ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষণশীল বাণিজ্যনীতি ॥ সাবধান হওয়া উচিত

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৩০ জুন ২০১৭

যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষণশীল বাণিজ্যনীতি ॥ সাবধান হওয়া উচিত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডস সফর করে দেশে ফিরেছেন। এই সফরের ফলাফল নিয়ে ভারতের মিডিয়া তো বিশদ আলোচনা করছেই, একই আলোচনা করছে পাকিস্তানী মিডিয়াসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়াও। আমি সফরের সকল দিক নিয়ে আলোচনা করব না। আমি শুধু একটা বিষয়ের প্রতি আমাদের পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আর সেটা হলো রফতানি। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দিয়েছে ভারতের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ঘাটতির ওপর। তারা বলেছে ভারতের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার এবং তা বাড়তির দিকে। তারা এর অবসান চায়। যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও মাল/পণ্য আমদানি করুক। এখানেই আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই দুই-চার বছর আগের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চীন সফরে গিয়ে চীনা নেতৃত্বকে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, শুধু রফতানি করলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রের মালও আমদানি করতে হবে। চীনকে তিনি একটি উপদেশও দিয়েছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন অভ্যন্তরীণ বাজার সৃষ্টি করতে। বলা বাহুল্য চীন এখন সেদিকে একটু নজর দিয়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এশিয়া-আফ্রিকার বাজারের দিকেও চীন নজর দিয়েছে। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ তার উদাহরণ। প্রেসিডেন্ট ওবামার সেই নীতির আগ্রাসী বাস্তবায়ন শুরু করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারতীয়রা মার্কিনী ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করেন। তাদের শক্ত ‘লবি’ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। তার পরও ট্রাম্প নিজে দেশীয় স্বার্থের প্রশ্নে অনড়। তিনি ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি বাতিল করেছেন। জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছেন। ভারতকে ‘পরম বন্ধু’ বললেও ‘এইচ ওয়ান ভিসা’ সমস্যার কোন সমাধান করেননি। যার বদৌলতে হাজার হাজার ভারতীয় আইটি পেশাজীবীরা যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। সেটা তো করলেনই না, বরং উল্টো বললেন ‘বাণিজ্যসমতার’ কথা। আমি এ সবের উল্লেখ কেন করছি? কারণ এর থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে বিশ্বায়ন, উদার বিশ্ব বাণিজ্য, উন্মুক্ত বৈদেশিক বাণিজ্য নতুন প্রশ্নের মুখে। প্রশ্নটি উত্থাপন করছে কে? যারা উদার বাণিজ্যের প্রবক্তা, বিশ্বজুড়ে যারা বাজার অর্থনীতি, উন্মুক্ত বাণিজ্যের প্রবক্তা, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ‘বিশ্বায়নকে’ নতুনভাবে দেখতে শুরু করেছে। তারা চায় তাদের বড় বড় কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রেই কারখানা গড়ে তুলুক, মার্কিনীদের চাকরি হোক। তারা অবৈধ অভিবাসীদের আগের মতো বৈধ করতে চায় না। তাদের স্বপ্ন দেশে ফেরত পাঠাতে চায়। এটা ‘প্রটেকশনিস্ট’ বা নতুন সংরক্ষণশীল নীতি, যা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বকে প্রভাবিত করবে। এতসব বলার উদ্দেশ্য একটা। আমরা যে রফতানি নীতি নিয়ে এগোচ্ছি, সে সম্পর্কে নতুন করে ভাবা। আমাদের নীতি ‘এক্সপোর্ট এ্যান্ড ডেভেলপ’, যা বস্তুত পরিণত হয়েছে ‘এক্সপোর্ট অর প্যারিস’ নীতিতে। তাও কী? অনেক পণ্য নয়, একটি মাত্র পণ্য। দেখা যাচ্ছে আমাদের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে পোশাক রফতানি থেকে। তাও কী? কয়টা দেশে রফতানি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোই আমাদের প্রধানতম বাজার। অর্থাৎ এক পণ্য এবং এক অঞ্চলেই আমাদের রফতানি বাণিজ্য সীমিত। এদিকে রফতানি পণ্য আরও একটি আছে। সেটি অবশ্য পণ্য নয়, সেটি জনশক্তি রফতানি। এই দুটোই আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। দেখা যাচ্ছে এই দুটোতেই সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। রফতানি, পোশাক রফতানি আগের মতো বাড়ছে না। মূল্য প্রতিযোগিতা টিকে থাকার জন্য আমাদের পোশাক রফতানিকারকরা তাদের কারখানার আধুনিকীকরণ করছেন। আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগাচ্ছেন, এমন কি ‘রোবটও’ লাগানো শুরু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। ফলে এই খাতে আগের মতো কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এটা আবার উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্রও আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ভারতের মতো বন্ধু দেশকে বলছে বাণিজ্য সমতা আনার জন্য, বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করার জন্য; সেখানে একই কথা তো আমাদেরও বলতে পারে। আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়, ইউরোপের অনেক দেশেরই তা। তারা আমাদের কাছ থেকে আমদানি করে বেশি, রফতানি কম। আমরা আমদানি করি সবচেয়ে বেশি চীন থেকে। চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি বিশাল। অথচ এই কথাটি সেভাবে আলোচিত হয় না। যেটি হয় সেটি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি। অথচ ভারতের সঙ্গে ঘাটতির পরিমাণ এখন কম, বেশি হচ্ছে চীনের সঙ্গে। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যদি বলে আমদানি বাড়াও, রফতানি কমাও তাহলে কী দাঁড়াবে? ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পণ্য রফতানি বেশ ভাল পরিমাণেই হ্রাস পাচ্ছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার। সেই বাজারে জানুয়ারি মাসে মাল রফতানি হয়েছে ৫৩৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের। সেখানে এপ্রিলে এর পরিমাণ হ্রাস পেয়ে হয়েছে মাত্র ৪২২ মিলিয়ন ডলার। একটি কাগজে দেখলাম গত দশ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাল রফতানি ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অর্থনীতিবিদ এবং রফতানিকারকরা একযোগে বলছেন আগে এ ধরনের অবস্থাতে কখনও বাংলাদেশ পড়েনি। কী কারণে এটা ঘটছে তা ভাল করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার। অন্যান্য দেশের রফতানিতে শুল্ক কম যুক্তরাষ্ট্রেÑ এটি একটি কারণ। টাকা-ডলার বিনিময় হার কী আরেকটি কারণ? না, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সংরক্ষণনীতি কারণ? যেভাবেই দেখা হোক না কেন, একটি বিষয় পরিষ্কার। প্রথমত রফতানি আয় আগের মতো বাড়ছে না, লক্ষ্যমাত্রামাফিক তো নয়ই। এটা উদ্বেগের বিষয়। কারণ আমাদের উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি রফতানি। রফতানিতে টান পড়লে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। অধিকন্তু সমস্যা আরেকটা। আর সেটা হচ্ছে ‘রেমিটেন্স’। এটিও আমাদের প্রাণ ভোমরা। লাখ লাখ বাংলাদেশী বিদেশে কাজ করে। এদের সিংহভাগই গ্রামের ছেলেমেয়ে, কৃষকের ছেলেমেয়ে। এরা যে ‘রেমিটেন্স’ পাঠায়, তা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। শুধু ভরণ-পোষণ নয়, রেমিটেন্স গ্রামীণ পরিবারগুলোর জীবনযাত্রাকেও উন্নত করছে। ‘রেমিটেন্স’ আমাদের শিল্পায়নকে সাহায্য করছেÑ ভোগান্তরকে ধরে রেখেছে। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। এমন একটা জনশক্তি রফতানিপ্রসূত আয় ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। চলতি অর্থবছরেই রেমিটেন্স থেকে প্রাপ্ত আয় ১৫ শতাংশের মতো কম হতে পারে। এক নম্বরে রফতানি আয় আগের মতো বাড়ছে না, রফতানি বাজার সঙ্কুুচিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ট্রাম্পের সংরক্ষণশীল নীতির কারণে, দুই নম্বরে সমস্যা দেখা দিয়েছে ‘রেমিটেন্স’। রেমিটেন্স হ্রাস পাচ্ছে। এ দুটোর প্রতিক্রিয়া-প্রভাব অর্থনীতিতে কী হতে পারে, তা আগেভাগে ভেবে রাখা উচিত। আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কথা বলছি না। প্রস্তুতির কথা বলছি। স্পষ্টতই বোঝা যায় রফতানি আগের মতো না বাড়লে এবং রেমিটেন্স প্রবাহে অধোগতি রোধ করা না গেলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে চাপ পড়বে। বর্তমানে যে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ আছে, তাকে আমরা জানতাম প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত। কিন্তু ইদানীং আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা বলছেÑ না, তোমাদের রিজার্ভ আরও বাড়ানো দরকার। কোনটা সত্য তা সময়ই বলবে। তবে সাবধানের মার নেই। এই ক্ষেত্রে চাল থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার। সামান্য একটা ঘটনা। বৃহত্তর সিলেটের ৪টি জেলা এবং কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় ফসল নষ্ট হয়েছে। কারণ অতিবৃষ্টি এবং অসময়োচিত পাহাড় ঢল। উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে মাত্র ৫-৬ লাখ টন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বোরো ধান সংগ্রহে ব্যর্থতা, অপরিকল্পিতভাবে চাল বণ্টন। ফল কী? ফল, চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। কৃত্রিম চাল সঙ্কটে সরকার এখন সমালোচিত। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে বৈকি! বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ পরিস্থিতি ভাল। এতে আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ নেই। রফতানির প্রবৃদ্ধির হার কম, রেমিটেন্স হ্রাস- এ দুটো তো আছেই। অধিকন্তু এর সঙ্গে যোগ করতে হবে আরও কয়েকটি বিষয়। এক নম্বরে ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’। এই খাতে ডলারে ভবিষ্যতে পরিশোধযোগ্য দেনা এই মুহূর্তে আমাদের কত? আমার জানা নেই। এর হিসাব দরকার। এই মুহূর্তে আমাদের বৈদেশিক ঋণ কত? তার সুদ ও আসল পরিশোধের পরিমাণ আগামী ৫ বছরে কীভাবে বাড়বে তার হিসাব দরকার। কোন কোন অর্থনীতিবিদ মেগা প্রজেক্টের কথা উল্লেখ করছেন। এই খাতে দেনা পরিশোধের জন্য ডলারের চাহিদা আগামী দিনে কেমন হতে পারে তার হিসাবও দরকার। এসব দিক বিবেচনা করে আমাদের এগোনো দরকার। আমার ধারণা বিশ্ব পরিস্থিতি, বিশ্ববাণিজ্য বিশ্বায়ন ইত্যাদি নতুন করে একটা চাপের মুখে। এমতাবস্থায় শুধু ‘রফতানি, রফতানি’ করে এগুলে হবে না, অভ্যন্তরীণ বাজারও সৃষ্টি করতে হবে। ডলারের ভবিষ্যত চাহিদা হিসাব করে আমাদের পরিকল্পনা করা দরকার। রিজার্ভ পরিস্থিতিতে আত্মতুষ্টিতে ভোগা ঠিক হবে না। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×