ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে নতুন ট্রাইব্যুনাল

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ৯ জুন ২০১৭

নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে নতুন ট্রাইব্যুনাল

নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে ৪১ নতুন ট্রাইব্যুনাল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সংসদে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মতে অসংখ্য মামলা বিচারাধীন থাকায় দ্রত বিচার ট্রাইব্যুনালে আইনী প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার এবং সক্রিয় করতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৯টি মামলা এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল একটি আইনী প্রতিষ্ঠান। যার প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব নারী ও নির্যাতনের মামলাগুলো আমলে নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে যথাসময়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করে রায় প্রকাশ করা। কিন্তু দীর্ঘসূত্রতা এবং মামলার জট পাকানোর প্রচলিত ধারার আইনী প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি করা প্রায়ই অসম্ভব। ফলে নির্যাতিতা বিচার প্রার্থীরা কখনও সুবিচার পায় না। আইনী ব্যবস্থার এই বেসামাল অবস্থায় বিপাকে পড়ে শুধু নির্যাতিতরাই নয় অপরদিকে অপরাধচক্র আরও সক্রিয় হয় নতুন উদ্যমে তাদের সহিংস কার্যক্রম চালিয়ে যেতে। নারী ও শিশু নির্যাতন আজ দেশের একটি চলমান সহিংস কার্যক্রম চালিয়ে যেত। নারী ও শিশু নির্যাতন আজ দেশের একটি চলমান সহিংস কার্যক্রম। নারীদের অসাম্য বৈষম্যের শিকার হতে হয় একেবারে পরিবারের ছোট্ট গ-ি থেকে। ক্রমেই তা বৃহত্তর সামাজিক আঙ্গিনায় সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে। আজও শিশুকন্যার জন্ম সামাজিক অভিশাপ, তা যেমন মনে করেন বাবা মা একইভাবে পুরো সমাজও। একটি কন্যাশিশু বড় হয় পরের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এ সময়ের মধ্যে বাবা মা যতটুকু পারেন কন্যাকে প্রাথমিক শিক্ষাটুকু দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুত্র সন্তানকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য বাংলার ঘরে ঘরে বাবা মার যে ত্যাগ তিক্ষিকা, নিঃস্বার্থ আত্মনিয়োগ কন্যাসন্তানের বেলায় সেটা কখনও হতে দেখা যায় না। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাল্যবিয়ের প্রকোপে পড়া এ দেশের অবোধ বালিকার জীবনে যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা নেমে আসে সেখান থেকে শুরু হয় তাদের নির্যাতনের মাত্রা। সিংহভাগ মেয়ে তাদের ওপর হওয়া এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন আইনী সহায়তাও চায় না। নীরবে, নিঃশব্দে সহ্য করে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে। আবার কিছু লড়াকু মেয়ে পারিবারিক যে কোন সহিংসতার বিরুদ্ধে শুধু রুখেই দাঁড়ায় না, আইনী ব্যবস্থায় ফরিয়াদ জানাতেও দ্বিধা করে না। অর্থাৎ যে যৎসামান্য বিচারিক মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ায় তারও কোন সুষ্ঠু নিষ্পত্তি হয় না। নতুন ট্রাইব্যুনাল তৈরি এই প্রক্রিয়াকে কতখানি অবারিত করবে সংশ্লিষ্টদের জন্য তা একমাত্র সময়ই বলে দিতে পারবে। এ তো গেল পারিবারিক নিপীড়নের কথা। এরপর সামাজিকভাবে নিগৃহীত মেয়েদের সুষ্ঠু কোন আইনী সমাধান একেবারে কল্পনার বাইরে। ধর্ষণের মতো সহিংস শারীরিক আক্রমণ একেবারে আইনবহির্ভূত এবং এর বিচারিক সমাধানও আছে। কিন্তু আইন লঙ্ঘনের ঔদ্ধত্যে অধিকাংশ ঘটনা আদালতের দোরগোড়ায়ও পৌঁছে না। যেটুকু পৌঁছায় তাও হয়তবা দীর্ঘসূত্রতা নতুবা সুরাহা পর্যন্ত যেতেই পারে না। নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল যা আছে তাও যদি সঠিক এবং যথার্থভাবে তাদের বিচারিক বিধিনিষেধাজ্ঞাগুলো প্রয়োগ করতে পারত তাহলে নির্যাতিতরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেত। এমনকি অপরাধের মাত্রাও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। নারী এবং শিশু নির্যাতন ব্যবস্থায় সবচেয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় নারী ও শিশু পাচার চক্র। আর্থিকভাবে লাভবান, বিদেশ যাওয়া, আরও উন্নত মানের জীবনযাপনের মোহ ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে নারী ও শিশুদের সংশ্লিষ্ট অপরাধ চক্র তাদের তৈরি করা জালে জড়িয়ে নেয়। আর এসব নারী মুলত বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত কিংবা পারিবারিকভাবে নিগৃহীত কোন অসহায় মেয়ে। তাদের সমস্যা বহুমাত্রিক। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এসব নারীর পায়ের তলায় মাটিই নড়বড়ে হয়ে যায়। তার ওপরে নির্মম পাচারকারীদের চক্রব্যূহের শৃঙ্খলে এমনই আটকা পড়ে যেখান থেকে বের হওয়ার পথ তাদের জানা থাকে না। আর বিদেশ বিভূঁই তো অচেনা-অজানা এক দৈত্যরাজ্য। সেখানে গিয়ে একবার পড়লেই এসব অসহায় নারীর ষোলোকলা পুর্ণ হয়। বিচার প্রার্থী হওয়ার আগেই অনেককেই নির্যাতনের শিকার হয়ে মুত্যুবরণ করতে হয়। এমন সহিংস উদাহরণ ও তথ্য সংবাদ এবং গণমাধ্যমে প্রায়ই উঠে আসে। নারী ও শিশু পাচারকারী চক্ররা সেভাবে ধরা পড়ে না বিচার ব্যবস্থার আওতায়ও আসতে হয় না। এ ছাড়া সমাজে অন্য এক ধরনের নির্যাতন প্রায়ই ঘটে থাকে। সেটা প্রতিটি পরিবারে যারা গৃহশ্রমিক রাখেন সেখানে। গৃহশ্রমিকদের সিংহভাগই শিশুকন্যা কিংবা অবোধ বালিকা। আর যিনি নির্যাতন করেন তিনিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী। এই গৃহকর্মী নির্যাতনও আমাদের সমাজে একটি সহিংস নিষ্পেশনের চিত্র। একজন সচেতন গৃহকর্ত্রী তার প্রতি মুহূর্তের সাহায্যকারীকে যেভাবে অত্যাচার এবং নিপীড়ন করেন তা যেমন লোমহর্ষক একইভাবে সভ্যতাবিবর্জিত বন্য যুগের এক শ্বাপদসঙ্কুল বিভীষিকা। গৃহপরিচারিকা এবং আশ্রিতা মেয়েটির ওপর যে ধরনের সহিংস ঘটনার নগ্ন থাবা বসানো হয় সেটা যে কোন গৃহস্থালির পরিবেশকে নস্যাত করে দিতে যথেষ্ট। এই ধরনের জঘন্য অপরাধেরও আজ অবধি বিচারিক প্রক্রিয়াই কোন সমাধান হয়নি। জানি না নতুন ট্রাইব্যুনাল তার নিজস্ব ব্যবস্থাকে কতখানি এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিভিন্ন সামাজিক জরিপে উঠে আসে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন অপরাধের প্রচলিত আইনী বিধান না থাকলে নাকি নতুন বিধি তৈরি করা হয় উদ্ভূত অন্যায়কে মোকাবেলা করার জন্য। কিন্তু সেই আইন না জানে অপরাধী না বোঝে নির্যাতিতরা। সুতরাং প্রচলিত বিধিবিধানেরই কোন তোয়াক্কা করা হয় না প্রভাবশালীদের প্রতিপত্তির কারণে। যেখানে বিদ্যমান ট্রাইব্যুনালকে আরও সক্রিয় এবং জোরদার করা জরুরী ছিল সেটাকে পাশ কাটিয়ে নতুন আইনী ব্যবস্থা তৈরি করা কতখানি ফলপ্রসূ হবে সেটাই দেখার বিষয়।
×