ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৮ জুলাই ২০১৭

বন্যা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ দেশের বিভিন্ন জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। কোথাও পানি সামান্য কমলেও সেখানে দেখা দিয়েছে নানা প্রকার রোগবালাইয়ের আশঙ্কা। বেশিরভাগ এলাকায় কার্যত বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। দুর্গতরা ত্রাণের অপেক্ষায় পথ চেয়ে রয়েছে। বগুড়া-সারিয়াকান্দি পয়েন্টে এবং জামালপুরে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট, মৌলভীবাজার ও কক্সবাজার জেলার বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে সড়ক যোগাযোগ ভেঙ্গে পড়েছে। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে ডুবে গেছে আমন বীজতলা। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের পাঠানো। সিলেট অফিস জানায়, বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানি কিছুটা কমলেও সার্বিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় বন্যা কবলিত এলাকায় পানিবাহিত নানা রোগ দেখা দিয়েছে। বন্যার পানি নামার সঙ্গে এ ধরনের রোগবালাই বিশাল আকারে ছড়িয়ে পারতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই তার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বন্যা উপদ্রুত অনেক এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এবং দুর্গম এলাকায় পৌঁছতে পারছে না মেডিক্যাল টিম। এছাড়া বিশুদ্ধ পানির অভাবে বন্যাদুর্গতরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।। সিলেটের ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের বড়লেখায় ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগ ও ভাইরাস জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বানভাসি মানুষ। এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় কর্মহীন মানুষের মাঝে হাহাকার দেখা দিয়েছে। বিয়ানীবাজারের ৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ১৬টি ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিম আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিচ্ছে। সিলেটের সিভিল সার্জন জানান, বন্যা আক্রান্ত এলাকায় ঠা-াজনিত কারণে শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট ও সর্দি-কাশি দেখা দিয়েছে। যে কোন সময় ডায়রিয়ার মতো নানা ধরনের রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ডাঃ হিমাংশু বলেন, বন্যাকবলিত প্রতিটি ইউনিয়নে একজন মেডিক্যাল অফিসার কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্বে রয়েছেন। বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর উপজেলায় বন্যা আক্রান্ত এলাকায় ১১টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি আশ্র্রয় কেন্দ্রেও সকাল-বিকাল স্বাস্থ্যকর্মীরা খোঁজখবর নিচ্ছেন। কুশিয়ারা নদীর বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের কান্দিগাঁও এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। হাকালুকি হাওড়পারের বড়লেখা উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে দুর্গত এলাকায় ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত নারী-শিশুসহ ২৫ ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ৫ জন ভর্তি রয়েছেন। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার হাইল হাওড়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনকারী ৬টি ফিশারির অন্তত ৫০টি পুকুর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ফিশারির মালিকরা। অনেকেই ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফিশারি করলেও এখন তারা সর্বস্বান্ত। বেকার হয়ে পড়েছেন ফিশারিতে কর্মরত অন্তত দু’শ’ কর্মচারী। সড়ক-উপসড়কে ক্ষতচিহ্ন বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টিপাত কম থাকায় কক্সবাজারের লোকালয়ের বানের পানি নামতে শুরু করেছে। বন্যা কমে গেলেও জেলা সদর ঈদগাহ, চকরিয়া, রামু ও পার্শ্বস্থ পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির বন্যাদুর্গত মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। পানি নেমে যাওয়ার পর বিভিন্ন সড়ক-উপসড়কে ভেসে উঠেছে ক্ষতচিহ্ন। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট। এতে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ মোকাবেলায় গঠন করা হয়েছে সরকারী হাসপাতালের উদ্যোগে একাধিক মেডিক্যাল টিম। শুক্রবার সকাল নাগাদ আকাশে মেঘ থাকলেও বিকেলে খানিক রোদের দেখা মিলেছে। গত পাঁচদিনের ধারাবাহিক প্রবল বর্ষণ ও বন্যায় জেলায় এ পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে মহেশখালীতে ১ জন, সদরের ইসলামাবাদে ১ জন, রামুতে ৩ জন, উখিয়ায় ৫ জন এবং সীমান্তের ঘুমধুমে ১ জন। এবারে বন্যায় জেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে সদরের ঈদগাহ, রামু ও চকরিয়া। এদিকে ঈদগাহ ও চকরিয়ার বানভাসি মানুষ খুবই কষ্টে আছে। তাদের যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে, তা খুবই অপ্রতুল। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বৃহত্তর ঈদগাহ, চকরিয়া ও পেকুয়ার ২৭টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানি কমছে অতি ধীরে। চকরিয়ার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, হারবাং, ডুলাহাজারা, ফাঁসিয়াখালী, চিরিংগা, খুটাখালী ও ঈদগাহ থেকে পানি অনেকাংশে নেমে গেছে। বন্যার কারণে ৮০ শতাংশ টিউবঅয়েলের পানি পান অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী কামাল হোছাইন। ডুবে আছে আমন বীজতলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চরবেস্টিন এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ কৃষকের জন্য মহাসর্বনাশ ডেকে এনেছে। বিশেষ করে বেড়িবাঁধের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে হু হু করে ঢুকছে সাগর-নদীর জোয়ারের পানি। এতে প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ আমন ধানের ক্ষেত। ডুবে গেছে আমন বীজতলা। কৃষি বিভাগের হিসেবে ইতোমধ্যে তিন শ’ হেক্টর জমির আমন বীজতলা পানিতে পচে নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিদিন বাড়ছে বীজতলার ক্ষতির পরিমাণ। ফলে আমনের উৎপাদন নিয়ে এলাকার কয়েক হাজার কৃষক এখন চরম দুশ্চিন্তায় সময় পার করছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কৃষকের ক্ষতির সত্যতা স্বীকার করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় বেড়িবাঁধ মেরামত করতে পারছে না বলে জানিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) পটুয়াখালীর কলাপাড়া কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর মোহনায় জেগে ওঠা চরবেস্টিনের দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর। পশ্চিমে বুড়াগৌরাঙ্গ নদ। পূর্বে চর কুকরীর চ্যানেল এবং উত্তরে চরআন্ডার চ্যানেল। চরের মানুষের জানমালসহ ফসল রক্ষায় ১৯৯০ সালে চরবেস্টিনে ৫৫/৪ নম্বর পোল্ডারের আওতায় ৩২ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবল চাপে বেড়িবাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পানির ঢেউয়ের ঝাঁপটায় ও নদী ভাঙ্গনে। নির্মাণের পর থেকে প্রতিবছর বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হলেও তা সেভাবে মেরামত করা হয়নি। সর্বশেষ গত ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে পানি উন্নয়ন বোর্ড মাত্র চার লাখ টাকা বরাদ্দে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের অংশবিশেষ জরুরীভিত্তিতে মেরামত করেছিল। এরপর আর মেরামত বা সংস্কার হয়নি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বেড়িবাঁধের পুরো অংশই বর্তমানে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তবে ঘূর্ণিঝড় মোরার সময় বাঁধের চার কিলোমিটার অংশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে আমন ক্ষেত প্লাবিত হচ্ছে। শত শত একর আমন বীজতলা ডুবে আছে হাঁটুপানিতে। কৃষকদের মধ্যে চলছে এক ধরনের আহাজারি। কৃষক কাঞ্চন আকন জানান, সাড়ে সাত একর জমির জন্য তিনি বীজতলা করেছেন। কিন্তু সে বীজতলা এখন পানির নিচে। অবস্থাপন্ন কৃষক মোস্তফা হাওলাদার গত বছর ১২ কানি জমিতে আমনের আবাদ করেছিলেন। এবছরও একই পরিমাণ জমিতে আমনের আবাদ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু পুরো বীজতলা পানিতে ডুবে গেছে। রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত) আবদুল মান্নান জানান, বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০০ হেক্টর ফসলি ক্ষেত প্লাবিত হয়েছে। তিনি আরও জানান, এ অঞ্চলে ১৫ জুন থেকে বীজতলা তৈরি শুরু হয় এবং ১৫ জুলাই পর্যন্ত করা যায়। অন্যদিকে, কুড়িগ্রামে ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, হলহলিয়া, সোনাভরি ও জিঞ্জিরামসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি দিন দিন বেড়েই চলেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে নি¤œাঞ্চলে দেখা দিয়েছে বন্যা। বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে জেলার চর ও দ্বীপচরগুলোতে বন্যার পানি হু হু করে প্রবেশ করছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ। পানিবন্দীদের পাশে এখনও সরকারী কিংবা বেসরকারী পর্যায়ে সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। ফলে বানভাসি মানুষ পড়েছে চরম দুর্ভোগে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার দশমিক ১৪ সেন্টিমিটার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও ধরলার পানি ধরলাব্রিজ পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও দুধকুমার নদীর পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি ৪১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১ দশমিক ১৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নাগেশ্বরী, উলিপুর, রৌমারী, চিলমারী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নিচু এলাকায় সৃষ্ট বন্যার ফলে এই ৫ উপজেলায় প্রায় ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার জানান, বন্যায় ৫টি ওয়ার্ডে প্রায় ১৭শ’ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ব্রহ্মপূত্র তীরে যাত্রাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখন হুমকির মুখে। এখন পর্যন্ত সরকারী বা বেসরকারীভাবে সহায়তার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
×