ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

দারিদ্র্যই ওদের বড় বাধা

১০ বছর বয়সেই স্কুল ছেড়ে লেগুনার হেলপার

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৩ জুলাই ২০১৭

১০ বছর বয়সেই স্কুল ছেড়ে লেগুনার হেলপার

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ আল-আমিনের বয়স বারো বছর। পঞ্চম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা না দিয়েই দুই বছর আগে সে বিদ্যালয়ের গ-ি না পেরিয়ে রোজগারের আশায় লেগুনার হেল্পার হিসেবে কাজ শুরু করেছে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় তার বাবা-মা তাকে পড়ালেখায় বাধ্য করেনি বরং রোজগারের আশায় বের করে দিয়েছে পথে। আল-আমিনের ভাষ্য, ‘ছোট ভাই পড়ে ক্লাস টু’য়ে। আমি পড়লে অহন সেভেনে থাকতাম। বাপে রিক্সা চালায়, সংসার চলে না তাই আমারে কামে লাগাইয়া দিছে। ডেইলি ৩০০ ট্যাকা রোজগার করি। অহন আমারও আর পড়বার মন চায় না।’ দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় আল-আমিনের মত অনেক শিশু প্রাথমিক, নিম্ন-মাধ্যমিক আবার কখনও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সংখ্যা কমলেও দিনকে দিন বেড়েই চলেছে নিম্ন-মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার সংখ্যা। যদিও শিক্ষার্থী ঝরে পড়া বন্ধে সরকারী উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। তবুও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া কমছে না। সম্প্রতি, ইউনেস্কো কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিগত ১৫ বছরে প্রাথমিক, নিম্ন-মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের প্রায় ১ কোটি শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে ঝরে পড়েছে। আর বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে এদিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের দেশের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার নিয়ন্ত্রণে আসায় বিগত কয়েক বছরে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আর শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার অন্যতম কারণগুলো হলোÑ অভিভাবকদের নিম্ন আয়, বাল্যবিয়ে ও দারিদ্র্য। ‘রিডিউসিং গ্লোবাল পোভার্টি থ্রু ইউনিভার্সাল প্রাইমারি এ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন’ নামক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০০-১৫ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৬৪ মিলিয়ন। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা হঠাৎ করেই স্কুল ও কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়। দারিদ্র্যের কারণে অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে দেয়। এসব শিশুর কেউ কাজে যোগ দেয়। আবার কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দেয়। অপরদিকে যে সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ঝরে পড়া দেখানো হচ্ছে, তারা আসলে শিক্ষার্থীই নয়। স্কুলগুলোতে ভুয়া ভর্তি দেখানো হয়। নকল ভর্তি দেখানোয় ঝরে পড়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যারা আসলেই শিক্ষার্থীই নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না। গত অর্থবছর (২০১৬-১৭) শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ১১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এ অর্থবছর (২০১৭-১৮) তা কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এ বরাদ্দ দিয়ে আধুনিক ও উন্নতমানের দেশ গড়া সম্ভব নয়। এছাড়া, শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টি ও শূন্যপদে নিয়োগ না দেয়ায় শিক্ষার্থীর অনুপাতে বাড়ছে না শিক্ষক সংখ্যা। ফলে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতের ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩৩৩টি। এসব বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের ১০ হাজার ৬টি পদের মধ্যে ১ হাজার ৭৪৪টিই শূন্য। প্রধান শিক্ষকের ৩২৪টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৮৪। শিক্ষক সংখ্যা কম হওয়ায় পাঠদানের পাশাপাশি তাদের দাফতরিক বিভিন্ন কাজও করতে হয়। ফলে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। দেশের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বর্তমানে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য নয় বরং শিক্ষায় অতিমাত্রায় ব্যয়কে দায়ী করেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া নিয়ন্ত্রণ হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। বর্তমানে দরিদ্র ব্যক্তিও চান তার সন্তান লেখাপড়া করুক। এজন্য বিভিন্ন বেসরকারী স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে যে বাণিজ্য চলছে, তাতে টিকতে না পেরে অনেকেই ঝরে যাচ্ছে। এছাড়া অভিভাবকদের নিম্ন আয়, বাল্যবিয়ে ও দারিদ্র্যের কারণেও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। বর্তমানে শুধু উপবৃত্তির টাকা দিয়ে পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। কারণ কোচিং-প্রাইভেটসহ অন্যান্য খরচ রয়েছে। তিনি বলেন, নোট-গাইড আর প্রাইভেট-কোচিংয়ের দৌরাত্ম্য চলছে। এটা কম আয়ের মানুষের পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। এছাড়া সামাজিক ও আর্থিক বাস্তবতার কারণেও প্রান্তিক অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে।’ ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়া ৬১ মিলিয়ন শিশুর নাম স্কুলে নিবন্ধিত আছে কিন্তু তারা এখন স্কুলের বাইরে। ২০০০ সালে স্কুল থেকে ঝরে পড়া মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭ কোটি ৪০ লাখ থেকে বর্তমানে ২৬ কোটি ৪০ লাখের নিচে নেমে এসেছে। ২০০৮ সাল থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুল থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীর হার বাড়েনি। এরপর নিম্ন মাধ্যমিকে ২০১২ এবং ২০১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সংখ্যা কমেনি বরং স্থিতিশীল রয়েছে। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিস্টিকসের (ইউআইএস) তথ্য মতে, বিগত ১৫ বছরে উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ঝরে যাওয়া শীর্ষ তিন দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় (৭ দশমিক ১ মিলিয়ন), দ্বিতীয় পাকিস্তান (৯.৮ মিলিয়ন) এবং শীর্ষ অবস্থানে ভারত (৪৬.৮ মিলিয়ন)। অন্যদিকে, বাংলাদেশে নিম্ন-মাধ্যমিকে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ মিলিয়ন। এদিক থেকে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম। শীর্ষে আছে ভারত (১১ দশমিক ১ মিলিয়ন), দ্বিতীয় পাকিস্তান (৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন), তৃতীয় ইথোপিয়া (৪.৬ মিলিয়ন) এবং চতুর্থ ইন্দোনেশিয়া (২ দশমিক ২ মিলিয়ন)। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে যেসব দেশের শিশুরা সেদিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তেরো (শূন্য দশমিক ৮ মিলিয়ন)। ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং (জিইএম) প্রতিবেদন বলা হয়েছে, উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শিক্ষার্থীরা যদি ঝরে না পড়ে তাহলে প্রায় ৬ কোটি লোক দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। আর তখনই দক্ষিণ এশিয়া ও সাব সাহারান আফ্রিকার গরিব জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৪২ কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। বিশ্বব্যাপী এখনও ৯ শতাংশ শিশু প্রাথমিক, ১৬ শতাংশ নিম্ন মাধ্যমিকে এবং ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষা অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তবে আশার কথা হলো, দরিদ্র দেশগুলোর মেয়েশিশুরা শিক্ষার জন্য বিশেষভাবে চরম বাধা মোকাবেলা করছে। ইউআইএস ডেটা অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের দেশে, প্রাথমিক স্তরের ১ কোটি ১০ লাখের বেশি মেয়েশিশু স্কুলে যায় যেখানে ছেলেদের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) প্রকাশিত ২০১৫ সালের শিক্ষা তথ্য প্রতিবেদনের তথ্য মতে, প্রাথমিক শেষে মাধ্যমিকে আসা শিক্ষার্থীদের ৪০ দশমিক ২৯ শতাংশই দশম শ্রেণী শেষ করতে পারে না। সংস্থাটির বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০১৫ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ২০ হাজার ২৯৭ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার ৭২ জন। এর মধ্যে ৫১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬২ জনই ছাত্রী। তবে এ পর্যায়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া ছাত্রীদের মধ্যে মাত্র ৫৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ মাধ্যমিক শেষ করতে পারে। অন্যরা ঝরে পড়ে। এর বিপরীতে ছাত্রদের ঝরে পড়ার হার তুলনামূলক কম। এ পর্যায়ে ভর্তি হওয়া ৬৬ দশমিক ২৮ শতাংশ ছাত্র মাধ্যমিক স্তর শেষ করতে পারে। নিয়মিত মেয়াদে মাধ্যমিক স্তর সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও ছাত্রীরা পিছিয়ে রয়েছে। নিয়মিত মেয়াদে ছাত্রদের মাধ্যমিক স্তর সম্পন্নের হার যেখানে ৭৬ দশমিক ৪ শতাংশ, সেখানে ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এ হার ৬৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
×