ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ছড়াচ্ছে রোগব্যাধি ॥ বিবর্ণ ফসলি জমি

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৪ জুন ২০১৭

ছড়াচ্ছে রোগব্যাধি ॥ বিবর্ণ ফসলি জমি

সংবাদদাতা, বেড়া, পাবনা, ১৩ জুন ॥ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী ঘাট ও রঘুনাথপুরে যমুনা নদীর কোলঘেঁষে বেড়ে ওঠা প্রায় দু’শ বছরের পুরনো আবাসিক পল্লীতে কয়েক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গড়ে তুলেছেন কয়লার আড়ত। সড়কের পাশে খোলা জায়গায় রেখে দেয়া কয়লার গুঁড়ো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ায় এ এলাকার কৃষি-পরিবেশ ও জনজীবন হুমকির মুখে পড়েছে। যমুনার নির্মল বাতাসে এখন শুধুই পিট কয়লার পোড়া গন্ধ। একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করায় কয়লা শ্রমিকরা তাদের অজান্তেই ক্যান্সার ও যক্ষ্মাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বহন করে চলেছে। শনিবার নগরবাড়ী ঘাট সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, নগরবাড়ী ঘাট থেকে শুরু করে রঘুনাথপুর গ্রাম পর্যন্ত ১ কি.মি এলাকাজুড়ে রাস্তার দু’পাশে শুধু কয়লার স্তূপ। কয়লার গুঁড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বা উড়ে গিয়ে রাস্তায় মোটা আস্তরণ ফেলাসহ আশপাশের গাছগুলোর পাতা পর্যন্ত কালো রং করে ফেলেছে। লোড-আনলোডের সময় ছাড়াও একটু বাতাসেই কয়লার ডাস্ট বা গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ছে পার্শ্ববর্তী ফসলি জমিতে ও বাড়ি-ঘরে। কয়লা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোরের নওয়াপাড়া গ্রুপ ইন্দোনেশিয়া থেকে চট্টগ্রামে কয়লা আমদানি করে থাকে। আমদানিকৃত কয়লা সেখান থেকে কার্গো জাহাজের মাধ্যমে নগরবাড়ী নৌবন্দরে আসছে। এরপর পাবনার ব্যবসায়ীরা কয়লা কিনে নগরবাড়ীতে ব্যবসা করছে। এখানে কয়লার ব্যবসা করছে সোহেল ট্রেডার্স, আমান ট্রেডার্স, ভূইয়া ব্রাদার্স, জয়েন ট্রেডিং, নওয়াপাড়া ট্রেডার্সসহ সাত কয়লা ব্যবসায়ী। তারা উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন ইট ভাঁটিতে প্রতি টন গড়ে ছয় হাজার টাকা দরে এ কয়লা বিক্রি করছে। কয়লা ব্যবহারকারীদের আগে যেখানে সিলেট থেকে কয়লা কিনতে হতো এখন তারা হাতের কাছে কয়লা পাওয়ায় এখানেই ভিড় করছেন। কয়লার চাহিদা বাড়ায় একদিকে আমদানি বাড়ছে আর অন্যদিকে বাড়ছে কয়লার স্তূপ। ধীরে ধীরে রাস্তার পাশে ফসলি জমিতে নতুন নতুন কয়লার স্তূপ স্থাপন করা হচ্ছে। কাঁচা টাকার লোভে অনেক চাষী তাদের জায়গা ভরাট করে দিচ্ছেন কয়লা রাখার জন্য। আবার ফসল উৎপাদন নষ্ট হওয়ায় অনেকে বাধ্য হয়ে জমি লিজ দিচ্ছেন। এতে কৃষি জমি ভয়াবহ আগ্রাসনের মুখে পড়েছে। রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা ময়েন মোল্লা, ইউনুছ আলী, আফাজ সরদার, শের আলী জানালেন কয়লার ধুলা ও ঝাঁঝালো গন্ধের কারণে রাস্তায় আমাদের গ্রামের লোকজন চলেন নাকে রুমাল চেপে। রিক্সা-ভ্যান ছাড়া এ সড়কে পায়ে হেঁটে চলাচল করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তারা বলেন, দু’শ বছরের প্রাচীন রঘুনাথপুর গ্রামটি কিছু লোভী লোকের কারণে আজ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তারা দুঃখ করে বলেন, ‘আমাদের কি এ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে?’ রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা শাজাহান সেখ বলেন, ‘আমার বাচ্চারা পড়ে হরিনাথপুর মডেল হাইস্কুলে। কিন্তু তারা এ পথ দিয়ে চলতে পারছে না।’ একই কথা বললেন ইফাত সেখ ও সাঈদ সেখ। তাদের মেয়েরা কাশীনাথপুর মহিলা কলেজে পড়ে। গৃহবধূ রেবেকা পারভীন বলছিলেন, ‘এখন বাইরে কাপড় শুকাতে দিলেও তাতে কয়লার গুঁড়া এসে পড়ে। আর কয়লার ঝাঁঝালো গন্ধে ঘরের ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত চলে আসে। এতে দম বন্ধসহ বমি বমি লাগে।’ নগরবাড়ী নৌবন্দরের কয়লা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সোহেল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সোহেল সেখকে তাদের ব্যবসায় পরিবেশ অধিদফতরের কোন সনদ আছে কি না জিজ্ঞাসা করলে জানান, ‘সনদপত্র আছে।’ তবে তিনি সেটা দেখাতে পারেননি। কয়লা শ্রমিক নাজিমুদ্দীন জানান, জাহাজ থেকে প্রতি টন কয়লা খালাস করার জন্য চুক্তি করা হয়। প্রতিদিন দুই-তিন টন কয়লা খালাস হয়ে থাকে। এতে গড়ে প্রতি নারী-পুুরুষ শ্রমিক ৮০-৮৫ টাকা হাজিরা পান। শ্রমিক আল আমীন, হাতেম আলী এবং হাজেরা খাতুন ও তার সঙ্গীরা বলেন, কয়লা খালাস করায় ক্যান্সার ও যক্ষ্মারোগ হতে পারে সেটা তারা জানেন না। অভাবের তাড়নায় ঘাটে শ্রম বিক্রি করে সংসার চালান তারা। পাবনা বক্ষব্যাধি (টিবি) হাসপাতালের কনসালটেন্ট চিকিৎসক মাসুদুর রহমান বলেন, যক্ষ্মা বায়ুবাহিত একটি রোগ। ধুলাবালি বা যে কোন দ্রব্যের গুঁড়া (ডাস্ট) নিশ্বাসের সাথে ফুসফুসে গিয়ে আটকা পড়ে। ফুসফুসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্টের পাশাপাশি কাশি শুরু“ হয়ে থাকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেটা যক্ষ্মার রূপ ধারণ করে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর পাবনার উপ পরিচালক বিভুতি ভূষণ সরকার বলেন, ‘জমিতে কয়লার স্তর জমলে অবশ্যই ফলন কম হবে। কারণ মাটি এতে ঠিকমত প্রাকৃতিক খাদ্য ও বাতাস থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান গ্রহণ করতে পারবে না। ফলে গাছ বিবর্ণ হতে পারে এবং ফলন কমে যেতে পারে। পরিবেশ অধিদফতরের সনদ নিয়ে নিয়ম অনুযায়ী আবাসিক এলাকা বাদ দিয়ে সংরক্ষিত এলাকায় এ ব্যবসা করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×