ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবসায়ীদের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা

‘আশা দীর্ঘ, আশ্বাস সংক্ষিপ্ত’ প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২১ জুন ২০১৭

‘আশা দীর্ঘ, আশ্বাস সংক্ষিপ্ত’ প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আগামী অর্থবছরের (২০১৭-১৮) প্রস্তাবিত বাজেটকে একবাক্যে ‘আশা দীর্ঘ, আশ্বাস সংক্ষিপ্ত’ বলে মন্তব্য করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই সঙ্গে এ বাজেটকে উচ্চভিলাষী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর ব্যাখায় বিশ্বব্যাংক বলছে, বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা যেগুলো ধরা হয়েছে সেগুলো অর্জনের আশা করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আশা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ বা আশ্বাসগুলো সেই তুলনায় যথেষ্ট নয়। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির টার্গেট এবং রাজস্ব আদায়ের টার্গেট পূরণ সহজ হবে না বলে মনে করছে বহুজাতিক সংস্থাটি। তাছাড়া বাজেট বাস্তবায়নকেও বড় চ্যালেঞ্জ বলা হয়েছে। এছাড়াও ব্যাংকিং খাত ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, ভ্যাট আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা, বিদ্যুত ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ভিত্তি সুস্পষ্ট না করা, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক এবং চালের আমদানি শুল্ক ইস্যুকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। মঙ্গলবার বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয় তুলে ধরেছে বিশ্বব্যাংক। রাজধানীর আগারগাঁও এ সংস্থাটির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বক্তব্য রাখেন। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। বর্তমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে চালের আমদানি শুল্ক কমানোর পক্ষে মত দিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করছে। সরকারকে চালের মজুদ বাড়াতে হবে। সরকারীভাবে চাল ক্রয়ে বাজার দামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। তা নাহলে ব্যবসায়ীদের অযথা ভয়ভীতি দেখিয়ে লাভ নেই। এক্ষেত্রে বাজার থেকে চাল উধাও হয়ে যেতে পারে। চিমিয়াও ফান বলেন, বাজেটে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে টার্গেট ঠিক করা হয়েছে তা উচ্চাভিলাষী। বাজেটের বিশাল উন্নয়ন ব্যয় বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ বাজেট বাস্তবায়নে যে পরিমাণ কাঠামোগত সংস্কার নেয়া দরকার সেটি হয়নি। রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে সেটি উচ্চাভিলাষী এবং ভ্যাট নির্ভর। তবে প্রস্তাবিত বাজেটের বাস্তবায়ন যে একেবারে অসম্ভব, তা নয়। তিনি বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সংস্কার, ভ্যাট আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন, এডিপি বাস্তবায়নে দক্ষতা বাড়ানো গেলে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বেশি ব্যয় প্রাক্কলন করা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্প ব্যয় বেশি হওয়ার বিষয়টি একক কোন প্রকল্পের উপর নির্ভর করে না। এটি সার্বিকভাবে গড় হিসেবে দেখতে হয়। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগামী বাজেটে সবচেয়ে বড় সংস্কার ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা। এটি পুরোপরি বাস্তবায়নেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার খাত বেড়েছে। তিনি বলেন, নতুন করে শূন্য থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে না। ভ্যাট আগেও বিভিন্ন মাত্রায় ছিল। তাই ভ্যাট আইন গরিব মানুষের ওপর তেমন কোন তাপ সৃষ্টি করবে না বলে তিনি জানান। তবে জনগণের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের যে ধারণা, তার সঙ্গে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় আবগারি শুল্ক বাড়ানো সাংঘর্ষিক। এতে সাধারণ মানুষ নিরুৎসাহিত হবে। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্য কম ধরা হয়েছে। তবে আগামী অর্থবছর আবার ব্যক্তি বিনিয়োগ বেশি ধরা হয়েছে। সেটি সম্ভব হবে কিনা, সেটি প্রশ্ন থেকে যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশেরর স্বাস্থ্যকর প্রবৃদ্ধি চলছে। তবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় প্রতিকূল বাতাস বইছে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে আশার ভিত্তিতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। খরচের দিকে তেমন কোন চমক নেই, এটি গতানুগতিক। সংস্কারের ক্ষেত্রে স্বীকৃতি আছে, কিন্তু পদক্ষেপ নেই। আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য উচ্চাভিলাষী। এসব লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয়, তবে লক্ষ্য অর্জন যেসব উদ্যোগ দরকার সেগুলো বাজেটে নেই। তিনি বলেন, খরচের লক্ষ্য যদি উচ্চাভিলাষী হয়, আবার ঘাটতি যদি স্থিতিশীল রাখতে চাওয়া হয়, সেক্ষেত্রে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য আপনা আপনিই উচ্চাভিলাষী হবে। ঘাটতি অর্থায়ন প্রসঙ্গে বলেন, সরকার ঘাটতি অর্থায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে এ ঋণ নেয়া হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। মূল্যস্ফীতির বিষয়ে বলেন, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রয়েছে। এটা অস্বাভাবিক। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে চাহিদাকে বৃদ্ধি করার মাধ্যমে। তাই মূল্যস্ফীতি কম বেশি হওয়ার কথা। সরকারী লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সিস্টেম লস ও অদক্ষতা দূর করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত আগের এক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ অত্যন্ত বেশি। বিশ্বে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে বেশি খরচ পড়ছে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ভারত, চীন এবং ইউরোপের তুলনায় বাংলাদেশে চার লেন হাইওয়ে তৈরিতে বেশি খরচ হচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থান, জমির দাম এবং প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা এবং দুর্নীতির কারণে এমনটি হয়ে থাকে বলে এর আগের ওই গবেষণায় দেখা গেছে। বড় প্রকল্পে দরপত্রে প্রতিযোগিতা না হওয়ার কারণে প্রকল্প ব্যয় বেশি দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়। তাই শতভাগই টেন্ডারিং ব্যবস্থা শতভাগ চালু করা হলে দরপত্র নিয়ে দুর্নীতি কমে যাবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গত তিন বছরে একই চিত্র বিরাজ করছে। প্রথমদিকে বাস্তবায়ন কম হলেও শেষের দিকে বাস্তবায়ন বাড়ে। এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা বাড়লেও প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার সংখ্যা খুব কম। অর্থাৎ যোগ-বিয়োগে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া এডিপির বাইরে ফাস্ট ট্রাক প্রকল্প এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) উদ্যোগ নেয়া হলেও কোন উন্নতি নেই, ধীরগতি বিরাজ করছে। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার না করে শুধু কিছুটা পরিবর্তন আনলে সুফল মিলবে না। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো জরুরী। এডিপিতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে খাত নির্ধারণ ঠিক আছে। কিন্তু কিভাবে অর্থ ব্যয় হবে তা নির্দিষ্ট করা হয়নি।
×