ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ে মহাদুর্যোগে কয়েক শ’ কোটি টাকার ক্ষতি

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২৪ জুন ২০১৭

পাহাড়ে মহাদুর্যোগে কয়েক শ’ কোটি টাকার ক্ষতি

চট্টগ্রাম অফিস/নিজস্ব প্রতিনিধি, রাঙ্গামাটি ॥ ভারিবর্ষণে পাহাড়ধসে ও ঢলের পানিতে পাহাড়ে ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সড়ক বিভাগ, জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে। সড়কধস, পাহাড়ধস, লোকালয় ল-ভ-, উৎপাদিত শস্য ও ফলফলাদি বিনষ্ট হওয়াসহ অর্থনৈতিক কর্মকা-ে বিপর্যয় নেমে আসার ঘটনায় এ ক্ষতি সঠিকভাবে নিরুপণ করা কঠিন হলেও বিভিন্ন সংস্থা, জেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে। গত ১৩ জুন একই সময়ে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে একই ধরনের দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে। এতে সবচেয়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে রাঙ্গামাটি জেলায়। যা নজিরবিহীন। গত বুধবার সাপছড়ির বিধ্বস্ত সড়কটি সংস্কারের মাধ্যমে নতুনভাবে পাহাড় কেটে যোগাযোগ ব্যবস্থা শুরু করা হলেও তা টিকিয়ে রাখা নিয়ে সংশয় শুরু হয়েছে। সড়ক বিভাগ সূত্রে জানানো হয়েছে, সাপছড়ির বিধ্বস্ত সড়ক এলাকাজুড়ে বেইলী ব্রিজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর অন্য কোন বিকল্প না থাকায় সমন্বিতভাবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বুধবার থেকে হালকা যানবাহন চালু হলেও রাতের বেলায় তা বন্ধ রাখা হচ্ছে, যাতে নতুন করে কোন ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি না হয়। বৃহত্তর চট্টগ্রামে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টি বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। রাঙ্গামাটিতে যে ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে তা নির্ণয় করা পরিপূর্ণভাবে আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, শহর এলাকার ক্ষতির বিপরীতে এর সংস্কারে প্রশাসনিক কার্যক্রম জোরালো হলেও অন্য ৯ উপজেলার পরিস্থিতিতে উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগের ৯ দিন পর রাঙ্গামাটি চট্টগ্রাম সড়ক হালকা যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। সড়কটি চালু হওয়ার ২দিন পর সড়ক ধসে পড়া ওই স্থানটি বিপজ্জনক থাকায় সেখানে নতুন করে বেইলী ব্রিজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক বিভাগ। শুক্রবার থেকে সড়ক বিভাগ সাপছড়ির ধসে যাওয়া সড়কের ওই অংশে বেইলী ব্রিজ করার কাজও শুরু করেছে। রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ এমদাদ হোসেন জানিয়েছেন, প্রতিনিয়ত ভারি বৃষ্টির কারণে এক লেনের সরু রাস্তাটি টিকিয়ে রাখা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে ওই স্থানে ১৬০ ফুট দীর্ঘ ২টি স্পেনের বেইলী ব্রিজ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত চীফ ইঞ্জিয়ারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে রাঙ্গামাটির ওই স্থানের জন্য বেইলী ব্রিজের ডিজাইন প্রেরণ করা হয়েছে। আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে ব্রিজের কাজ সমাপ্ত হবে বলে সড়ক বিভাগ সূত্রে জানানো হয়েছে। ১৮ পাইপের ওপর ব্রিজটি তৈরি হয়ে গেলে রাঙ্গামাটির সঙ্গে আগের মতো ওই সড়ক দিয়ে ভারি ও হালকাসহ সকল ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পরবে বলে নির্বাহী প্রকৌশলী দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে। গত বুধবার সড়কটি হালকা যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ায় শহরের মানুষ দীর্ঘ ৯ দিনের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যত শঙ্কা নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে। বুধবার বিকেলে সাপছড়ি এলাকায় পাহাড় কেটে তৈরি করা বিকল্প সড়ক খুলে দেয়া হয় সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগের অক্লান্ত প্রচেষ্টার পর। যার ফলে দ্রুততম সময়ে রাঙ্গামাটি চট্টগ্রাম সড়ক দিয়ে হালকা যানবাহন চলাচল শুরু করেছে। তবে রাত ৮টার পর পুলিশ ওই সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ার ঘটনায় কিছুটা বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রামের চলাচলের যাত্রীবাহী বাসগুলো ঘাগড়া বাজার থেকে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য স্থানে চলাচল শুরু করে। এদিকে, মহাদুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ১১ দিন পরও রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি বান্দরবান সড়ক চালু হয়নি। এ বিষয়ে সড়ক বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সড়ক বিভাগ রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের দ্রুত কাজ করতে গিয়ে এরা অন্য সড়কের কাজ করতে পারেনি। এই ২টি সড়কে এখনও ১৫টি করে ৩০টি স্পটে পাহাড়ধসের ঘটনা রয়েছে। রাঙ্গামাটির সঙ্গে বিছিন্ন হয়ে যাওয়া সড়কগুলোর প্রথমিক পর্যায়ের কাজ করতে ৩০ কোটি টাকা জরুরী বরাদ্দ এসে পৌঁছেছে। অপরদিকে, আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরত সাড়ে তিন হাজার আশ্রিতের ঈদ করা অনিশ্চিয়তার মধ্যে রয়েছে। সৃষ্ট এই মহাদুর্যোগে রাঙ্গামাটি জেলায় এ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি হয়নি। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ১০ উপজেলা ও রাঙ্গামাটি পৌর সভার ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তালিকায় দেখা যায়, পুরো জেলায় প্রায় ১৮ হাজার লোকের ঘরবাড়ি ক্ষতি হয়েছে। জেলায় শুধু মানুষের ঘরবাড়ির ক্ষতির পরিমাণ ১৩৮ কোটি টাকারও বেশি। বর্তমানে বর্ষণ হ্রাস পাওয়ায় রাঙ্গামাটিতে মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন নতুন করে তাদের স্ব স্ব স্থানে ফিরে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্র থেকেও তাদের ভিটা মাটির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই মাঠে নেমেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রমও পুরো দমে শুরু করা হয়েছে। তবে তা এখনও সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। শহরের আশ্রয় কেন্দ্রেগুলোতে প্রচুর ত্রাণ সহায়তা নিয়ে সরকারের পাশাপাশি রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এখনও তিন হাজার চারশত লোক আশ্রয় কেন্দ্রে রয়ে গেছে। স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড়ধসে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে নতুন করে ঘর না করার নির্দেশ রয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের ভিটা মাটিতে গিয়ে নতুন করে ঘর করার কাজ করতে পারছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে অনেককে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকতে হচ্ছে। জেলায় বর্তমানে ২২ আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৩ হাজারের অধিক নারী-পুরুষ ও শিশু অবস্থান করছেন এবং তাদের সরকারী ব্যবস্থাপনায় জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। সরকারী ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা, সংগঠন এবং ব্যক্তিগত পর্যায়েও ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। খাগড়াছড়ি থেকে আমাদের পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি জীতেন বড়ুয়া জানান, খাগড়াছড়ির সার্বিক পরিস্থিতি উন্নতি হলেও জেলার পাহাড় ধস ও পাহাড়ী ঢলে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরুপণ করা হয়নি। এছাড়া পাহাড় ধসের আতঙ্কে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের খাবার সরবরাহ ছাড়া তাদের জন্য স্থায়ী কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি। অপরদিকে পাহাড় ধসে নিহত রামগড় ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার ২ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা, স্থানীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এদিকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রিতরা নিজ নিজ বাড়ি ঘরে ফিরে গিয়ে বাড়ি ঘর মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পৌর শহরের মুসলিম পাড়া গ্রামের মোঃ আবুল কালাম বলেন অর্থাৎ সঙ্কটের কারণে বাড়ি মেরামত করতে নোনা ভোগান্তিতে পড়ছে হয়েছে। সরকারীভাবে কোন সহায়তা পাননি। বন্যার পানিতে তার বসতঘরটি ভেঙ্গে গেছে। ৬টি হাঁস ও ১০টি মোরগ মুরগি, বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। নষ্ট হয়েছে সামান্য সবজির ক্ষেতটিও। ফলে বেঁচে থাকার জন্য তাদের নতুন করে সংগ্রাম করতে হয়েছে। অপরদিকে ভেঙ্গে পড়া পাহাড়েরা পাদদেশে বসবাসকারী ধসে পড়া পাহাড়রের মাটি সরিয়ে নিজেদের জায়গা বৃদ্ধি করতে দেখা যাচ্ছে। পৌর শহরের কদমতলী, শালবন, সবুজবাগ ও কুমিল্লা টিলা এলাকায় পাহাড়ের ধসে পড়া মাটি সরিয়ে নিজেদের জায়গা বৃদ্ধিতে অপতৎপরতা চালাতে দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে অভিযোগ দেয়া হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন কার্যকর প্রদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এ বিষয়ে ত্বরিত কোন পদক্ষেপ না নিলে রাঙ্গামাটির মতো প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারে।
×