ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ডিপ্রজন্ম : বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন জাতিসংঘে, প্রথমেই বাংলাদেশকে নিয়ে যেমন স্বপ্ন দেখেন?

বাংলাদেশের গর্ব সওগাত নাজবিন

প্রকাশিত: ০৭:৪৬, ৩০ মে ২০১৭

বাংলাদেশের গর্ব সওগাত নাজবিন

সওগাত নাজবিন : স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশ তার বিপুল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে পরিণত করে বিশ্বের অন্য দেশসমূহের কাছে একটি অনুকরণীয় রাষ্ট্রের মডেল হয়ে উঠবে। ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ অগ্রগামীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। আরও স্বপ্ন দেখি এদেশে নারী ও তরুণদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দেশগঠনে তারা অংশগ্রহণের যথাযথ সুযোগ পাবে। ডিপ্রজন্ম : প্রথম দিকের গল্প শুনতে চাই। পরিবারের কোন বাধা ছিল চলার পথে? সওগাত নাজবিন : ইতোপূর্বে আমার দাদা, নানা এবং বাবা বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবামূলক কাজ করেছেন। তাই আমার এ ধরনের কাজে পরিবার কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তবে তারা চেয়েছিলেন আমি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কিংবা সরকারী চাকুরির পাশাপাশি এ কাজগুলো করি। আমি কর্মজীবন শুরু করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এবং গবেষণা দিয়ে। পরে তা ছেড়ে দিয়ে সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করি। আমার এ সিদ্ধান্তটিতে পরিবারের সমর্থন ছিল না। পারিবারিক বাধার চেয়ে বরং একজন মেয়ে হিসেবে এ ধরনের কাজ করতে গিয়ে সামাজিক বাধার সম্মুখীন অনেক বেশি হয়েছি। ডিপ্রজন্ম : ডিজিটাল স্কুল করার চিন্তাভাবনা কখন এলো- সওগাত নাজবিন : ছাত্রবস্থাতেই এইচ. এ. ফাউন্ডেশন নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। এই ফাউন্ডেশনের মূল কার্যক্রম ছিল তারাকান্দা উপজেলার স্কুল পর্যায়ের মেধাবীদের মধ্যে বৃত্তি প্রদান। এর জন্য প্রতিবছর বাছাইমূলক পরীক্ষার আয়োজন করা হতো। বৃত্তি প্রদান করাকে কেন্দ্র করে একই দিনে অনুষ্ঠিত হতো খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। এই কার্যক্রমের ফলে উপজেলাটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এই সাফল্যকে পুনরূপ দিতে পরিকল্পনা করি গ্রামের মানুষের কাছে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা পৌঁছে দেওয়ার। গতানুগতিক পাঠদান ও শিখার পদ্ধতির পরিবর্তে পড়াশোনাকে শিক্ষার্থীদের নিকট উপভোগ্য করে তুলতে ইন্টার এ্যাক্টিভ ডিজিটাল প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেই। এইচ. এ. ডিজিটাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ এই পরিকল্পনারই বাস্তব রূপ। ডিপ্রজন্ম : মেইলে যখন জানলেন, বিশ্বের সতেরো জন যুবদূতের একজন আপনি, তখনকার অনুভূতি কি ছিল? সওগাত নাজবিন : বেশ কয়েকটি ধাপে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ইমেইলে যোগাযোগ হচ্ছিল জাতিসংঘের সদর দফতরের সঙ্গে। পরবর্তী ধাপগুলোতে আমরা কিভাবে অংশগ্রহণ করব সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। এ পর্যায়গুলোতে আমাদের জানানো হয়নি আমরা কতজন সম্মানজনক উপাধির জন্য লড়ছি এবং কারা এ বিচার প্রক্রিয়ায় জড়িত। একবারে শেষ মুহূর্তে মেইলটি যখন এলো তখন জানতে পারলাম ১৮৬টি দেশের সাড়ে আঠারো হাজার তরুণ নেতার সঙ্গে এ প্রতিযোগিতা এবং বিচারক ছিলেন বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী এবং নামকরা ব্যক্তিবর্গ। নির্বাচিত মাত্র কয়েকটি দেশের যুব প্রতিনিধিদের মধ্যে দেখলাম আমার নাম এবং আমার দেশের নাম। আনন্দ, গর্ব এবং পরিতৃপ্তিতে ভরে উঠছিল মন সেদিন। দেশের জন্য আরও বড় কিছু করার অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলাম সেদিন আরেকবার। ডিপ্রজন্ম : এখন পর্যন্ত যেসব অর্জন রয়েছে- সওগাত নাজবিন : গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্য ২০১৬ সালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে সম্মানজনক ‘কমনওয়েলথ ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক’ অর্জন করি। একইসঙ্গে ‘এশিয়া ইয়াং পারসন অব দ্য ইয়ার ২০১৬’ উপাধি অর্জন করি। এছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘জিইএসএস ইডুকেশন এ্যাওয়ার্ড’ ২০১৭ প্রদান করে আমাকে। জাতিসংঘের ‘উইমেন স্কলারশিপ ফর পিস ২০১৬’ ও দেয়া হয় আমাকে। এর আগে ২০১৫ সালে জার্মানির শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিবেশবান্ধব জ্বালানি নিয়ে সফল গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘গ্রিন ট্যালেন্ট এ্যাওয়ার্ড’ পদান করে। এছাড়া জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ অধিবেশনে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার যুবদূত নির্বাচিত হই। এছাড়া প্রচুর পুরস্কার, স্কলারশিপ, ফেলোশিপ অর্জন করেছি। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সংখ্যাটাই বেশি। ডিপ্রজন্ম : যেসব কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বর্তমানে— সওগাত নাজবিন : টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) যুবদূত হিসেবে আমার মূল কাজ হচ্ছে সারা বিশ্বে তরুণদের মাঝে ‘এসডিজি’ বিষয়ক সচেতনতা গড়ে তোলা, আর তারা কিভাবে ‘এসডিজি’ তে অবদান রাখতে পারে সে বিষয়ক দিক নির্দেশিনা দেওয়া এবং জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলোর এসডিজি প্রচারণামূলক কর্মকা-ে সহায়তা প্রদান করা। আন্তর্জাতিক সেবা ও উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়মিত আমাকে তাদের ইভেন্টগুলোতে অতিথি বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। প্রতিমাসে দেশের বাইরে অন্তত দুটি ইভেন্টে যোগদান করতে হচ্ছে। তাই আগের তুলনায় আমার প্রতিষ্ঠানকে অপেক্ষাকৃত কম সময় দিতে পারছি। কিন্তু জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় এসডিজি বিষয়ক কর্মসূচীগুলোতেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে। সম্প্রতি গ্রামে নারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছি। সেটির প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ চলছে। এছাড়া এইচ এ ডিজিটাল স্কুল এ্যান্ড কলেজের সামগ্রিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু প্রোগ্রাম ডিজাইন করছি। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে ব্যবহৃত ডিজিটাল কন্টেন্ট আরও সহজীকরণ, শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আইসিটি বিষয়ক দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ এবং প্রতিষ্ঠানটির জন্য ব্যবহৃত বিল্ডিংটিতে সৌরশক্তি ব্যবহার করে মোট বৈদ্যুতিক চাহিদার ৫০% মেটানো। ডিপ্রজন্ম : পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংগঠনটির যুবদূত হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর কোন দিকগুলো আপনার চোখে পড়েছে? সওগাত নাজবিন : বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সকল প্রতিকূলতা ছাপিয়ে ইতোপূর্বে বাংলাদেশ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস (এমডিজি) এর অনেক ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করে দেখিয়েছে। বাংলাদেশের এই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা জাতিসংঘে প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশী তরুণদের বিচরণ বাড়ছে এবং দেশের জন্য তারা সম্মান বয়ে আনছে। ডিপ্রজন্ম : বাংলাদেশের তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলুন- সওগাত নাজবিন : বাংলাদেশের তরুণদের আত্মনির্ভরশীল হতে শিখতে হবে। প্রতিটি কাজ প্রথমে নিজে করার চেষ্টা করতে হবে। ছোট-বড় সবার কাছ থেকে শেখার মানসিকতা থাকতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি গঠনমূলক ও সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত। বাংলাদেশে এখন অনেক সেবা ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে অনেক কিছু শেখা যায়। এই অভিজ্ঞতাগুলো পরবর্তী জীবনের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। তবে পড়াশোনা ও সমাজসেবামূলক কাজ এই দুটির মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে জানতে হবে। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে যে কোন ক্ষেত্রে পড়াশোনা ও কাজ করে দেশের কল্যাণে ভূমিকা রাখা যায়। শুধু প্রয়োজন সদিচ্ছা, ধৈর্য, দৃঢ় মনোবল এবং কাজেকর্মে এসবের যথাযথ প্রতিফলন ঘটানো। ডিপ্রজন্ম : ধন্যবাদ আপনাকে। সওগাত নাজবিন : ধন্যবাদ আপনাকেও।
×