুদ্দুস বলেনÑ ‘১৫ আগস্ট ভোর পৌনে ৫টায় ৩১নং রোডের বাড়ি থেকে গার্ড দলকে নিয়ে বের হলে গেটের সামনে তাঁদের রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদারকে জীপ থেকে নামতে দেখা যায়। তাদের মাসিক বেতন এনেছেন বলে তিনি জানান। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে বিউগলের সুরে সুরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে থাকে। এমন সময় দক্ষিণে লেকের দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে লাগাতার গুলি আসতে থাকে। তখন তার গার্ড দলসহ দেয়ালে লাইন পজিশনে যায়। গুলি বন্ধ হওয়ার পর পাল্টা গুলি করার জন্য পূর্ববর্তী গার্ড কমান্ডারের নিকট গুলি খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। তখন কালো ও খাঁকি পোশাকধারী সৈনিকরা ‘হ্যান্ডস আপ’ বলতে বলতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ঢুকে পড়ে। ক্যাপ্টেন হুদা, মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) কে গেটে দেখা যায়। বাসভবনের বারান্দায় শেখ কামালকে দেখেই ক্যাপ্টেন হুদা হাতের স্টেনগান দিয়ে শেখ কামালকে গুলি করে। শেখ কামাল গুলি খেয়ে রিসেপশন রুমে পড়ে যান। শেখ কামাল নিজের পরিচয় দিলে ক্যাপ্টেন হুদা আবার তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর পুলিশ ও কাজের লোকদের গেটের সামনে লাইনে দাঁড় করায়। মেজর মহিউদ্দিন তার ল্যান্সারের ফোর্স নিয়ে গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দোতলার দিকে যায়। পরে ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর কয়েকজন ফোর্স নিয়ে দোতলার দিকে যায়। যাবার সময় তাদেরকেও পিছনে পিছনে যেতে হুকুম দেয়। ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর সিঁড়ির চৌকির ওপর গেলে মেজর মহিউদ্দিন ও তার ফোর্স বঙ্গবন্ধুকে নিচের দিকে নামিয়ে আনতে দেখে। তখন মেজর নূর ইংরেজীতে কিছু বললে মেজর মহিউদ্দিন তার ফোর্সসহ এক পাশে চলে যায়। এই সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোরা কি চাস?’ এরপর ক্যাপ্টেন হুদা এবং মেজর নূর হাতের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিঁড়ির মধ্যে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। কিছুক্ষণ পর মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এবং ল্যান্সার ও আর্টিলারির ফোর্স গেটের সামনে আসে। মেজর আজিজ পাশা তার ফোর্স নিয়ে বাড়ির দোতলার দিকে যায়। তিনিও (হাবিলদার কুদ্দুস) পিছনে পিছনে গিয়ে দোতলায় সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদারকে দেখে। মেজর আজিজ পাশা তার ফোর্স নিয়ে দোতলায় গেলে বেগম মুজিব রুমের ভিতরে থাকা লোকদের না মারার জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। কিন্তু তার কথা না শুনে একদল ফোর্স বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও বাড়ির একজন চাকরকে রুম থেকে বের করে আনে। বেগম মুজিব সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তখন বেগম মুজিবকে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে নিয়ে যায় এবং শেখ নাসের, শেখ রাসেল ও চাকরটাকে নিচে নিয়ে যায়। তারপর মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিনÑ হাতে থাকা স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে থাকা বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী ও শেখ কামালের স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করে নিচে চলে যায়। তিনিও (হাবিলদার কুদ্দুস) তাদের পিছনে পিছনে এসে রিসেপশনের বাথরুমের মধ্যে গুলিবিদ্ধ শেখ নাসেরের লাশ দেখেন। গেটের সামনে লাইনে সাদা পোশাক পরা একজন পুলিশের লাশও তিনি দেখেন। তারপর মেজর আজিজ পাশা গেটের বাইরে এসে ওয়্যারলেসে কথাবার্তা বলে। তখন শেখ রাসেল মায়ের কাছে যাবে বলে কান্নাকাটি করছিল। মেজর আজিজ পাশা ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে হুকুম দিলেন, ‘শেখ রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাও।’ ঐ হাবিলদার শেখ রাসেলকে তাঁর হাত ধরে দোতলায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর শোনা যায় গুলির আওয়াজ ও কান্নাকাটির শব্দ। ঐ হাবিলদার নিচে গেটের কাছে এসে মেজর পাশাকে বলে, ‘স্যার, সব শেষ।’ তারপর মেজর ফারুক একটি ট্যাংক নিয়ে গেটের সামনে এসে মেজর পাশা, মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন হুদার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ট্যাংক নিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর একটি লাল কারে করে কর্নেল জামিলের লাশ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের ভিতরে আনে।...” ৪৭১. দুষ্কৃতকারী সেনা-ঘাতকদের দ্বারা হত্যাকা- সংঘটনের পুরো বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রথমে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তিনি বলেন, শফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। কামালকে বোধহয় তারা মেরে ফেলেছে। সাহায্যের জন্য আবেদন জানান বঙ্গবন্ধু, কিন্তু কোন ফল হয় না। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস। যিনি বাঙালী জাতিকে অধীনতাপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন সেই বাঙালী তাঁকে মেরে ফেলার জন্য বাড়ি আক্রমণ করতে পারে, হত্যা-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে মহৎ হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু কখনও তা ভাবতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কোন গুপ্তঘাতক হত্যা করেনি। ঘাতকরা দশ ঘণ্টা ধরে কর্তৃত্ব বজায় রেখে তারা রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাঁর দুই নিকটাত্মীয় সহকর্মীর বাসভবনে আক্রমণ এবং হত্যাকা- চালায় একেবারে বিনা বাধায়। খুনীদের স্বীকারোক্তি, নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি এবং সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ ও প্রত্যক্ষদর্র্শীদের ভাষ্য থেকে পরিষ্কার যে, আক্রান্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন সেনা-রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য যে সময় ছিল তাকে একেবারে অপর্যাপ্ত বলা যায় না। ট্যাঙ্ক বের হলো সে খবর ক্যান্টনমেন্টের কেউই জানবে না আর রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তায় এগিয়ে আসবে নাÑ ইতিহাস একথা মেনে নেবে না। বাস্তব সত্য এই যে, সেনাবাহিনী-রক্ষীবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাদের তাদের কেউই বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় এগিয়ে আসেনি। ব্যতিক্রম একমাত্র কর্নেল জামিল, যিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না কিন্তু এই সাহসী মানুষটি নিজের দায়িত্ব পালনে বেছে নিয়েছিলেন শাহাদাতের পথ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ভারতের দালাল বলে অভিসম্পাত জানানো হলেও সেই দুঃসময়ে ভারতের তরফ থেকে আসেনি কোন সাহায্য। বিস্ময়কর ঘটনাÑ হত্যাকারীদের তালিকায় যেসব সেনা-কর্মকর্তার নাম দেখা যায় তারা পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিল, তাদের অনেকে খেতাবও পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনরক্ষার্থে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাহায্য চাননি। সার্বভৌমত্বের ঝুঁকি তিনি নেননি। শাহাদাতের পথই বেছে নিয়েছেন তিনি। রেখে গেছেন স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। বলাবাহুল্য, বঙ্গবন্ধু কোন সময়ই সতর্ক ছিলেন না নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে। থাকেননি তিনি গণভবনে। বসবাস করেছেন সাদামাটা নিজ বাড়িতে। নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল মাত্র ক’জন পুলিশ। রক্ষীবাহিনী কিংবা সেনাবাহিনী ছিল না। ক্ষমতালিপ্সু পাপীরাই সবসময় সতর্ক থাকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে। বাংলাদেশের কেউ যে তাঁকে হত্যা করতে পারেÑ একথা তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন না। কেননা দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় তাঁর কোন তুলনা নেই। আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, কেনেডি, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ রাষ্ট্রনায়ককে আততায়ীরা হত্যা করেছে অতর্কিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যা সেসব হত্যাকা-ের চাইতেও নির্মম। লেখক : শিক্ষাবিদ, ভাষাসৈনিক ও গবেষক
×