ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ শাহজাদা সেলিম

নবজাতক ও শিশুদের হাইপোথাইরয়েডিজম

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ১৩ জুন ২০১৭

নবজাতক ও শিশুদের হাইপোথাইরয়েডিজম

নাজমা বেগম ও পারভেজ দম্পতি সদ্য একটি কন্যা সন্তানের মা ও বাবা হয়েছেন। সন্তানটি তাদের খুব আকাক্সিক্সক্ষত ছিল। তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা কন্যা সন্তানের জন্মগ্রহণের পর আনন্দে ভাসছিলেন। নাজমা বেগম হাইপোথাইরয়েডিজমের রোগ ভুগছিলেন। একটু দেরিতেই তারা সন্তান নিতে সমর্থ হয়। এর মধ্যে দু’ দু’বার এবর্শন হয়ে যায়, সে জন্য তারা খুবই দুশ্চিন্তা গ্রস্ত। সে জন্য এ কন্যা সন্তানটি পৃথিবীতে আসার পর তাদের আর আনন্দ ধরছিল না। তিন সপ্তাহ পর তাদের আবার একটু চিন্তাক্লিষ্ট হতে হলো। সুমাইয়া নামের এই বাচ্চা মেয়েটি খুব নরম তুলতুলে, খুব একটা কাঁদে না, প্রস্র্রাব ঠিক থাকলেও পায়খানা কম করছে বলে মনে হচ্ছে এবং নড়াচড়া খুবই কম। সুমাইয়া আসলে নবজাতকের হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতিজনিত সমস্যা)-এ ভুগছে।এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা খুব কম নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জায়গা, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে খাবারে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত সমস্যা বিরাজমান। বিশেষ করে গর্ভকালীন সময়ে যদি মায়ের আয়োডিনের ঘাটতি থাকে তবে সন্তানের জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজমের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারতেও এ সমস্যা প্রকট। প্রতি ১,৫০০ থেকে ২,৫০০ জীবিত সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে একজন করে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। নাজমা বেগমের মতো যে মহিলারা হাইপোথাইরয়েডিজমে ভুগছিলেন এবং সেটি যদি অটোইমিউন হাইপোথাইরয়েডিজম হয়ে থাকে, তা হলে তার সন্তানদের নবজাতকের হাইপোথাইরয়েডিজমে ভুগার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেকের থাইরয়েড গ্রন্থিটি মোটেও তৈরি না হওয়া বা অকার্যকরভাবে তৈরি হওয়ার কারণে এ রোগ হচ্ছে। এদের ক্ষেত্রে এটি জিনগত ত্রুটি। এ ত্রুটিটি বাবা মা রক্তের সম্পর্কিত হলে, সে ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে। একই এলাকার, একই পরিবারের বহু মানুষ হাইপোথাইরয়েডিজমে ভোগেন। আর অটোইমিউন হাইপোথাইরয়েডিজম এক্ষেত্রে বেশি লক্ষণীয়। নবজাতকের হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণসমূহ ি খুব কম নড়াচড়া করা ি কান্নাকাটি কম করাবা কাঁদলে অনেকটা মিউ মিউ শব্দ হওয়া ি খাদ্য গ্রহণে আগ্রহ কম ি শরীরের বৃদ্ধিও খুব কম ি জন্ডিস হওয়া ি পায়খানা খুব কম হওয়া ি শরীর তুলতুলে বা খুব নরম হওয়া ি পেট খুব বেড়ে যাওয়া বা পাতিলের মতো হয়ে যাওয়া ি মাথার তালু নরম থাকা ি আনুপাতিক হারে বৃহদাকার জিহ্বা ি নাভি বেরিয়ে আসা (আমরিলিকাল হারনিয়া) ি শীতল খসখসে ও শুকনো ত্বক ি ফ্যাকাশে দেখানো ি গলগ- বা ঘ্যাগ থাকা কিছু সংখ্যক নবজাতকের একই সঙ্গে আরও কিছু জন্মগত ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা থাকে তাদের এই কান্নাকাটি না করা, কম নড়াচড়া করা শুরুতে খুব ভাল বাচ্চার বৈশিষ্ট্য মনে করা হলেও দ্রুত এ ভুল ভেঙ্গে যায়। যে পরিবারের এ রকম রোগ ধরা পড়ে সে পরিবারের পূর্বের কোন সন্তানেরও এ রোগ হয়ে থাকার ইতিহাস থাকতে পারে। যে সব বাচ্চাদের জন্মের সময় ওজন দুই হাজার গ্রামের কম বা চার হাজার পাঁচ শ’ গ্রামের বেশি তাদের মধ্যে এ ধরনের রোগ থাকার সম্ভাবনা থাকা বেশি। আবার অধিক সন্তান প্রসবকারী মহিলার পরবর্তী দিকের সন্তানদের হাইপোথাইরয়েডিজম হবার ঝুঁকি বেশি থাকে। জন্মগত বা নবজাতকের হাইপোথাইরয়েডিজম শনাক্তকরণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম স্ক্রিনিং বা শনাক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সাধারণত নি¤œলিখিত পদক্ষেপ সন্নিবিষ্ট থাকে। ি জন্মের ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে নবজাতককে শনাক্তকরণ পদ্ধতির আওতায় আনা হয়। ি শিশুটিকে খুব যতœসহকারে তীক্ষèভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, যাতে হাইপোথাইরয়েডিজমের যে কোন লক্ষণ থাকলে তা ধরা পড়ে যায়। ি এরপর শিশুটি ল্যাবরেটরি টেস্ট করা হয়। একটু বেশি বয়সী শিশু হলে তার বুদ্ধিমত্তা (আইকিউ)-র পরীক্ষা করা হয়। কারণ জিনগত ত্রুটি ছাড়া সবচেয়ে বড় কারণ হলো খাদ্যে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত এলাকায় বসবাস করা। এর সঙ্গে যদি পরিবেশগত অন্য কোন কারণ যোগ হয় তাহলে সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। থাইরয়েডের হরমোন তৈরিতে ব্যর্থতা, গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা ইত্যাদিও থাকে। মাকে যদি গর্ভকালীন সময়ে রেডিওএক্টিভ আয়োডিন থেরাপি দেয়া হয়, তাহলে গর্ভস্থ শিশু থাইরয়েড গ্রন্থি তৈরি না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ রোগটি শনাক্ত করণ প্রক্রিয়া খুব সহজ। রক্তের নমুনা ও গলার আল্ট্রাসনোগ্রাম করেই নিশ্চিতভাবে নবজাতকের হাইপোথাইরয়েডিজম শনাক্ত করা যায়। উন্নত বিশে^র প্রায় সকল নবজাতকেরই হাইপোথাইরয়েডিজম আছে কি না তা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু কম উন্নত (বাংলাদেশসহ) দেশগুলোতে অধিকাংশ নবজাতকের ক্ষেত্রে শনাক্তকরণের পরীক্ষাগুলো করা হয় না। চিকিৎসা যে সব নবজাতকের হাইপোথাইরয়েডিজম ধরা পড়বে তাদের লেভোথাইরক্সিন ট্যাবলেট দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। পরবর্তীতে থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতা দেখে লেভোথাইরক্সিনের মাত্রা ঠিক করা হয়। জিনগত, গ্রন্থির ত্রুটি বা থাইরয়েড গ্রন্থির অনুপস্থিতির কারণে এ রোগ হয়ে থাকে : তা হলে রোগীটিকে আজীবন এবং বেশি মাত্রায় এ ওষুধটি সেবন করতে হয়। আর অন্য কারণগুলোতে কারও কারও ক্ষেত্রে কোন এক সময় ওষুধ বন্ধ করার মতো পরিস্থিতিও হতে পারে। চিকিৎসা পরবর্তী ফলাফল যে সব নবজাতক-শিশুর রোগ দ্রুত শনাক্ত হবে এবং সঠিক মাত্রায় থাইরক্সিন দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া হবে, তাদের দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই হবে। কিন্তু রোগটি শনাক্তকরণে দেরি হলে অথবা সঠিকভাবে চিকিৎসা করা না হলে নবজাতক/শিশুটির দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। মানসিক বৃদ্ধিও ঠিকমতো হবে না। সারা পৃথিবীতে যত কম বুদ্ধিসম্পন্ন বা হাবাগোবা লোক আছে তাদের একটা বড় অংশই বৃদ্ধিকালীন সময়ে হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত ছিল বা সঠিকভাবে চিকিৎসা পায়নি। শিশু-কিশোরদের হাইপোথাইরয়েডিজম শিশু-কিশোররা সাধারণত দু’রকম হাইপোথাইরয়েডিজমে ভোগে- ি জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম : (উপরে আলোচিত হয়েছে)। ি পরবর্তী সময়ে সংঘটিত হাইপোথাইরয়েডিজম : এ ধরনের হাইপোথাইরয়েডিজম সাধারণত বয়োসন্ধিকালের আগে আগে বা বয়োসন্ধিকালের কাছাকাছি কোন সময়ে শুরু হয়। বাংলাদেশের ৭৫০ জন শিশুর মধ্যে এ রোগে ১ জন আক্রান্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১,২৫০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন এ রোগে ভোগে। যা তাদের ১২ বছর বয়সই মোট শিশুর ৪.৬ শতাংশ। শারীরিক বহুবিধ প্রয়োজনে থাইরয়েড হরমোন অতীব জরুরী। যেমন- শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি, শিশুর হাড়ের গঠন তৈরি এবং বিপাকীয় কার্যক্রম। প্রায় সব দেশেই শিশু-কিশোররা অটোইমিউন হাইপোথাইরয়েডিজমে ভোগে। এ ক্ষেত্রে দেহের রোগ প্রতিরোধী কার্যক্রম (ইমিউন সিস্টেম) থাইরয়েড গ্রন্থির কোষগুলোকে আক্রমণ করে যাতে প্রদাহ তৈরি হয় এবং থাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষমতা হ্রাস করে থাকে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে পিটুইটারির কার্যক্রম কমে যাবার কারণে বা কোন কোন ওষুধের কারণে হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে। ডাউনসিনড্রোমের মতো কিছু কিছু জন্মগত রোগেও শিশুদের হাইপোরয়েডিজমে ভুগতে দেখা যায়। লক্ষণ সমূহ ি দৈহিক বৃদ্ধি কম বা বামুনত্ব বা বৃদ্ধির হার ধীর দেহের তূলনায় হাত-পা খর্বাকৃতি হওয়া ি স্থায়ী দাঁত উঠতে বিলম্ব হওয়া ি লেখা পড়ায় খারাপ হওয়া, অমনযোগী বা মনোসংযোগে ব্যর্থ হওয়া ি বুদ্ধিমত্তায় ঘাটতি প্রদর্শিত হওয়া ি দৈহিক দুর্বলতা ি মুখ ফোলা ফোলা লাগা ি দৈহিক স্থূলতা ি ঘুমের সমস্যা ি বেশি ঠা-া লাগা বা জ্বর জ্বর বোধ করা ি চুল ভঙ্গুর হওয়া ি নারীর গতি ধীর হওয়া ি গলগ- বা ঘ্যাগ ি মাংস বা অস্থি সন্ধিতে ব্যথা ি যৌবন প্রাপ্তিতে বিলম্ব উপরিউক্ত লক্ষণ থাকলে শিশুকে অতি দ্রুত একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ (এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট) কে দেখানো জরুরী। তিনি শিশুটির রক্তের নমুনা নিয়ে থাইরয়েড ও হরমোন পরিমাপের ব্যবস্থা করবেন। অনেক ক্ষেত্রেই গলার আল্ট্রসনোগ্রাম দরকার হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রমজোমাল, জেনেটিক বা আপটেক টেস্ট করতে হতে পারে। প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হলোÑ থায়রক্সিন ট্যাবলেট দেয়া। এক্ষেত্রে এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট শিশুটির হরমোনের ঘাটতির মাত্রা, হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণ, শিশুর বর্তমান অবস্থাÑ সবই বিবেচনা করবেন। যত আগে চিকিৎসা শুরু করা যাবে শিশুটির স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা তত কম হবে। সহকারী অধ্যাপক, এ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ মোবা-০১৭৩১৯৫৬০৩৩ Email: [email protected]
×