ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

আবার পাহাড় ধস আবারও মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৫ জুলাই ২০১৭

আবার পাহাড় ধস আবারও মৃত্যু

ভারতের উত্তরাখ-ের গারওয়াল হিমালয় উপত্যকায় চিপকো পরিবেশ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এক মিথকে কেন্দ্র করে। মিথটি এ রকমÑওই অঞ্চলের ভূস্বামী মহারাজা নতুন প্রাসাদ বানাবেন এ জন্য প্রচুর কাঠ দরকার। মহারাজা কাঠ কাটতে লোক পাঠালেন। তারা যে বনে গেল তার লাগোয়া গাঁয়ে বাস করত ছোট মেয়ে অমৃতা। প্রতিদিনের মতো ওইদিন সে বনে যায় শুকনো ডাল ও লতাপাতা কুড়াতে। কুড়াল হাতে রাজার লোকদের বনে ঢুকতে দেখে প্রথম সে অবাক হয়, পরে তাদের উদ্দেশ্য বুঝে গ্রামে গিয়ে অন্য মেয়েদের খবর দেয়। সবাইকে নিয়ে বনে যায় সে। রাজার লোকদের অনুরোধ করে গাছ না কাটতে। অমৃতার অনুরোধ উপেক্ষা করে তারা গাছ কাটতে যায়। অমৃতা ও তার দল তখন প্রত্যেকে একটি করে গাছ জড়িয়ে ধরে বলে, আমাদের গায়ে কুড়াল না চালিয়ে কেউ গাছের গায়ে কুড়াল চালাতে পারবে না। রাজার লোকেরা বেপরোয়া। গাছে সেঁটে থাকা অমৃতা ও তার সঙ্গীদের ওপরই কুড়াল চালায় তারা। তবু গাছ চাই। মৃত্যুর আগে অমৃতা বলেছিল, আমাদের জীবনের দাম আর কতটুকু, তার বদলে বেঁচে যাক একটি বন। মিথে সত্যি-মিথ্যা যাই থাক এর প্রভাবিত করার ক্ষমতা অসাধরণ। এর শক্তিকে ধারণ করে ১৯৭৪ সালে ওই এলাকার রেনি গ্রামে বন কাটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় একদল গ্রামীণ নারী। ঠিক অমৃতার মতো। কোন পরিবেশ সচেতন আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে নয়, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে তারা শিখেছিলÑ বন বাঁচলে তারা বাঁচবে। কারণ তাদের জীবন চক্রর শুরু থেকে শেষ ওই বন ঘিরে। বৃক্ষ আঁকড়ে বেঁচে থাকা তাদের। আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে যারা পাহাড় আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল তারা পাহাড় রক্ষা দূরের কথা নিজেদের জীবনই রক্ষা করতে পারেনি। বার বার আঁকড়ে ধরেছে আর পাহাড় প্রত্যাখ্যানে ঠেলে দিয়েছে দূরে, একেবারে মৃত্যু পর্যন্ত অথচ এই পাহাড়ের গুহায়ই রয়েছে প্রাচীন মানবের বসবাসের দলিল। প্রকৃতির খরতাপ থেকে পাহাড়ই আগলে রেখেছিল তাদের। সমতলে নামার ইতিহাসে এরপর যোগ হয়েছে নানা মাত্রা। একই বৃত্ত ও বলয়ে তৈরি হয়েছে দুই ধারা। এক ধারায় কেবলই মৃত্যু আর অনিশ্চয়তা। অন্য ধারায় প্রশাসন আইন-আদালত ও পরিবেশবাদী জৌলুস। সেখানে পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার বাণী আসে; আর একের পর এক ধ্বংস হয় পাহাড়। আইনী ব্যবস্থার ভাঙ্গা রেকর্ড বেজেই চলে...। তারকা পরিবেশবাদীরা মানববন্ধনে রাস্তায় নামেন। সেমিনারে বিশ্ব পরিবেশ আন্দোলনের সর্বশেষ তথ্য তুলে নাগরিক দর্শক-শ্রোতার চিন্তিত মনে আরেকটু দুশ্চিন্তা জাগিয়ে মোটা মোটা নথি পাঠান দাতাদের দফতরে। আর পাহাড়ের ঢালে কিংবা নিচে আশ্রয় নেয়া মানুষেরা ঘুমের মধ্যে কেবলই মরে যায় মাটি ধসে। টাকার বিনিময়ে যারা তাদের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে, তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। দৈনিকের পাতায় আহত নিহত আর উদ্ধারকর্মীদের ছবি। ক’দিন সম্পাদকীয় উপসম্পাদকীয়র দারুণ ইস্যু তৈরি হয়। তারপর আবার অপেক্ষা। আরেকটি পাহাড় ধসের। এসব মৃত মানুষ এ দেশের নাগরিক নন? যারা রাষ্ট্র চালান তাদের কাছে এদের জীবনের মূল্য না থাক, ভোটের মূল্য তো আছে। যে মূল্য কোটিপতির একটি ভোটের, সেই একই মূল্য এদের ভোটের। অন্তত এ সুবাদে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা এ মানুষেরা আশা করতেই পারে। বাঁচার কথা না হয় বাদই থাকল। সে তো বরাবরই নড়বড়ে। সেই গুহা জীবন থেকে এ কালের এই আধুনিক ইতিহাস-যুগ পর্যন্ত সমান অনিশ্চয়তায় বাঁচা তাদের। পাহাড় ধস, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ে তাদের মৃত্যু অনিবার্য। যাবতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মূল টার্গেট তারাই। প্রকৃতির যে দুর্যোগ মানুষ ডাকে তার টার্গেটও তারাই। বেঁচে থেকে যারা খবরের শিরোনাম হয় না লাশ হয়ে জানায় তারা ছিল। আর যারা বন-পাহাড় কেটে মরিয়া হয়ে ছুটছেন, তাদের গন্তব্য শেষ পর্যন্ত কোথায়। বেঁচে থাকার জন্য ঘরদোরের মতো বন-পাহাড়, নদী, মাঠও কি প্রয়োজন নেই? জনসংখ্যার চাপে প্রকৃতিতে হাত দিতে হতেই পারে। তবে তা মানুষের জীবন বাজি রেখে হতে হবে কেন। ছলছুতোয় বেপরোয়া চললে প্রকৃতিও প্রতিশোধ নেয়। চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা হচ্ছে বহুদিন থেকে। গত দশ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়েছে চল্লিশটির মতো পাহাড়। দেড় শ’র বেশি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। আর কক্সবাজারে রামুতেই ধ্বংস হয়েছে দশ-পনেরোটির বেশি পাহাড়, পাঁচ-সাতটি ধ্বংসের পথে। হিসাব করলে সংখ্যাই শুধু বাড়ে। সমানতালে কাটার হারও। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা আইনকানুনের কথা শোনান, তারপর কি থেকে কী হয় কেউ জানে না। আবার সেই পুরনো খেলা। ২০০৭ সালের জুনে এক শ’ ছত্রিশজন মারা যাওয়ার পর প্রশাসন নড়েচড়ে উঠেছিল। পাহাড়ের ঢাল ও নিচে বাস করা মানুষদের সরিয়ে অন্য জায়গায় বসবাসের ব্যবস্থা করার কথা বলেছিল। দুটো কমিটিও হয়েছিল। তারা পাহাড় ধসের আঠারোটি কারণ চিহ্নিত করে পাহাড় ও জীবন রক্ষায় ছত্রিশ দফা সুপারিশে জাতীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলেছিল। পাহাড় থেকে দশ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাঁটি ও পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং নিষেধ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসতি বন্ধ করার জন্য ভিজিলেন্স টিম গঠন, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ঘিরে দ্রুত সীমানা দেয়াল নির্মাণ, পাহাড়ে ব্যাপক বনায়ন এবং পাহাড় কাটা প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া ইত্যাদির কথা বলেছিল। এক বছরে এসব শর্তের কোনটিরই তেমন বাস্তবায়ন হয়নি। বরং শহর ও শহরতলিতে প্রভাবশালীদের প্রভাব আরও বেড়েছে। ঘরহীন মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে আশ্রয় নিয়েছে সেই ঝুঁকিময় পাহাড়েই। সংখ্যায়ও বেড়ে লাখের ঘর ছাড়িয়েছে। তদন্ত কমিটি পাহাড় দখল ও ধ্বংসের বিহাইন্ড দ্য স্ক্রীন কুশীলবদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও রেখেছিল। তাও কি হয়! শর্ষেতেই তো ভূত রয়েছে। অদৃশ্য ওই ভূত নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের অভিনবত্বকেও হার মানিয়েছে পাহাড় কাটার অভিনব কৌশল টিলার চূড়ায় পুকুর কেটে। দশ ফুট গভীর পুকুরে বৃষ্টির পানি জমলে ভেতর থেকে নরম হয়ে দুর্বল হবে টিলা। তারপর এক সময় ধসে পড়বে। দু’হাজার এগারোয় চট্টগ্রামের বাটালিহিলে পাহাড় ধসের ঝুঁকি এড়াতে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিল। অভিযানের কয়েক ঘণ্টা পর পাহাড়ের সুরক্ষা দেয়াল ধসে মর্মান্তিক এক দুর্ঘটনা ঘটে। ধসের আশঙ্কায় আগের দিন সন্ধ্যায় মেয়রের উপস্থিতিতে অভিযান চালিয়ে তিরিশটি ঘর থেকে দেড় শ’র বেশি মানুষ সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান শেষে উচ্ছেদ হওয়া অনেকেই রাতে নিজের ঘরে ফিরে এসে দুর্ঘটনার শিকার হন। স্থানীয়রা বলেছেন, উচ্ছেদ অভিযান না হলে আহত ও নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ত। সকালে প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি ও কাদা মাটির চাপে একটি দেয়াল ধসে যেতে থাকে। উদ্ধারকারী অভিযান কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা ঘরে না ফিরলে এ মৃত্যু এড়ানো যেত। কিন্তু ঘরে না ফিরে কোথায় যাবে তারা। কোন আশ্রয় কেন্দ্র তো ছিল না। সিটি কর্পোরেশন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে নিঃসন্দেহে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হলো কই। আশ্রয় কেন্দ্রের ব্যবস্থা করলে তাদের দায়িত্বশীলতা পূর্ণতা পেত। বেঁচে যেত অনেক প্রাণ। সিটি কর্পোরেশন তাদের উচ্ছেদ করলেও থাকার জন্য কোন আশ্রয় কেন্দ্র খোলেনি। ফলে আশপাশে যাদের আত্মীয়স্বজন নেই তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে ঘরে ফিরে গেছেন। প্রচ- বর্ষণে তাদের থাকার কোন জায়গা ছিল না। যেসব মস্তান এসব কাঁচা ঘর বানিয়ে ভাড়া দেয় দুর্ঘটনার পর তাদের আর দেখা যায় না। এসব ঘরে রিক্সাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা ও দিনমজুররা বাস করে। এখনও পর্যন্ত ঝুঁকি এড়ানোর ব্যবস্থাপনা কম-বেশি এভাবেই চলছে। বাটালি হিলের ধস ঠেকাতে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। পাহাড়ের নিচে পর পর দুটো দেয়াল দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল সীমানা প্রাচীর। দুই দেয়ালের মাঝখানে বালি ভরাট করা হয়। এরপর ওপরে পাকা সø্যাব দিয়ে তা ঢেকে রাখা হয়। উদ্ধার কর্মীরা বলেছেন, যেখানে ধসে পড়েছে সেখানে সø্যাব ছিল না। এর ফলে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি ও বালি ওই অংশে ঢুকে পড়ে। এতে অতিরিক্ত চাপে দেয়ালের নিচের অংশ ধসে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মৃত্যু ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা যাদের ছিল না, তারাই প্রাণ হারিয়েছে। গত শতকের ষাট দশকে দার্শনিক আলোচনায় নতুন সংযোজন হিসেবে পরিবেশ দর্শনের ধারণা গুরুত্ব পায়। পরিবেশ দর্শন বলে, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে সম্পর্ক তা টিকিয়ে রাখার দায় মানুষেরই। কারণ প্রকৃতিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালালে প্রকারান্তরে তা মানুষের ধ্বংসের সম্ভাবনা বাড়ায়। পরিবেশ দর্শন যেসব মৌলিক বিষয়ে প্রশ্ন তোলে তা এ রকমÑ মানুষের ভোগের জন্য কি প্রাকৃতিক সম্পদ বা বনজসম্পদ ধ্বংস করা উচিত? গ্যাসোলিনচালিত যান, খনিজসম্পদ ব্যবহার কি অব্যাহত থাকবে? ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি আমাদের কি কোন নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে? মানুষের কল্যাণের জন্য কি কোন প্রাণী বিলুপ্ত করা উচিত? ব্যবহারিক জীবনে সঙ্কটের মুখোমুখি হতে এ ধরনের তাত্ত্বিক বা দার্শনিক ভিত্তি তৈরির চেষ্টা হয়েছে। ধরা যাক, প্রতিবেশের সমন্বয়ের জন্য অনেক সময় বিশেষ প্রজাতির প্রাণী হত্যার প্রয়োজন হতে পারে, পাহাড়ী এলাকার মানুষের বাসের অনুকূল পরিবেশের জন্য অনেক উদ্ভিদ আগুনে পোড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। কিংবা প্রাণের যে কোন ধরন বিনষ্ট করার প্রয়োজন দেখা দেবে। কোন একটি কৃষি অধ্যুষিত এলাকায় কৃষকরা তাদের কৃষি খামার তৈরির জন্য উদ্ভিদ, গুল্মলতা এবং অনেক প্রাণের ক্ষতি করতে পারে। কাজ সহজ করার জন্য এগুলো আগুনে পোড়ানোর প্রয়োজন হবে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারেÑ এ কাজগুলো করা কি নৈতিকভাবে ঠিক? এ ধরনের সমস্যার সুবিধাজনক দিকটিকে প্রাধান্য দিয়ে নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করাই পরিবেশ দর্শনের উদ্দেশ্য। পাহাড় যারা কাটে এ ধরনের নৈতিক প্রশ্ন তাদের মাথায় থাকা উচিত বেশি করে। তবে এসব নরম দার্শনিক কথা শুধু কথারই মারপ্যাঁচ। দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক কর্মকা- বন্ধ না হলে এসব কখনও বন্ধ হবে না। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্রছায়ায়ই পাহাড় কাটার মতো জটিল কাজ সম্পন্ন হয়। তথ্যসূত্র : ‘নতুন দিগন্ত’ [email protected]
×