ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

লন্ডনে ছেলে তারেকের সঙ্গে বসে খসড়া চূড়ান্ত করছেন

দেশে ফিরেই সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবেন খালেদা জিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৩১ জুলাই ২০১৭

দেশে ফিরেই সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবেন খালেদা জিয়া

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফিরেই নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবেন। ইতোমধ্যেই ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে খসড়া রূপরেখা দিয়েছেন তিনি। লন্ডনে মা-ছেলে বসে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে এ রূপরেখাটি চূড়ান্ত করবেন। এর পর খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে অনুমোদন নিয়ে তা জাতির সামনে তুলে ধরবেন। সূত্রমতে, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা ঘোষণার পর এ নিয়ে সরকারকে সংলাপের আহ্বান জানাবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সেই সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও এ নিয়ে সংলাপ করবেন তিনি। আর সংলাপের আহ্বানে সরকার ইতিবাচক সাড়া না দিলে সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচীর দিকে যাবে বিএনপি। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সবার মতামতের ভিত্তিতেই বিএনপি সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবে। আশা করি সরকার এটিকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। আর তা না হলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এ ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হবে। আশা করছি গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারের স্বার্থে এ আন্দোলনে দেশের সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেবে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফিরে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবেন। এর পর তিনি সরকারকে এ বিষয়ে সংলাপের আহ্বান জানাবেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তিনি এ নিয়ে সংলাপ করবেন। এদিকে বিএনপির সহায়ক সরকারের রূপরেখায় কী থাকছে এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে জল্পনা-কল্পনা। এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়েও রজিনৈতিক নেতারা সরব রয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী নেতারা এ নিয়ে কথা বলছেন। সরকার সমর্থক নেতারা বলছেন সংবিধান অনুসারে বিএনপির প্রস্তাবমতে সহায়ক সরকারের কোন সুযোগ নেই। আর বিএনপি নেতারা বলছেন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না। বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখার খসড়া অনুসারে ওই সহায়ক সরকারের মেয়াদ হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো তিন মাস। নির্বাচনকালে বর্তমান সংসদ বহাল থাকবে। তবে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে সক্রিয় না থাকেন সে বিষয়টি বিএনপির রূপরেখায় প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এজন্য দলের ভেতর কয়েক ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। একটি প্রস্তাব হচ্ছে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ না করার শর্তে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিন মাসের এই সহায়ক সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থেকে ছুটিতে থাকার মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। বিএনপির সহায়ক সরকারের আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে রাষ্ট্রপতির অধীন মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন দল বিশেষ করে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থেকে টেকনোক্রেট কোটায় মন্ত্রীদের নিয়োগ দেয়া। এর মাধ্যমে সর্বদলীয় সরকারের আদলে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা। এছাড়া নির্বাচনকালে বর্তমান সংসদ বহাল রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে থেকে সহায়ক সরকারের প্রধানের বিষয়ে প্রস্তাব করার কথাও ভাবা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্দলীয় ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখা সম্ভব, যার ১০ ভাগ টেকনোক্রেট কোটায় যেমন স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে পারেন। বিএনপির খসড়া প্রস্তাবমতে, প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকলে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের দিয়ে কাজ করাতে পারবেন। বিএনপি ইতোমধ্যেই সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতামত নিয়েছে। এছাড়া লন্ডনে তারেক রহমানের মতামত নিয়ে খালেদা জিয়া এ বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার আগ পর্যন্ত জরুরী প্রয়োজনে সহায়ক সরকারের রূপরেখায় পরিবর্তন আনা হতে পারে বলে জানা গেছে। সংবিধান অনুসারে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এমনটি ধরে নিয়েই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসেছে। তবে নির্বাচনকালে সরকার যাতে সব দলের জন্য সহায়ক থাকে এমনটিই আশা করছে বিএনপি। আর এজন্যই বিএনপি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে তারা সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিজ্ঞ নেতাদের পরামর্শ নিয়েছে। রূপরেখা নিয়ে সরকারের সঙ্গে সংলাপের পাশাপাশি জনমত তৈরি করতে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়ে জনমত তৈরি করবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। জেলা সফরের প্রস্তুতি নিতে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন বর্তমান বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়ার সম্বাবনা ক্ষীণ। আবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচনে না গেলে দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। তাই বিএনপিকে বাধ্য হয়েই এ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। এ কারণেই দলটি চাচ্ছে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার হলে আর প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকলে হয়ত সে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আর বিজয়ী হতে না পারলেও সম্মানজনক আসন নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারবে। অবশ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের আগাম প্রস্তাব দিয়ে এবং এ নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করেও এক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সফলতা লাভ করতে পারেনি বিএনপি। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়েও বিএনপি হতাশ। তবে পাঁচজনের মধ্যে অন্তত একজন নির্বাচন কমিশনার দলীয় তালিকা থেকে হওয়ায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন কখন কী করে তা জানতে পারবে বিএনপি। তাই ইতোমধ্যেই এ নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচনে যাবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বিএনপি। তবে রাজনৈতিকভাবে এ কমিশনকে চাপে রেখে সুবিধা আদায়ের কৌশল অব্যাহত রাখবে দলটি। এজন্যই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেও এ কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করেনি। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের সময় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দলীয় কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ইতোমধ্যেই প্রস্তাবগুলোর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার টার্গেট থেকেই গত বছরের ১৮ নবেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের জন্য সংবাদ সম্মেলন করে ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন। পরে খালেদা জিয়ার এ প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে এ নিয়ে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়। বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি খালেদা জিয়াসহ বিএনপির ১০ সিনিয়র নেতার সঙ্গে সংলাপ করেন। এর পর রাষ্ট্রপতি ধারাবাহিকভাবে ৩১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শেষে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুসারে ১০ নামের তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি সাবেক সচিব কেএম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের সঙ্গে সঙ্গে ৬ মার্চ রাতেই স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ওই বৈঠকে দলের স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যই নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরদিন ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে এ নিয়ে ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ওই বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দের প্রতিফলন ঘটেছে। এ নির্বাচন কমিশন দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। এখনও বিভিন্নভাবে নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ সমালোচনা অব্যাহত রাখা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। জানা যায়, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের খসড়া রূপরেখা নিয়ে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর সহায়তায় চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখছেন। যখনই তারা এ বিষয়ে কোন আপডেট খুঁজে পাচ্ছেন সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলছেন। আবার লন্ডনে বসে তারেক রহমানও দেশ-বিদেশের বিভিন্নজনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলছেন।
×